বৃহস্পতিবার, ৭ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় যা ঘটছে

খায়রুল কবীর খোকন

কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় যা ঘটছে

প্রায় দুই যুগ পাকিস্তানি ‘ইবলিশি স্বৈরাচারের’ সঙ্গে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা বিখ্যাত রাজনৈতিক দলটির প্রায় সাড়ে তেরো বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনকর্মের নানা গুণের বিকাশ ও প্রকাশ ঘটেছে। মোনেম খানি এনএসএফ মার্কা নব্য-যুগ শুরু হয়েছে যেন! ঘটনা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেখানকার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের।

একটা প্রথম সারির বাংলা দৈনিকের শেষ পৃষ্ঠায় ২ জুলাইয়ের শিরোনাম ‘শিক্ষার্থীদের হলে তোলা শুরু’। রিপোর্টটির ভিতরের কিছু অংশ বেশ মজাদারই বটে! ‘করোনার পর গত বছরের ১৭ অক্টোবর হল খোলে। এরপর সিট দখল করতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের কক্ষে তালা দিতে শুরু করে ছাত্রলীগ। সেই সঙ্গে বৈধভাবে হলে ওঠা শিক্ষার্থীদের নানা কায়দায় হলছাড়া করেন সংগঠনটির নেতারা। এ পরিস্থিতিতে হল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আলোচনা করে দখলকৃত কক্ষে অবৈধদের নামিয়ে দিয়ে আবাসিক শিক্ষার্থীদের তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ৯৪ সিট খালি হলে মেধার ভিত্তিতে ৬৬ শিক্ষার্থীকে সিট বরাদ্দ দেয়। কিন্তু হল প্রশাসন ২২ জনকে সিটে তুলতে পারলেও বাকিদের বিষয় অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে; ছাত্রলীগ নেতারা অবৈধ দখল ধরে রাখতে মরিয়া।’

পর দিন ৩ জুলাই অন্য এক প্রধান বাংলা দৈনিকের খবর- ‘রাবির হলে শিক্ষার্থী তোলা নিয়ে রাতভর নাটকীয়তা’ : ‘দখল ছাড়তে রাজি নয় ছাত্রলীগ’/‘৪২ জনের মধ্যে ১৫ জন তাদের কক্ষে উঠতে পেরেছেন’।

ছাত্রলীগ এখন পুরোপুরি ষাট দশকের মোনেম খানি এনএসএফের ভূমিকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ক্যাম্পাসেই সরকারি দলের সমর্থক ছাত্র নামধারীদের সংগঠন স্রেফ দখলবাজি আচরণ করে যাচ্ছে। কিছুদিন আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের শান্তিপূর্ণ মিছিলে ছাত্রলীগ হামলা চালায় পর পর তিন দিন। এখনো তারা সব ক্যাম্পাস ছাত্রদলমুক্ত রাখার অপকর্মে লিপ্ত।

৩ জুলাইর খবর : কক্সবাজারের খুরুশকুলে আওয়ামী লীগের এক স্থানীয় কমিটির সম্মেলনে দলীয় কোন্দলে এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের ওপর সশস্ত্র হামলা চালালে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা নিহত হয়েছেন। সাড়ে তেরো বছর একটানা ক্ষমতায় থাকাকালে দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে এ রকম অসংখ্য হামলা -পাল্টা হামলা চলেছে- সরকারি দলের সমর্থক ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও অন্যসব সহযোগী সংগঠন অন্তঃকোন্দলে জড়িয়ে। তাতে অনেক কর্মী ও নেতা নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন বহু নেতা-কর্মী। আর বিরোধী পক্ষের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা তো আওয়ামী লীগ আর তার সহযোগী সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক তৎপরতার মন্দ-কর্মই বিবেচিত হচ্ছে। আর বিরোধী দলগুলো যখন এসব ব্যাপারে কথা বলে তখন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সাফাই গেয়ে যান- তাঁদের দলের নেতা-কর্মীরা বিরোধী পক্ষের কারও ওপর কোনো হামলাই করছে না, বিরোধী দলের অভিযোগ সব বানোয়াট।

পাঠক-বন্ধুরা অবশ্যই জানেন-বোঝেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী হলে ছাত্রলীগের দখলবাজির সুযোগ কীভাবে তারা পেয়েছে, অন্য কোনো ছাত্র সংগঠন কি এ ধরনের আচরণ ইচ্ছা করলেও করতে পারবে? হল প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সে সুযোগ কি অন্য কাউকে দেবে? এই যে প্রায় নয় মাসব্যাপী ছাত্রলীগের পেশিশক্তির প্রদর্শন এই একটি হলে এবং অন্যসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, হল প্রশাসন কি এসব সমস্যার সমাধানে নীতিগত অবস্থানে অনড় থেকে যথার্থ সাহসী হয়ে দ্রুত সমাধান করতে পারত না? না, তারা পারে না, কারণ এনএসএফের পালনকর্তা যেমন ছিলেন গভর্নর মোনেম খান, তেমনি এসব নব্য এনএসএফের পালনকর্তা আছেন সরকারি দলের নেতাদের মধ্যে। সেসব নেতার রক্তচক্ষুর ভয়ে সবাই দিশাহারা। বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য, সিনিয়র শিক্ষক, হল প্রাধ্যক্ষ, প্রক্টর ও অন্যদের তো মেরুদন্ড থাকতে হবে, সেটা তো সবাই নিজে নিজেই খেয়ে বসেছেন। তাই ছাত্রলীগ নেতাদের তোয়াজ-তোষামোদ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে জায়গা পেতে হয় এবং পাওয়া জায়গাটা ধরে রাখতে হয়, দ্রুততার সঙ্গে প্রমোশনগুলো পেতে হলে ক্ষমতাধরদের ছত্রচ্ছায়ায় থাকার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত রাখতে হয়।

এই যে এত এত কিশোর গ্যাং সারা দেশে, তাদের সন্ত্রাসে সবাই দিশাহারা; আশুলিয়ায় যে কলেজশিক্ষক নিহত হলেন জিতু নামে সন্ত্রাসীর (যে এক কিশোর গ্যাং লিডার) হাতে তার পেছনের মদদদাতা- সবাই দেখেছেন সরকারি দলের স্থানীয় এক নেতা। নড়াইলের যে শিক্ষক লাঞ্ছনার শিকার হলেন সে ঘটনার পেছনে মদদদাতাও সেই সরকারি দলের স্থানীয় নেতারা। যত সন্ত্রাসী মানুষের সুখ-শান্তি ধ্বংস করছে তাদের পেছনে মদদদাতা-নেতা কারা, সবাইই জানেন তারা সরকারি দলের বিশিষ্ট-অবস্থানের লোকজন, পুলিশ ইচ্ছা করলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না। সারা দেশে সরকারি দলের নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় যখন সন্ত্রাসীদের পোয়াবারো, তখন ক্ষমতাসীন শীর্ষ নেতারা দেশবাসীকে আশার বাণী শুনিয়ে যাচ্ছেন- তাঁরা নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে যারপরনাই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন। সাড়ে তেরো বছর ধরে গণতন্ত্র গেছে বিসর্জনে, সারা দেশে সন্ত্রাস আর নৈরাজ্য ক্ষমতাধর রাজনীতিকদের মদদদানের ফলে বাড়ছে অবিরাম। গণমানুষের অভিযোগের কোনো প্রতিকার নেই; কারণ, পুলিশ ও সিভিল আমলা গোষ্ঠী ক্ষমতাবান-রাজনীতিকদের দিনের ভোট রাতে করিয়ে দিয়ে নিজেদের অবস্থান ঠিক রেখেছেন, নিত্যনতুন প্রমোশন আদায় করে নিয়েছেন, জুটেছে দুর্নীতির মাধ্যমে আখের গোছানোর সুযোগ, জনদাবি আর গণমানুষের সংকট সমাধানে কী হলো আর কী না হলো- সেসব নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই।

আর আমলাদের ভাবনা হচ্ছে- তাদের কী দায় পড়েছে জনমানুষের সমস্যা সমাধানে জানপ্রাণ দেওয়া খাটুনির, (তারা তো রাষ্ট্রের প্রশাসনে চাকরিরত), যখন ক্ষমতাবান রাজনীতিকরা চরম অসাধুতার আশ্রয়ে ভোট ডাকাতি করে ক্ষমতা দখল করে নেন এবং স্বৈরতন্ত্রী শাসকে পরিণত হন, কোনো জবাবদিহিতার বালাই নেই তাদের! বর্তমান সরকারের শীর্ষ নেতারা কিছু অপ্রয়োজনীয় বিলাসী প্রকল্প (অবকাঠামো উন্নয়নের মেগা প্রকল্প) বাস্তবায়ন করে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। আগামী নির্বাচনটাও জাল-জোচ্চুরি করে জেতা যায় কি না সেটাই তাদের এখন মূল লক্ষ্য। তাদের একটাই দুশ্চিন্তা- যদি দিনের ভোট আগের রাতে ডাকাতি করার মতো কোনো সুবিধা এবার না পাওয়া যায়, তাহলে তাদের তো ১০ শতাংশ আসন লাভই কঠিন হয়ে পড়বে, আর নির্বাচনে হেরে গেলে তাদের আমলে যে অপচয় ও দুর্নীতি হয়েছে সেসবের দায়দায়িত্ব তো তাদের ঘাড়ে এসে পড়বে। তাই তাদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। অনেকেই অবিরাম প্রলাপ বকে যাচ্ছেন, বিএনপি ও অন্যসব বিরোধী নেতাকে গালিগালাজ করে যাচ্ছেন। এসব ক্ষমতাধর নেতার মধ্যে যাঁরা তাঁদের ভুলের জন্য প্রকৃতপক্ষেই অনুতপ্ত, তাঁদের সামনে একটা ভালো পথ খোলা আছে- নিজেদের ভুলের জন্য জাতির কাছে, রাষ্ট্রের কাছে ক্ষমা চাওয়া- ভবিষ্যতে আর কোনো ভুল করবেন না; এবং ভুল রাজনীতির পথও পরিত্যাগ করার ঘোষণা দিতে হবে। এ সৎসাহস যাঁরা দেখাতে পারবেন তাঁরা হয়তো ভবিষ্যৎ রাজনীতিতেও নেতা হিসেবে অবস্থান পাবেন। কারণ কেউ যদি নিজের ভুল স্বীকার করে এ দেশের মানুষ সহজেই তাকে ক্ষমা করে দিতে জানে।

                লেখক : বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সাবেক এমপি ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর