বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

আল্লাহর মহব্বত ছাড়া আলেম হওয়া যায় না

আল্লামা মাহ্মূদুল হাসান

কোরআন-হাদিস তথা শরিয়তের জ্ঞান অর্জন করার জন্য মানুষ লেখাপড়া শিখে আলেম হয়, হাফেজ হয়, কারি হয়। এসবের মূল মাকসাদ আত্মার পরিশুদ্ধি ও আল্লাহর মারফত লাভে ধন্য হওয়া এবং আল্লাহ ও রসুলের মহব্বতের দ্বারা দিলকে খাঁটি বানানো। আলেমের অন্তরে যদি আল্লাহর মহব্বত না থাকে, রসুলের মহব্বত না থাকে এবং রসুলের হুকুমের গুরুত্ব না থাকে তাহলে তাকে শরিয়তের পরিভাষায় আলেম বলা হয় না।

শরিয়তের পরিভাষায় আলেম তাকেই বলা হবে, যার এলেম ও আমলের মধ্যে মিল আছে। এলেম ও আমলের মধ্যে মিলের অর্থ হলো, যে এলেম শেখা হয়, কিতাবে যা পড়া হয় অন্তরে তার প্রতিক্রিয়া হবে এবং কাজের মাধ্যমে তার বিশুদ্ধ প্রকাশ ঘটবে। বাতাস যখন ছোটে তখন তার প্রভাব শরীরে অনুভূত হয়, শরীর ঠান্ডা লাগে। সূর্য উদিত হলে তার প্রতিক্রিয়া আছে; তেমনি কোরআন শরিফ পড়লে, কোরআন গবেষণা করলে, হাদিস পড়লে, হাদিস নিয়ে গবেষণা করলে মানুষের অন্তরে একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এ প্রতিক্রিয়াকে বলা হয় নুরে এলেম বা এলেমের নুর। এর মাধ্যমে ফিরাসাতে ইমানি তথা অন্তর্দৃষ্টি সৃষ্টি হয়। অজ্ঞাত বা অদৃশ্য বস্তুগুলো দিলের মধ্যে বাস্তব-সদৃশ হয়ে যায়। যার দিলের মধ্যে এলেম শিক্ষার পরও কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না হয়, আল্লাহর মহব্বত সৃষ্টি না হয় ইসলামের পরিভাষায় তাকে আলেম বলে না, বরং জাহেল বলে। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন!

এ রুহানিয়াত ও মারফতে হজরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) দর্জায়ে কামালত অর্জন করেছিলেন। ছাত্রজীবনেই তিনি তা লাভ করেছিলেন। এজন্যই লেখাপড়া শিখে বাড়ি ফেরার সময় ওস্তাদ তাঁকে বলেছিলেন, এই ছেলেটা আমার কাছে কোরআনের জাহের শিখেছে, আর আমি তার কাছ থেকে কোরআনের বাতেন তথা মারফত, আধ্যাত্মিকতা হাসিল করেছি। এটাই হলো দীন শিক্ষার মূল মাকসাদ। তিনি যখন মক্কা-মদিনায় ছিলেন তখনই উঁচু দরজার বুজুর্গ হয়ে গিয়েছিলেন। আল্লাহওয়ালা যারা হন তাদের বাহ্যিক চোখ তো খুলে যায়ই, দিলের চোখও খুলে যায়। আজকাল তো অনেক সাধারণ মানুষও আমাদের দেশে আলেম বনে গেছে। আল কোরআনের বঙ্গানুবাদ হয়েছে। হাদিসের বাংলা হয়ে গেছে। সেগুলো পড়ে পড়ে বিরাট আলেম বনে গেছে একেকজন। অনেক সময় বড় বড় আলেমকেও তারা চ্যালেঞ্জ করে বসে। এ ধরনের আলেম এ আয়াতের কী অর্থ বুঝবে? বেশির চেয়ে বেশি এ আয়াতের অর্থ তারা এটুকু বুঝবে যে, যারা আল্লাহর প্রতি ইমান আনবে এবং নেক আমল করবে তাদের প্রতি আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবে। এর বেশি বুঝবে না। কারণ, বাহ্যিক দৃষ্টিতে এর চেয়ে অধিক বোঝা যায় না। কারণ চোখ তো শুধু শব্দ বোঝে এবং শব্দের বাহ্যিক অর্থ বোঝে। এর চেয়ে বেশি তার উপলব্ধি করার ক্ষমতা নেই। কারণ চোখও তো একটা বস্তু, তাই বস্তুর বাইরে সে যেতে পারে না।

পৃথিবীতে যারা বস্তুবাদী শিক্ষায় শিক্ষিত, বিরাট বিরাট জ্ঞানী হয়েছেন বস্তুবাদী শিক্ষায়, যেমন ফ্রয়েড, লেনিন, কার্ল মার্কস যাদের নাম শুনলে আমাদের দেশের একশ্রেণির শিক্ষিত অস্থির হয়ে পড়েন। বস্তুজ্ঞানে তারা বিরাট জ্ঞানী ছিলেন সত্য কিন্তু বস্তুর বাইরেও যে একটা কিছু আছে তা তারা জানেনই না। বস্তুর পেছনে ছুটতে ছুটতে তারা শেষে আল্লাহকে অস্বীকার করে বসেছেন। কারণ আল্লাহ তো বস্তু নন। চোখ তো বস্তু ছাড়া কিছুই দেখে না। যেমন নমরুদ বস্তু ছাড়া কিছুই দেখেনি, ফেরাউন দেখেনি, আবু জাহেল দেখেনি। প্রথমে দেখেননি হজরত ওমর ফারুক (রা.), আবু বকর (রা.), ওসমান (রা.), আলী (রা.), মুয়াবিয়া (রা.) প্রমুখ সাহাবায়ে কেরাম। কারণ তারাও প্রথমে বাহ্যিক চোখে দেখতেন। যারা সহি, হক্কানি আলেম হন, তাঁদের অন্তর্চক্ষু খুলে যায়। এ আয়াতের অন্তর্নিহিত অর্থ তারা দিলের চোখ দিয়ে দেখেন। এটা বাহ্যিক চোখে দেখা যায় না। বাহ্যিক চোখে তো শুধু শব্দ দেখা যায়। আমরা তো এ চোখে উপস্থিত দৃশ্য ছাড়া কিছুই দেখছি না। কিন্তু হজরত দেহলভি (রহ.) বলেন, রুহের জগতে আল্লাহ যখন বলেছিলেন, আমি কি তোমার প্রভু নই? এ কথাটি তো আমার মনে আছেই এমনকি আমার চারপাশে যারা বসা ছিলেন তাদের কথাও আমার মনে আছে। দেহলভি (রহ.) ‘ফুয়ুজুল হারামাইনি শরিফাইনের মধ্যে বলেন যে, আমি মক্কা-মদিনা থাকাবস্থায়ই আমার দিল খুলে গেছে। অদৃশ্য জগৎ আমার সামনে দৃশ্যমান হয়ে গেছে। তখন আমি দেখেছি, যে মজলিসে কোরআন তিলাওয়াত করা হয়, হাদিস বর্ণনা করা হয় সেখানে বক্তা ও শ্রোতার ইখলাসের বরকতে রসুল (সা.)-এর রওজা থেকে একটি নুরের ধারা বর্ষিত হতে থাকে।

আল কোরআন এমন একটা জিনিস, সেটা যে-ই পড়ুক, যেখানেই পড়ুক যদি সে মুখলিস হয়, তিলাওয়াত শুদ্ধ হয় তাহলে তার তাসির না হয়ে পারে না। আবু নায়িম ইস্পাহানি স্বীয় কিতাবের মধ্যে লেখেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক মানুষ অনেকভাবে মুসলমান হয়েছে, কিন্তু আমি ওই সব মানুষের লিস্ট একত্রিত করেছি যারা কট্টর কাফের ছিল, কিন্তু কোরআন তিলাওয়াত শোনার সঙ্গে সঙ্গে তারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এ ধরনের ব্যক্তির সংখ্যা ১ হাজারের বেশি। এসব ঘটনা আমি আমার জীবনে নোট করেছি।’ হজরত ওমর ফারুক (রা.)-এর ঘটনা কে না জানে? মনে তো হয় আরবের মধ্যে তখন ওমরের মতো সাহসী ও নবীবিরোধী আর কেউ ছিল না।

 

                লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ।

সর্বশেষ খবর