শিরোনাম
শুক্রবার, ১৫ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

পর্যটন : এগিয়ে যাক বাংলাদেশ

আবুল কালাম আজাদ

‘বাড়ির পাশে আরশিনগর ... আমি না দেখিলাম তারে’। পর্যটন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর একটিতে পরিণত হওয়ার পেছনে লালন ফকিরের ওই গানের মরতবা অনেকখানি জড়িত। সৈয়দ মুজতবা আলীর আফগান ভৃত্যের ‘ইনহাস্ত ওয়াতানম’-এর অনুকরণে আমরা কথায় কথায় দাবি করি, এ পৃথিবীতে এত সুন্দর দেশ আর দ্বিতীয়টি নেই। কিন্তু নিজের দেশকে ঘুরেফিরে দেখেছেন এমন বাংলাদেশি শতকরা কতজন? এ সংখ্যা বোধহয় ৫ ভাগও হবে না। বাংলাদেশে পর্যটনের প্রচুর স্পট থাকা সত্ত্বেও দেশবাসীর জন্য সেগুলো যেন নিষিদ্ধ এলাকা! যেখানে দেশি মানুষের আনাগোনা নেই, সেখানে বিদেশিরা আকর্ষিত হবে কেন? পর্যটন পরিপন্থী সংস্কৃতি আমাদের দেশে বিদেশিদের আগমন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নিয়ে গেছে। পর্যটন যখন বিভিন্ন দেশের সমৃদ্ধির চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে তখন আমরা বদ্ধঘরের বাইরে অসহায়ভাবে অবস্থান করছি। দক্ষিণ এশীয় দেশের মধ্যে পর্যটনে বাংলাদেশের আয় আফগানিস্তান ছাড়া অন্য সব দেশের চেয়ে কম। মালদ্বীপ অতি ক্ষুদ্র দেশ। রাজধানী ঢাকার একটি ওয়ার্ডের জনসংখ্যার সমান মালদ্বীপের অধিবাসীরা পর্যটন খাতে আয় করে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি বৈদেশিক মুদ্রা। শ্রীলঙ্কা, ভুটান, নেপাল, ভারত ও পাকিস্তানের কথা না বলাই ভালো। বাংলাদেশে এ মুহূর্তে জাতীয় আয়ের মাত্র ৪.৪ শতাংশ আসে পর্যটন থেকে। অথচ সার্কভুক্ত কোনো কোনো দেশের জাতীয় আয়ের ৯০ শতাংশ পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। পর্যটন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ পর্যটন পরিপন্থী চেতনা। আমাদের দেশে বিদেশি পর্যটকদের দেখা হয় ভিনগ্রহের জীব হিসেবে। তাদের দিকে মানুষের শ্যেনদৃষ্টি এমনভাবে নিবদ্ধ হয়, অনেকে বাংলাদেশে ভ্রমণ করাকে বিরক্তিকর মনে করেন। রক্ষণশীল মনোভাবও পর্যটকদের বাংলাদেশ সম্পর্কে নিরুৎসাহ করে। নিরাপত্তা সংকট পর্যটনের অন্যতম বাধা। পর্যটন ক্ষেত্রগুলোয় সন্ত্রাসী ও বখাটেদের উৎপাত ওপেন সিক্রেট। পর্যটন এলাকাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের অব্যবস্থা পর্যটকদের নিরুৎসাহ করছে। দেশে মানসম্মত হোটেল ও রেস্ট হাউস না থাকাও প্রকট সমস্যা হিসেবে বিবেচিত।

বাংলাদেশে রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে উপকূলীয় এ বনভূমি ইতোমধ্যে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেয়েছে। সেন্ট মার্টিন প্রবাল দ্বীপকে সৌন্দর্যের রানি অভিহিত করা যায়। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির পাহাড়ি সৌন্দর্য সত্যিকার অর্থেই হৃদয় স্পর্শ করার মতো। নেত্রকোনায় গাড়ো পাহাড়ের পাদদেশের হাওরাঞ্চলগুলো মনকাড়া সৌন্দর্যের অধিকারী। সিলেট অঞ্চলও পর্যটকদের হৃদয় স্পর্শ করার সৌন্দর্য বুকে ধারণ করছে। বাংলাদেশে রয়েছে মুসলিম, বৌদ্ধ ও হিন্দু ঐতিহ্যের অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক স্পট।

বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ, খানজাহান আলীর দিঘি ও মাজারের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের জুড়ি নেই। এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য, কক্সবাজারের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত ও কুয়াকাটার মতো মনোরম সমুদ্রসৈকতের অধিকারীও আমরা। কুমিল্লা, বগুড়া, রাজশাহী, দিনাজপুরেও রয়েছে পর্যটনের অনেক আকর্ষণ। তার পরও আমরা পিছিয়ে পড়ছি। অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বারে তালা দিয়ে রেখেছি। পর্যটনের বাধাগুলো কিছুতেই অপসারণ করতে পারছি না। দুনিয়া যখন পর্যটনকে সম্বল করে এগিয়ে যাচ্ছে তখন আমরা সূচকের ক্ষেত্রে নিচে নেমে যাচ্ছি। আমাদের দেশের অবস্থাপন্ন যারা তারা প্রায়ই পর্যটনে ছুটে যান বিভিন্ন দেশে। কিন্তু নিজ দেশের কথা বললে অনেকেই নিরুৎসাহ হন, কারণ নিরাপত্তাহীনতা। এ সমস্যা যদ্দিন থাকবে তদ্দিন দেশি পর্যটকদেরও পর্যটনে উৎসাহী করা যাবে না। শুধু বিদেশি পর্যটকদের ওপর ভরসা করে কোনো দেশ পর্যটনের ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে পারে না। এ ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতির অভাব না থাকলেও বাস্তবায়নে যথাযথ গরজ নেই। দেশি পর্যটকদের কাছে দেশের পর্যটন স্পটগুলো উপেক্ষিত হলে সেসব জায়গায় বিদেশিরা আসবে কেন? পর্যটকদের জন্য দেশকে উন্মুক্ত করতে হলে উদার দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে হবে। একসময় চীন ও ভিয়েতনাম ছিল মার্কিনিদের জন্য নিষিদ্ধ এলাকা। পর্যটনের স্বার্থে এ দুটি দেশ গ্রহণ করেছে উদার নীতি। যা হাজার হাজার পর্যটককে এ দুটি দেশ সফরে উৎসাহিত করছে। পর্যটনের কারণেই এ দুটি দেশে ঈর্ষণীয় হারে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে। বলা হয় পর্যটন ও বিদেশি বিনিয়োগ একই মুদ্রার দুই পিঠ। পর্যটনে এসে বিদেশিরা চীন ও ভিয়েতনাম সম্পর্কে যে স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে যাচ্ছে তা পরে বিনিয়োগকারীদের সে দেশে আসতে উৎসাহিত করছে। একসময় বিদেশে মনে করা হতো বাংলাদেশ হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। বাংলাদেশে যে মানসম্মত মানবসম্পদ রয়েছে তা বিদেশিদের অজানা। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত সরকারগুলো রিলিফ আর অনুদান বাড়ানোর জন্য দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগকে বিদেশিদের কাছে ফলাও করে প্রচার করেছে। বাংলাদেশকে ভিখিরির দেশ হিসেবে পরিচিত করার চেষ্টা চালিয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরির পর এ অপধারণার ইতি ঘটেছে। দেশে বিদেশি পর্যটকের ব্যাপক আগমন ঘটলে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদেশে ইতিবাচক ধারণা জোরদার হবে। দেশের ভালো চাইলে তাই পর্যটন-উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। পর্যটনমুখী সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে হবে। পর্যটন হোক সৌভাগ্যের চাবিকাঠি- এ স্লোগান বাস্তবে রূপ দিতে সমন্বিত পদক্ষেপ এখন সময়েরই দাবি।

                লেখক : প্রাবন্ধিক।

সর্বশেষ খবর