বৃহস্পতিবার, ৭ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

পদ্মা সেতুর সুফল সন্ধান

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

পদ্মা সেতুর সুফল সন্ধান

প্রসঙ্গটি প্রথমে সামনে এলো এবারের ঈদুল আজহার যাতায়াতে যে ভৌত সুযোগটি উন্মোচিত হয়েছে তাকে কেন্দ্র করে। কেননা পদ্মা সেতু থেকে যে সুফল অর্জিত হবে তাকে টেকসই হতে দেখা এখনকার বড় বিবেচ্য বিষয়। স্বপ্নের সেতু পদ্মা এখন বাস্তবে বিদ্যমান। যেসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য কীর্তিনাশা নামে খ্যাত প্রমত্তা পদ্মার ওপর এক যুগের বেশি সময় নিয়ে ৩২ হাজার কোটি (রেল যোগাযোগটি সংস্থাপন এবং নদীশাসনের বাড়তি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে এর পরিমাণ বাড়তে পারে) টাকার বেশি ব্যয়ে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এবং বিশ্বের ২৫তম দীর্ঘতম সেতু নির্মাণ করা হলো, সেই সেতুর ফিজিবিলিটি রিপোর্টে আঞ্চলিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আর্থসামাজিক উন্নয়নের যে আশাবাদ উঠে এসেছে তা অর্জনের পথনকশায় নজর রাখতে হবে। কেননা সেতু নির্মাণে অর্থায়ন যেভাবেই হোক না কেন, আলটিমেটলি জনগণের করের টাকায় এটি নির্মিত হয়েছে এবং সে কারণেই এর সুফল প্রাপ্তিটাও জনগণের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার। পদ্মা সেতুর উপকারভোগী সমাজ ও অর্থনীতিকে স্বয়ম্ভর এবং সক্ষম করে তুলতে পারলেই সেতুর সার্থকতা প্রতিপন্ন হবে। পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে উন্নয়নের সম্ভাবনার যে দুয়ার উন্মুক্ত করেছে, সেই সম্ভাবনার স্বপ্ন সত্যে পরিণত করায় সরকারসহ সবাইকে এখনই মনোনিবেশ করতে হবে। তাহলেই স্বীকৃত হবে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর অর্থবহ বাস্তবায়ন।

পদ্মা সেতু চালু হয়েছে ২৫ জুন। পরদিন থেকে টোল দিয়ে যানবাহন চলাচল করছে। সেতু বিভাগ এ সেতু থেকে এক বছরে প্রায় পৌনে ৫০০ কোটি টাকা আয় করতে চায়। কারণ এ আয় থেকেই সেতুর টোল আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের ব্যয় ও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করা হবে। সুতরাং সেতু বিভাগের প্রথম বিবেচ্য বিষয় হবে প্রথম দিকে দিনে গড়ে ৮ হাজার এবং আড়াই বছরের মাথায় দিনে সেতু দিয়ে ৪১ হাজার যানবাহন চলাচল করার প্রাক্কলন অনুযায়ী সঠিক টোল আদায় ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা গড়ে তোলা। টোল আদায়ে দীর্ঘসূত্রতা কিংবা দুরভিসন্ধিমূলক টেকনিক্যাল ত্রুটির খপ্পরে পড়লে লাভের গুড় পিঁপড়েয় যেমন খাবে তেমনি সময় অসময়ে সেতুর দুই পাড়ে অপেক্ষমাণদের সারি দীর্ঘ হতে থাকবে। যমুনা বঙ্গবন্ধু সেতুসহ বড় বড় সেতুতে মাঝেমধ্যে এ ধরনের বিড়ম্বনাদায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এবারের ঈদুল আজহায় পদ্মা সেতু দিয়ে অন্তত ২৫ জেলায় ঈদযাত্রার বহর বাড়বে। এটা মনে রাখতে হবে, ঈদের সময় ঢাকা থেকে বড় বড় লঞ্চে/বাসে/ট্রেনে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে যারা যাতায়াত করে তার বড় একটা অংশ এবার পদ্মা সেতুতে ঝুঁকবেই। শোনা যাচ্ছিল, ডিজিটাল সিস্টেমে ৩ সেকেন্ডে টোল আদায় হবে। কিন্তু সবাই সে ব্যবস্থাপনা অনুসরণে অভ্যস্ত বা প্রশিক্ষিত হতে যে সময় লাগছে সে সময়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বিকল্প ব্যবস্থা রাখা দরকার ছিল। আদায়কৃত টোল সেতু কর্তৃপক্ষের তহবিলে ব্যাংকিং/মোবাইল চ্যানেলে যথাসময়ে জমা হওয়ার পদ্ধতিতে নিন্ডিদ্র ব্যবস্থা থাকতে হবে। পদ্মা সেতুর টোল থেকে আয়ের একটি অংশ টোল আদায়কারী প্রতিষ্ঠানকে দিতে হবে।

পদ্মা সেতুর স্থায়িত্বকাল ধরা হয়েছে ১০০ বছর। এ সময়ে সেতুটির গুরুত্ব (কেপিআই হিসেবে) বিবেচনায় টোলের টাকা দিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ও সার্ভিস রক্ষণাবেক্ষণে বড় ব্যয় আবশ্যক হবে। আগামী পাঁচ বছরের জন্য টোল আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন (কেইসি) ও পদ্মা সেতু নির্মাণে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে (এমবিইসি)। তারা পাঁচ বছরে ৬৯৩ কোটি টাকা পাবে। ঠিকাদারদের তদারক করবেন সেতু কর্তৃপক্ষ। অতীতের ক্ষয়ক্ষতি ও আইনি/ পদ্ধতিগত জটিলতা উদ্ভবজনিত অভিজ্ঞতার আলোকে এ ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা ও তদারকির আবশ্যকতা থেকে যাবে। তাদের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির মধ্যে বিরোধ বিপত্তির ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।

প্রচুর সম্ভাবনা আর ইতিহাস-ঐতিহ্যে ভরপুর অসংখ্য স্থাপনা বুকে ধারণ করলেও কেবল প্রমত্তা পদ্মার কারণে এত দিন সবকিছুই যেন ছিল নক্ষত্রসমান দূরত্বে। বিশাল নদী পাড়ির ঝক্কি এড়াতে অনেকেই বিনিয়োগে ও সমাজসেবায় আসতে চাইতেন না দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এ ২১ জেলায়। সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এভাবে যুগের পর যুগ পিছিয়ে থাকার সেই কষ্ট দূর হওয়ার প্রত্যাশায় এ সেতু ঘিরে তাই এখন শিল্প-বাণিজ্য আর পর্যটন খাতে নয়া বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছে ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা ও যশোর অঞ্চলের মানুষ। পুরোদমে চলছে সম্ভাবনার নতুন ভুবনে প্রবেশের প্রস্তুতি। রাজধানী ঢাকা থেকে সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের দূরত্ব প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। এ ক্ষেত্রে মাত্র ২৬৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থান কুয়াকাটার। এত কাছে থেকেও কুয়াকাটা পর্যটকদের মনোযোগ কাড়তে পারেনি কেবল পদ্মা নদীর কারণে। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় স্থাপিত পায়রা সমুদ্রবন্দর ও মোংলা সমুদ্রবন্দরের প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসার স্বপ্ন এখন বাস্তবে দেখতে চায় দক্ষিণ-পশ্চিমের মানুষ। বর্তমানে পায়রা ও মোংলা বন্দরে নিয়মিত ভিড়ছে সমুদ্রগামী জাহাজ। ভবিষ্যতে ভারী শিল্প গড়ে উঠবে সেখানে। ইতোমধ্যে মোংলা বন্দর এলাকায় বেশ কয়েকটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি চালু হয়েছে এবং গড়ে উঠছে গার্মেন্টসহ রপ্তানিমুখী শিল্প।

একদিকে বন্দর আর অন্যদিকে ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগে সময় কমে আসায় পুরো অঞ্চলের অর্থনীতি ও জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলবে। সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে আকরাম পয়েন্টে গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে স্থান নির্বাচনের ও নির্মাণের। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয় যে মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় সে সভায় নিজে উপস্থিত থেকে দেখেছি, সে সময় আকরাম পয়েন্ট টেকনিক্যাল সব দিক দিয়ে ভালো অবস্থানে থাকলেও শুধু হিন্টারল্যান্ড/ব্যাকআপ যোগাযোগব্যবস্থায় অপ্রতুলতা থাকায় সোনাদিয়ার কাছে আকরাম পয়েন্ট হেরে যায়।

রাজধানী থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায় পায়রা বন্দরের দূরত্ব অর্ধেক এবং মোংলা বন্দরের দূরত্ব আরও কম। সাগরপাড় থেকে পণ্য পৌঁছাতেও লাগবে কম সময়। এ বিবেচনায় পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর নিঃসন্দেহে বাড়বে পায়রা ও মোংলা বন্দরের গুরুত্ব। সবকিছু মিলিয়ে ‘পদ্মা সেতু দক্ষিণের অর্থনীতি এগিয়ে নিয়ে যাবে আকাশসম উচ্চতায়’। অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে পদ্মার দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে। পিরোজপুরের স্বরূপকাঠিতে আটঘর-কুড়িয়ানার পেয়ারাবাগান ঘিরে গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র জলের রাজ্য, বরগুনার তালতলীতে শুভসন্ধ্যা সমুদ্রসৈকত এবং টেংরাগিরি বনাঞ্চল, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে জাহাজমারা সৈকত, গলাচিপার কলাগাছিয়া সাগরপাড়, পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার হরিণপালা, বরগুনার পাথরঘাটার হরিণঘাটা, সাতক্ষীরার সুন্দরবনসংলগ্ন মুন্সীগঞ্জ ও বুড়ি গোয়ালিনীতে ‘আকাশনীলা’। ভোলার মনপুরা-চরফ্যাশন থেকে পটুয়াখালীর গলাচিপা-রাঙ্গাবালী হয়ে কুয়াকাটা এবং বরগুনার পাথরঘাটা-তালতলী পর্যন্ত পুরো উপকূলীয় এলাকাজুড়ে একটি এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন করার চিন্তাভাবনা চলছে। বস্তুত পুরো দক্ষিণাঞ্চলই তো একটি পর্যটন কেন্দ্র। এখানকার খাল-নদী-জঙ্গল আর সাগরপাড়ের বিস্তীর্ণ উপকূল ঘিরে কেবল প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। পৃথিবীতে এমন দেশও রয়েছে যারা কেবল পর্যটন শিল্পের ওপর ভিত্তি করে নিজেদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করেছে। পদ্মা নদীর কারণে এত বছর ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা এই দক্ষিণও এখন মাথা তুলে দাঁড়াবে পর্যটন সেক্টরে। উপকূলীয় সমুদ্রতীরে স্থায়ী বেড়িবাঁধের বেষ্টনী তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি ঘটবে পর্যটন শিল্পের প্রসার। তবে এর জন্য সবার আগে প্রয়োজন কার্যকর প্রকল্প গ্রহণ এবং তার দ্রুত বাস্তবায়ন। সবার সময় সমান নাহি যায়। প্রবহমান কালের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে চলতে না পারলে সাফল্যের বাসর হবে না, বিপত্তি বৈষম্য বিচ্ছেদ বাড়বে।

বিশাল এ সম্ভাবনার পালে নতুন হাওয়া আনবে যে পদ্মা সেতু, সেই সেতু চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ কতটা এগিয়ে যাবে তা নিশ্চিত করতে চাই কার্যকর কর্মপরিকল্পনা। যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার পর অঞ্চলজুড়ে কৃষি ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ব্যাপক পরিবর্তনের আশা করা হচ্ছে। দক্ষিণ-পশিচমাঞ্চলে সবার মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। কারণ প্রতিটি ক্ষেত্রের মানুষ যে কোনো ধরনের প্রয়োজনে সহজে ঢাকায় আসা-যাওয়া করতে পারবে। এখানকার মাছ কখনো ঢাকার বাজারে যেতে পারেনি। অথচ হাজার হাজার টন মাছ উৎপাদন হয় এখানে। চিকিৎসা থেকে শুরু করে ব্যবসা- সবকিছুই পাল্টাবে এখন। এ সময় এতদঞ্চলের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পসংশ্লিষ্ট নতুন উদ্যোক্তাদের বিশেষ স্টার্টাপ ঋণ প্রকল্পের আওতায় আনতে পারলে ব্যাপক কর্মসংস্থান ও রেজিলিয়েন্ট ননফরমাল সেক্টর গড়ে উঠবে। পদ্মা সেতুর প্রাথমিক প্রভাব পড়বে দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি খাতে আর দীর্ঘমেয়াদি সুফল আসবে ভারী শিল্প খাতে। তবে শুরুতেই বড় গতিশীলতা আসবে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে। সেতুর কারণে সব ধরনের কৃষিপণ্য তাদের সবচেয়ে কাক্সিক্ষত বাজারে দ্রুত যেতে পারবে। শুধু ঢাকা নয়, বরং বড় বড় জেলা শহরগুলোয় এমনকি প্রতিবেশী ভারতীয় সাত রাজ্যে তাদের পণ্য যাওয়ার সুযোগ পাবে।

বিশেষ করে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদ, খুলনা ও বাগেরহাটের মাছ, যশোরের সবজি আর ফুল, বরিশালের ধান ও পান পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি অর্থনীতির ভিত্তি। খুলনার যে মাছ ঢাকার বাজারে নেওয়া ছিল বড় চ্যালেঞ্জ, এখন সেটিই সহজ হবে। যশোরের গদখালীর ফুল ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি হয়। আবার দেশের সবজির বাজারের বড় একটি অংশই আসে যশোর অঞ্চল থেকে। পদ্মা সেতু দিয়ে দ্রুত এসে ঢাকার প্রবেশমুখে যদি মাছ নিয়ে যানবাহনকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হয় তাহলে সম্পূর্ণ সুফল পাওয়া যাবে না। তাই শুরু থেকেই পদ্মার দুই পারের সংযোগ সড়কগুলো সম্পর্কে সতর্ক ও যত্নবান হতে হবে।

 

লেখক : সাবেক সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর