শুক্রবার, ১ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

ভক্তি উৎসবের রথযাত্রা

ফনিন্দ্র সরকার

ভক্তি উৎসবের রথযাত্রা

সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম একটি উৎসব রথযাত্রা। কালের প্রবাহে উৎসবটি কেবল হিন্দুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সামাজিক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত রথযাত্রা ধর্মীয় আচার ছাড়া যে মহামেলা অনুষ্ঠিত হয় তা এখন সর্বজনীন উৎসবের নামান্তর। আষাঢ়ের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসব শুরু হয়। আট দিনব্যাপী এ উৎসবে ভক্তমনে যে ভক্তিভাব সঞ্চারিত হয় তা মানবিক উৎকর্ষের অনির্বচনীয় সাফল্য। জ্যোতির্বিদ্যায়  উল্লেখ আছে, মহাকাশে বিষুবরেখা থেকে সূর্য একবার উত্তরে আবার দক্ষিণে পরিক্রমণ করে। সূর্য সপ্ত-অশ্বচালিত রথে আষাঢ়ে উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ন পরিক্রমণ করে। সূর্যের এ বিষুবরেখা উত্তর-দক্ষিণে পরিক্রমণের সঙ্গে রথযাত্রার শুরু ও ফিরতি যাত্রার বেশ একটা মিল রয়েছে। প্রকৃতির এ বিধান অনুসারেই আষাঢ়ে রথযাত্রা শুরু হয়। পৃথিবীর সব ধর্মের সঙ্গেই প্রকৃতির একটা সাযুজ্য বিদ্যমান।

জগন্নাথদেবের রথযাত্রা সম্পর্কে পদ্মপুরাণ ও স্কন্দপুরাণে বিস্তারিত উল্লেখ আছে। মূলত ধর্মীয় বিশ্বাস ও ভক্তিমার্গের যুগশঙ্খে আবদ্ধ মহাশক্তির বিচিত্র রূপ আমাদের নানাভাবে অনুপ্রাণিত করে। সে বিশ্বাসকে অনুভূতির জায়গায় ঠাঁই দিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে বিভিন্ন উৎসব পালনে ব্রতী হই। হিন্দুধর্মের পুরাণ অনুসারে জগন্নাথদেব হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতিবিম্ব। প্রাচীনকাল থেকে হিন্দু সম্প্রদায় বিভিন্ন দেবদেবী-কেন্দ্রিক ভক্তি-উৎসবের আয়োজন করছে। বিষ্ণু, শিব, সূর্য, দুর্গা প্রভৃতি দেবদেবীকে নিয়ে উৎসব পালিত হতো। বুদ্ধদেব ও পার্শ্বনাথকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধ ও জৈনদের মধ্যেও উৎসবের প্রচলন রয়েছে। কালের বিবর্তনে হিন্দু সম্প্রদায়ের সব উৎসব পুরির জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উৎসবে অঙ্গীভূত হয়। উল্লেখ্য, পুরি হচ্ছে ভারতের ওড়িশা রাজ্যের মনোরম সমুদ্রসৈকত। একসময় পুরিই ছিল ওড়িশার রাজধানী। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, শবরদের বসবাস ছিল পুরির বনাঞ্চলে। পুরির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে শহরের মধ্যস্থলে জগন্নাথদেবের সুবিশাল মন্দির। মন্দিরকেন্দ্রিক ধর্মীয় পাদপীঠ পুরি ভারতের অন্যতম চারধামের প্রধান ধাম হিসেবে খ্যাত। পর্যটক ও তীর্থযাত্রী উভয়ের কাছেই পুরি যেন মর্ত্যরেই বৈকুণ্ঠ। হিন্দু সমাজে প্রবাদ আছে- তিন দিন তিন রাত পুরিধামে অবস্থান করলে স্বর্গ প্রাপ্তি অবধারিত। এগুলো নিতান্তই বিশ্বাসের বিষয়। পুরাণমতে, ২ হাজার বছরের বেশি সময় থেকে রথযাত্রার উৎসব প্রচলিত। এ নিয়ে অবশ্য মতভেদ রয়েছে। রথযাত্রা উৎসবটি পুরিকেন্দ্রিক। পুরির রথোৎসবের আদলে হিন্দু সম্প্রদায় বিভিন্ন অঞ্চলে রথযাত্রা উৎসবটি পালন করে। রথে অধিষ্ঠিত দেবতা জগন্নাথদেব ডানে, মাঝখানে জগন্নাথের বোন সুভদ্রা, বাঁয়ে বলভদ্র। এর অর্থ হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণই জগন্নাথ, বলভদ্র হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণের ভাই বলরাম, বোন সুভদ্রাও রথে আসীন থাকেন। অসংখ্য ভক্ত রথ টেনে নিয়ে যায় পুণ্য সঞ্চয়ের লক্ষ্যে। ভক্তদের বিশ্বাস, রথে আসীন দেবমূর্তি দর্শন ও রথ টেনে নেওয়ার সুযোগ তাদের জন্য দেবতার আশীর্বাদ লাভের উপায়। রথের অন্য একটি ব্যাখ্যাও আছে। তা জীবন ঘিরে।

কটোপনিষদে আছে-

আত্মানং রথিনং শরীরং রথমেব তু।

বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধিং মনঃ প্রগ্রহমেব চ ॥

অর্থাৎ আত্মা হচ্ছে রথী বা রথের মধ্যে অবস্থানকারী দেবতা, রথ হলো শরীর বা দেহযন্ত্র। বুদ্ধি হলো সারথি বা চালক। মনকে লাগামের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ইন্দ্রিয়গুলোকে ঘোড়ার সঙ্গে তুলনা করা যায়। জড়জগতে যত রকম ভোগ করার বিষয় আছে সেগুলো হলো রথের গমনপথ বা সড়ক। ঘোড়াগুলো ভালো হলে রথটিকে সারথি যথার্থভাবে লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে। আর যদি উচ্ছৃঙ্খল হয়, তবে দুর্ঘটনা অনিবার্য। মনদ্বারা ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দেহরথের ধ্বংস অনিবার্য। বস্তুত মানব জীবনটা রথেরই প্রতীক। জীবন ঘিরেও বাস্তবতানির্ভর অনেক উৎসব হয়। কিন্তু রথোৎসবের তাৎপর্য বুঝতে হবে আগে। রথের মালিক ভগবান। দেহের মালিকও তিনি। রথে ভগবান অধিষ্ঠিত থাকেন। রথ টেনে নিয়ে যায় অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগী। ভক্তসমাবেশ ঘটে রথোৎসব কেন্দ্র করে। একাকার হয়ে যায় অভিন্ন চিন্তায়। রথের যে ধর্মীয় বিষয়টি থাকে কিংবা নিয়মনীতির সংকল্পিত অনুষ্ঠানের বাইরে এক মহামিলন ঘটে মানুষের। ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্বে আছে মানুষের মধ্যেই ভগবানের বাস। এক মহাশক্তি সব মানুষকেই চালিত করে। সেই মানুষের মহাসমাবেশে পারস্পরিক ভালোবাসার আবহ তৈরি হয়। শুধু ধর্মীয় অনুষঙ্গের সংমিশ্রণের ফলেই ভক্তির ভাবটি উৎসারিত হয়। রথের সামনে ভক্তমেলা দেখে রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক কবিতায় লিখেছিলেন-

‘রথযাত্রা লোকারণ্য মহা ধুমধাম।

ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।’

মানবপ্রেমের মূর্তপ্রতীক চৈতন্যদেব যিনি ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। তিনি তাঁর অনুগত ভক্তসহ পুরির রথযাত্রা উৎসবে অংশ নিয়ে এ উৎসবকে আরও মহিমান্বিত করেছেন। অব্যয় অক্ষয় করে রেখেছেন রথযাত্রা মহোৎসবকে। তাঁর জন্যই আবহমানকাল থেকে ভক্তির উৎসব হিসেবে রথযাত্রা উৎসব সমৃদ্ধি লাভ করেছে। সমুদ্রতীরে দৈবযোগে প্রাপ্ত নিম গাছের টুকরো দিয়ে জগন্নাথদেবের মূর্তি নির্মিত হয় এবং স্বয়ং ব্রহ্মা তাঁর পূজা করেন বলে উড়িয়া সাহিত্যের ইতিহাসে বিধৃত। সেজন্য জগন্নাথদেবকে দারুব্রহ্ম নামেও অভিহিত করা হয়েছে। উড়িয়া সাহিত্যের প্রখ্যাত পন্ডিত ও দার্শনিক রামনুজের মতে, জগন্নাথের বিগ্রহ বুদ্ধ, রামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণের সমন্বিত মূর্তি। রথোৎসব চলমান মন্দিরে বিগ্রহের পূজানুষ্ঠান। সেজন্য এ অনুষ্ঠানে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার অংশগ্রহণের সুযোগ ঘটে। এ উৎসব দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে মহাতীর্থ লাঙ্গলবন্দ ¯œানযাত্রা থেকে ধর্মীয় উৎসবের যে আবহ তৈরি হয় রথযাত্রা উৎসবের মধ্য দিয়ে এর সমাপ্তি ঘটে পরবর্তী বছরে উৎসবের প্রত্যাশা বুকে নিয়ে। রথযাত্রার উৎসব ভ্রাতৃত্ব ও সহমর্মিতার বোধ জাগিয়ে তোলে। সবাই মিলে আনন্দ উপভোগ করি। আনন্দটাই জীবনকে ধন্য করে। ভক্তিতে শক্তি জোগায় মানবহৃদয়ে।

লেখক : প্রবন্ধকার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর