শুক্রবার, ১৫ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

সমুদ্রসীমার তেল গ্যাস উত্তোলন করুন

রণেশ মৈত্র

সমুদ্রসীমার তেল গ্যাস উত্তোলন করুন

শতভাগ দেশি সম্পদের ওপর ভর করে প্রমত্তা পদ্মা নদীর ওপর একটি বিজ্ঞানসম্মত, অত্যাধুনিক, দৃষ্টিনন্দন সেতুর নির্মাণকাজই অবশেষে শেষ হলো তা-ই নয়, সেই সঙ্গে তার চোখ ঝলসানো উদ্বোধন ও স্বপ্নের সেই সেতুটির ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচলও শুরু হলো। দক্ষিণের সঙ্গে উত্তরের যোগাযোগ স্বপ্নের মতোই সহজতর হয়ে নতুন সম্ভাবনার দুয়ারও খুলে দিল। ২৫ জুন উদ্বোধন হলেও মাসব্যাপী পৃথিবীর সব দেশে অভিবাসী বাঙালি সমাজ প্রকাশ্যে আনন্দ-উৎসবে মেতেছেন- দেশের প্রতিটি প্রান্তে আনন্দের জোয়ার বয়েছে- নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ নাচে-গানে মাতোয়ারা।

এ উৎসব স্তিমিত হয়ে আসতে কোথাও কোথাও হয়তো বা জুলাইয়ের সমাপনী সপ্তাহ এসে যাবে। আর তা হবেই বা না কেন? প্রায় ১০ বছর যাবৎ পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে পত্রপত্রিকায়, সভা-সমিতিতে যত প্রচার, আলাপ-আলোচনা, তর্কবিতর্ক হয়েছে, বিগত ৫০ বছর যাবৎ বাংলাদেশের আর কোনো মেগা বা মিনি বা মাঝারি প্রকল্প নিয়ে তা হয়নি।

এ তর্কবিতর্কের উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর সঙ্গে জড়িত হয়েছিল বিশ্বব্যাংক, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা প্রভৃতি খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান। আন্তর্জাতিক এ প্রতিষ্ঠানগুলো পৃথিবীর অনুন্নত ও উন্নয়নশীল কোটি কোটি মানুষের মধ্যে এ ধারণা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে যে, এদের টাকা ছাড়া, এদের পরামর্শ ও বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ছাড়া এসব দেশের কোথাও কোনো বৃহৎ বা মাঝারি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করা গেল, আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সবার সঙ্গেই বাংলাদেশ সরকার ঋণচুক্তি সম্পাদন করেছিল ১০ -১২ বছর আগে। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী একটি পয়সাও বাংলাদেশকে দেওয়ার আগেই বিশ্বব্যাংক সেই ঋণচুক্তি বাতিল করে। বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পৃথিবীর কোনো দেশের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ঋণচুক্তি এভাবে বাতিল করা নজিরবিহীন ঘটনা। এর পেছনে যে কারণ বিশ্বব্যাংক দেখিয়েছে তা-ও অদ্ভুত। তারা বলেছিলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির আশঙ্কা রয়েছে বলে তারা জানতে পেরেছেন। অবাক হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প দেখি না। ‘দুর্নীতির আশঙ্কা রয়েছে’ বলে তারা জানতে পেরেছেন, কীভাবে জানতে পারলেন? খবরটির উৎস কী- এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য কোনো তদন্ত বিশ্বব্যাংক করেছে কি না- প্রশ্নগুলো অবশ্যই করা যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থাগুলোর পালের গোদা হলো বিশ্বব্যাংক। তবে সব অর্থ সংস্থাই আমেরিকার অঙ্গুলি হেলনে চলে, বিষয়টি বিশ্বের সব মহলই জানে। তাই ধরে নেওয়া যেতে পারে, বিশ্বব্যাংক আমেরিকার ইঙ্গিতেই হয়তো বা পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিল করল। এর পরের ঘটনা আরও নাটকীয়। যেই না বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তিটি বাতিল ঘোষণা করল অমনি একের পর এক অন্য সব সংস্থা, যারা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, তারাও একে একে ঋণচুক্তি বাতিল করল। প্রকৃতপক্ষে কেন সব সংস্থা মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে ঋণচুক্তিগুলো বাতিল করল তার কোনো প্রকৃত কারণ আজও জানা যায়নি। তবে বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দায়ী করে এলেও অভিযোগটির পেছনে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য আজও হাজির করতে পারেনি। তবে ড. ইউনূসের সঙ্গেও আমেরিকার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ধারণা করা যায়, মার্কিন সরকার চায়নি বাংলাদেশ সরকার পদ্মা সেতু নির্মাণ করুক, তাই তারা অর্থ সংস্থাগুলোকে বলে চুক্তিগুলো বাতিল করিয়েছে। এখানে রাজনীতির বিষয় জড়িত আছে। দীর্ঘদিনের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিপালিত মার্কিন সরকারের বৈদেশিক নীতি পর্যালোচনা করলে স্পষ্টতই দেখা যায়, মার্কিন সরকার ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো কখনো সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে এমন কোনো অর্থনৈতিক প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা বরাদ্দ করেনি বরং তারা সার্বিক চেষ্টা গ্রহণ করেছেন যাতে উন্নয়নশীল ওই দেশগুলো তাদের ওপর স্থায়ীভাবে নির্ভরশীল হয়ে থাকতে বাধ্য হয়। এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে তারা কখনো সামান্যতম দ্বিধাবোধ করেননি। এমনকি ওই দেশগুলো পরাধীন থাকাকালে তারা যখন স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন করেছে- আমেরিকা ও তার সহযোগীরা তখনই তার বিরোধিতা করেছে। উদাহরণ আমাদের চোখের সামনেই রয়েছে। চল্লিশের দশকে যখন আমরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাকিস্তানের অংশীভূত হতে বাধ্য হয়েছিলাম, তখন দেখেছি পাকিস্তানের অগণতান্ত্রিক শাসকদের সঙ্গে আমেরিকার কী গভীর সম্পর্ক। প্রকাশ্যভাবেই সব কূটনৈতিক রীতিনীতি ধুলায় মিশিয়ে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব হরণকারী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করিয়েছিল। চুক্তিগুলোর উদ্দেশ্য ছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনকে সামরিক বাহিনী ও আধুনিক অস্ত্রাদি দিয়ে ঘিরে ধরা। এতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্ব হরণ করা হয়েছিল।

আমেরিকা যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও অবৈধ হস্তক্ষেপ করত তা পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়েছিল। ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগবিরোধী হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের ভূমিধস বিজয়ের পর পূর্ববাংলা থেকে যখন সমস্বরে দাবি তোলা হলো পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার অর্ধাংশের অনেক বেশি পূর্ব বাংলার বাসিন্দা। সেই পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ ১৯৫৪-এর নির্বাচনে করুণভাবে পরাজিত হওয়ায় সমগ্র পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষের সমর্থন কেন্দ্রের মুসলীম লীগ সরকারের ওপর নেই। তাই কেন্দ্রের মুসলীম লীগ সরকারকে পদত্যাগ করে পূর্ব বাংলার নেতৃবৃন্দ নতুন নির্বাচন দিতে আহ্বান জানান। ওই আহ্বান গণতন্ত্রের সব বিধিবিধানসম্মত হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিলড্রেথ বলে উঠলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচনী ফল কোনোভাবেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রভাবিত করতে পারে না।’ উল্লেখ্য, মুসলিম লীগ বা তার নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাংলার দাবি প্রসঙ্গে কোনো কথাই বলেনি। অর্থাৎ পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকারের কোনো স্বকীয়তা ছিল না, আত্মমর্যাদাবোধ তো নয়ই। তাই আমেরিকা পাকিস্তান সরকারকে যখন যে কাতে খুশি সেই কাতে শোয়াত।

এ পরিস্থিতি সর্বাধিক ভয়াবহ হয়ে ওঠে ১৯৭১-এ বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে। তখন নিক্সনই যেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। তাঁর অঙ্গুলি হেলনেই পাকিস্তানে সরকার পরিচালিত হতো। বাঙালি অস্ত্রহাতে স্বাধীনতার জন্য যে এতটা দৃঢ়চেতা হতে পারে, তা-ও ছিল তাঁদের কল্পনাতীত। প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী, আমেরিকান অস্ত্র, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর টাকা, পেট্রোডলার সমর্থনপুষ্ট হয়ে পাকিস্তানের সামরিক সরকার তার আন্তর্জাতিক মিত্রদের সহায়তায় বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে পিষে মারতে চাইলেও বাঙালি জাতির লৌহদৃঢ় ঐক্য এবং সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক বিশ্বের সুদৃঢ় সমর্থনে শত্রুদের সব প্রচেষ্টা ঘায়েল করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল।

বাংলাদেশকে আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্ব চায়নি। চায়নি পুঁজিবাদী বিশ্বও। তবু বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে শত্রুদের চোখে কাঁটা ফুটিয়ে দিয়ে। তাই যারা সেদিনের শত্রু তারাই তো ১৯৭৫-এ এসে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে দেশটাকে পুনরায় পুরনো পাকিস্তানি ধারায় নিতে সংবিধান সংশোধন করে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বিলুপ্ত করেছে। এরপর জিয়া, এরশাদ, খালেদা থেকে শুরু করে এযাবৎ সব সরকারই বাহাত্তরের বঙ্গবন্ধু-প্রণীত সংশোধনকে পাহারা দিয়ে চলেছে- কে কার চাইতে বেশি ধর্মান্ধ সে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ফলে এগোচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা, পিছু হটছে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। তারই স্পষ্ট দৃশ্যমান দিক হলো জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম নির্ভয়ে জঙ্গিবাদী সন্ত্রাস পরিচালনা করে চলেছে, সরকার যেন তাদের হাতে বন্দি।

যা হোক, আমেরিকা আদৌ বাংলাদেশের কল্যাণকামী নয়। তাই বিশ্বব্যাংক হঠাৎ করে যখন পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশের সঙ্গে ঋণচুক্তি সম্পাদন করল এবং পর পরই যখন জাইকা, এডিবি, আইডিবি প্রভৃতি আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থাও পৃথক পৃথক ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করল বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে, তার পরপরই আমেরিকার ধমকে বিশ্বব্যাংক তাদের ঋণচুক্তি প্রত্যাহার করে নিল বাংলাদেশকে একটা ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার লক্ষ্যে।

ওই সময় যখন সবাই দিশাহারা, যখন একাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেদ ধরলেন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করবেন; তখন অন্য মাত্র দু-এক জনের মতো আমিও কলম ধরেছিলাম দুটি নিবন্ধ লিখে; বিশ্বব্যাংক বা কোনো বহিঃশক্তির ওপর ভর না করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছিলাম। মনে পড়ে তখন মন্ত্রিসভা এ প্রশ্নে কার্যত বিভক্ত, অর্থনীতিবিদরাও ভাবছিলেন বিশ্বব্যাংক ও অন্য অর্থ সংস্থাগুলোর ঋণ ছাড়া এ বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এ একই মতের অনুসারী ছিলেন সরকারি দলের অনেকেই। কিন্তু তাঁরা কেউ মুখ ফুটে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কিছু বলতে সাহস করেননি। দেখছি, এখন তাঁদের মুখে খই ফুটছে প্রধানমন্ত্রীর পদ্মা সেতু নির্মাণে সফল হওয়ার পর। অনুন্নত বিশ্বকে আজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে পারস্পরিক সহযোগিতায় নিজেদের উন্নয়ন নিশ্চিত করার সময় এসেছে। আজ সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের অস্তিত্ব নেই। তাই নির্ভরযোগ্য কোনো বিকল্প উৎসও নেই যারা আমেরিকার অস্বীকৃতির পর নিজেরা এগিয়ে এসে সহযোগিতা করবে।

আর বাংলাদেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে তার নিজস্ব লুক্কায়িত সম্পদ খনন করে বের করতে হবে। বছর তিন-চার আগে আমরা আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ভারত ও মিয়ানমারকে পরাজিত করে বঙ্গোপসাগরের বিশাল এলাকার ওপর রাষ্ট্রীয় স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করলেও সমুদ্রতীর ঘেঁষে যে বিপুল পরিমাণ তেল, গ্যাস খননের কথা ছিল তা নিজেদের প্রকৌশলীদের মাধ্যমে শুরু করা দরকার। এটি সম্ভব হলে আমরা তেল, গ্যাস আমদানি না করে বরং রপ্তানি এবং বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারব।

মানুষের যেমন রাষ্ট্রের চাহিদাও তেমন ক্রমবর্ধমান। তাই দ্রুত খনন করে তেল, গ্যাস, কয়লা, পাথর প্রভৃতি উত্তোলন করা না হলে ওই ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না। তখন আবারও ধরনা দিতে হবে বিশ্বব্যাংক, জাইকা প্রভৃতির দুয়ারে। কোনো বিবেচনায়ই সে পথে অগ্রসর হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। স্তাবকরাও তৎপর। তাই সরকারকে হুঁশিয়ারি জানাতেই হয়।

 

লেখক : সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত।

Email: [email protected]

সর্বশেষ খবর