শনিবার, ২৩ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

সংকটে যোগ্যদের সামনে আনা জরুরি

সৈয়দ বোরহান কবীর

সংকটে যোগ্যদের সামনে আনা জরুরি

দীর্ঘ এক যুগ পর সারা দেশে ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিং শুরু হয়েছে। ঢাকায় ১ ঘণ্টা। ঢাকার বাইরে কোথাও ২, কোথাও ৩-৪ ঘণ্টা। ঢাকায়ও লোডশেডিংয়ের এলাকাভিত্তিক যে সূচি দেওয়া হয়েছে তা মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। কোথাও কোথাও ২-৩ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। দীর্ঘ এক যুগে শতভাগ বিদ্যুতের দেশে লোডশেডিং মানুষ মেনে নিতে পারছে না। অর্থনীতিতেও সংকটের চেহারাটা আর গোপন থাকছে না। নয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মুখোমুখি বাংলাদেশ। একটি দেশের মুদ্রাস্ফীতি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়া মানেই খারাপ সংবাদ। এতে সীমিত আয়ের মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। ১৯ জুলাই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো মুদ্রাস্ফীতির হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, দেশে মুদ্রাস্ফীতির হার ৭.৫৬ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও সুখবর নেই। দুই বছর পর রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। প্রবাসী আয় বৃদ্ধি না হলে এবং আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে সামনে সংকট আরও বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এ সংকটের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সাধারণ মানুষের জন্য দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে।’ এজন্য শেখ হাসিনা সবাইকে মিতব্যয়ী হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।

ব্যক্তির জীবনে যেমন অযাচিত অনাকাক্সিক্ষত সংকট আসে, তেমনি একটি রাষ্ট্রও সংকটে পড়তে পারে। ব্যক্তির জীবনে সংকটের জন্য অনেক সময় যেমন ওই ব্যক্তির কোনো দায় থাকে না, তার কোনো ভূমিকা ছাড়াই তিনি আচমকা এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হন। ২০২০-২১ সালে এরকম অনেক ঘটনা আমাদের চারপাশে দেখেছি। চাকরি হারিয়ে অনেকেই অবর্ণনীয় দুর্দশায় পড়েছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশে যে সংকট, সেখানে সরকারের ভূমিকা খুব সামান্যই। এ সংকট সরকার বা জনগণের সৃষ্ট নয়। বাংলাদেশ বৈশি^ক পরিস্থিতির শিকার। রাশিয়ার ওপর মার্কিন ও পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন টালমাটাল বিশ্ব। বাংলাদেশ এর নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি। এরকম পরিস্থিতিতে সরকারের দায়িত্ব জনগণকে পাশে নেওয়া। আশ্বস্ত করা। নাগরিকদের প্রতি শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা প্রকাশ। তাদের কষ্টের সমব্যথী হওয়া। খোলামেলাভাবে বাস্তবতা জনগণের কাছে তুলে ধরাটা জরুরি। বর্তমান সরকার ১৩ বছরের বেশি দেশ পরিচালনার দায়িত্বে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা দলের নেতা-কর্মী, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী- সবাইকে এ পরিস্থিতিতে বিনয়ী, নম্র ও সংযত হওয়া দরকার। জনগণ যেন বুঝতে পারে সরকার তাদের পাশে আছে। চেষ্টা করছে।

এ ধরনের পরিস্থিতি একা কোনো সরকারের পক্ষেই মোকাবিলা সম্ভব নয়। একটা ইতিবাচক বিষয় এ বৈশি^ক বিপর্যয়ে আমি সরকারের মধ্যে লক্ষ্য করেছি। বাস্তবতা স্বীকার করে নেওয়ার বিষয়ে সরকার এখন পর্যন্ত লুকোচুরি করেনি। বরং প্রথম থেকেই বাস্তবতার আলোকে কৃচ্ছ্রসাধনের কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। জনগণকে অন্ধকারে রাখেনি। বরং জনগণকে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরেছে। কিন্তু সংকটে সংযত, বিনয়ী হওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কাউকে আন্তরিক মনে হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দায়িত্ববান ব্যক্তিরা এক ধরনের হুমকি-ধমকি দিয়ে নাগরিকদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারে যেন আগ্রহী। কোনো কোনো ব্যক্তি অপ্রাসঙ্গিক বিতর্ক সৃষ্টি করছেন। মসজিদে এসি কখন চলবে কিংবা চলবে কি না এসব নিয়ে কথা বলার দরকার কি? এ সময় এমনিতেই মানুষ অস্বস্তিতে আছে। এর মধ্যে এসব কথা বলার প্রয়োজন কি? রাত ৮টার মধ্যে দোকান বন্ধের নির্দেশ ঈদের আগেই দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে কেউ দ্বিমত পোষণ করেনি। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে বিকালের পর দোকানপাট খোলা রাখা হয় না। কেউ যদি রাত ৮টার পর দোকানপাট খোলা রাখে তা দেখার দায়িত্ব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর হুঙ্কার দেওয়ার দরকার কি? বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে প্রতিমন্ত্রী বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার হুমকি দিচ্ছেন। কেন? মানুষকে হুমকি দিয়ে ঠান্ডা করার সময় এখন নয়। এটা একটি গণতান্ত্রিক সরকারের সংস্কৃতিও হতে পারে না। অবশ্য দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের কিছু কিছু ব্যক্তি এখন যেন মুষ্টিযোদ্ধা অথবা পালোয়ান হয়ে গেছেন। যখন অর্থনৈতিক ও বিদ্যুৎ সংকটে জনগণের মধ্যে হতাশা, তখন কোনো কোনো এমপি যেন কুস্তিগিরে পরিণত হয়েছেন। একে ওকে পিটিয়ে তাঁরা আলোচনায়। কেউ পেটাচ্ছেন অধ্যক্ষকে, কেউ পেটাচ্ছেন আরেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে! ক্ষমতার দাপটে তাঁরা দিশাহারা। দেশের এ পরিস্থিতিতে জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁরা জনগণের পাশে দাঁড়াবেন। জনগণকে আশ্বস্ত করবেন। অথচ তাঁরা করছেন উল্টো। এর ফলে বদনাম হচ্ছে আওয়ামী লীগের, সরকারের। শুধু কয়েকজন সংসদ সদস্যই যে এরকম দায়িত্বহীন আচরণ করছেন তা নয়। হাতে গোনা দু-এক জন মন্ত্রী ছাড়া মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্যই ইতোমধ্যে নিজেদের অযোগ্য প্রমাণ করেছেন। এ সংকটে তাঁরা ভূমিকাহীন। কেউ গা বাঁচিয়ে চলছেন। কেউ বা দম্ভোক্তি করে জনগণের করুণার পাত্র হচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া জনগণের আস্থাভাজন আর কজন আছেন এ মন্ত্রিসভায়? এ মন্ত্রীরা কথায় কথায় প্রধানমন্ত্রীর নামে স্তুতির বন্যা বইয়ে দেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন কজন মানেন? কজন শেখ হাসিনার মতো সাধারণ মানুষকে সম্মান করে কথা বলেন? কেউ কেউ উল্টো জনগণকে খেপিয়ে তুলছেন কথায় ও কাজে। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ছাড়া এ সরকারের রাজনৈতিক চেহারাটা ফিকে। বিবর্ণ। এ কঠিন সময়ে সরকারের রাজনৈতিক অবয়বটা সামনে আনা অত্যন্ত জরুরি। যোগ্য ব্যক্তিদের দায়িত্বে আনাটা খুবই দরকার। আওয়ামী লীগ জনগণের দল। জনগণই দলটির প্রাণশক্তি। এ দলে অনেকে আছেন যাঁদের সঙ্গে জনগণের এখনো গভীর আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। করোনার সময় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। অনেকে নিজস্ব উদ্যোগে কষ্টে থাকা মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। ধান কেটে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতা-কর্মীরাই। এবারের বন্যায় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরাই বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন পরম মমতায়। লাঠিয়াল এমপি কিংবা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলা মন্ত্রীদের সঙ্গে এ আওয়ামী লীগের পার্থক্য অনেক। দুটি ধারা দুই মেরুতে। শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে মন্ত্রিসভার সদস্য আর মন্ত্রিসভার বাইরে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের একটু তুলনা করে দেখুন। কি ভীষণ পার্থক্য। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, বেগম মতিয়া চৌধুরীর মতো নেতা কি সরকারে আছেন? এই প্রবীণ, বর্ষীয়ান জাতীয় নেতাদের কথা না হয় বাদই দিলাম। জাহাঙ্গীর কবির নানক, মাহবুব-উল আলম হানিফ, বাহাউদ্দিন নাছিম কিংবা মির্জা আজমের মতো মাঠে-ময়দানে জনগণের সঙ্গে সারাক্ষণ সংযুক্ত থাকা নেতাদের কজন আছেন বর্তমান মন্ত্রিসভায়? এ মন্ত্রিসভার বেশির ভাগ সদস্য জনগণের চেহারা পড়তে পারেন না। যেমন পারেন শেখ হাসিনা। এ মন্ত্রিসভার এক বড় অংশ জনগণের ভাষায় তাদের আপন হয়ে কথা বলতে পারেন না। যেমনটি পারেন প্রধানমন্ত্রী। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেন। এ সময় তিনি যৌক্তিক কারণেই অনেক হেভিওয়েট নেতাকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেননি। তার পরও ওই মন্ত্রিসভায় ছিলেন বেগম মতিয়া চৌধুরী, প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো জাতীয়ভাবে পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। নূরুল ইসলাম নাহিদ কিংবা জাহাঙ্গীর কবির নানকের মতো পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ ওই মন্ত্রিসভাকে একটা রাজনৈতিক অবয়ব দিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এবার মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী আবার হেভিয়েটদের ফিরিয়ে আনেন। শুধু আওয়ামী লীগের নয়, ১৪ দল থেকেও রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনুর মতো বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী মন্ত্রিসভায় চমক আনেন। প্রথমবার মন্ত্রী হয়েই তাজুল ইসলাম পান স্থানীয় সরকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। জীবনে প্রথম সংসদ সদস্য হয়েই ড. আবদুল মোমেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। এ কথা স্বীকার করতেই হবে, শেখ হাসিনা নতুনদের সুযোগ দিতে চেয়েছিলেন। সম্ভবত তিনি সরকার ও দলকে আলাদা করতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু অনেকেই মন্ত্রিত্বকে দেশসেবার মহামূল্যবান সুযোগ মনে করেননি। কেউ কেউ একে ‘আলাদিনের চেরাগ’ মনে করেছেন। অনেক মনে করেছেন একটা আরাম-আয়েশের চাকরি। তাঁরা দলীয় প্রধানের দেওয়া সুযোগটার অর্থ বুঝতে পারেননি। এঁদের কেউ কেউ এত বোধশক্তিহীন যে নিজেদের অযোগ্যতাটুকুও বুঝতে পারেন না। করোনা মোকাবিলায় সীমাহীন অযোগ্যতা ও ব্যর্থতার পর কোনো মন্ত্রী যখন নিজেকে সফল দাবি করেন, তখন মানুষ হাসবে না কাঁদবে ভেবে কূল পায় না। দ্রব্যমূল্য নিয়ে যখন মন্ত্রী তাঁর অসহায়ত্বের কথা বলেন, অথচ তখনো তিনি দল, দেশ এবং নেতার চেয়ে নিজের চেয়ারটাকে মূল্যবান মনে করেন। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার যখন সিন্ডিকেটের খাঁচায় বন্দি হয় তখন কি মন্ত্রীর সরে যাওয়ার একবারও ইচ্ছা হয় না? এরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। এসব অযোগ্য মন্ত্রী এখন সরকারের জন্য বোঝা হয়ে গেছেন, তাঁরা নিজেদের অযোগ্যতার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ভাগ্যিস শেখ হাসিনা ছিলেন। যিনি সবকিছুতেই নজর রাখেন। সবকিছু দেখেন। মূলত গত সাড়ে তিন বছর শেখ হাসিনা একাই সব সামলেছেন। করোনায় ব্যর্থ মন্ত্রীকে না সরিয়ে নিজে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। বাজার নিয়ন্ত্রণেও তাঁকেই উদ্যোগ নিতে হয়েছে। খেলার মাঠ উদ্ধার থেকে শুরু করে পদ্মা সেতু- সব ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার নিরবচ্ছিন্ন পর্যবেক্ষণেই বাংলাদেশ আজকের অবস্থানে।

আমরা জানি, শেখ হাসিনা দূরদর্শী, বিচক্ষণ, অমিত সাহসী একজন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক। কিন্তু তাঁর সহযোদ্ধা দরকার, দরকার বিশ্বস্ত অনুসারী। খেলায় যেমন একজন মেসি কিংবা নেইমার সব সময় দলকে জেতাতে পারেন না, এ কথা সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দরকার হয় কিছু নিবেদিতপ্রাণ সহকর্মীর, সহযোদ্ধার। যাঁরা শেখ হাসিনার চিন্তাগুলো বাস্তবায়নে কাজ করবেন। যাঁরা তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা, দর্শন বুঝবেন। মন্ত্রীরা যখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাল মেলাতে পারছিলেন না তখন আমলারা অবলীলায় শূন্যস্থান পূরণ শুরু করেন। করোনার সময় বাস্তবতার কারণে আমলাদের ওপর নির্ভর করতে হয় সরকারপ্রধানকে। সে সময় পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য তাঁর সামনে কোনো বিকল্পও ছিল না। কিন্তু আমলারা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া কিছুই করেন না। তাঁদের সব কাজের একটা বিনিময়মূল্য আছে। করোনাকালে তাঁরা যে কাজ করেছেন তার বিনিময়ে রাষ্ট্রের প্রায় সব প্রতিষ্ঠান দখল করে নিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে তথ্য কমিশন- সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এখন আমলাতন্ত্রের দখলে। আওয়ামী লীগই সৃজনশীল অর্থনীতিবিদ ও পন্ডিতদের বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন লুৎফর রহমান সরকারের মতো সৃষ্টিশীল ব্যাংকারকে। তাঁর মেয়াদ শেষ হলে ড. ফরাসউদ্দিনের মতো প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্বকে গভর্নর করা হয়েছিল। ড. ফরাসউদ্দিন একজন আমলা ছিলেন বটে, কিন্তু একজন সাবেক আমলার চেয়ে একজন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ‘গরিবের অর্থনীতিবিদ’ ড. আতিউর রহমানের মতো ব্যতিক্রমী পন্ডিতকে গভর্নর করেছিলেন। এ প্রতিষ্ঠানও এখন আমলাদের দখলে চলে গেছে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে অর্থ সচিবদের অবসর-উত্তর ঠিকানা এখন বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় একজন সদ্য অবসরে যাওয়া আমলার চেয়ে ড. আতিউর রহমান, ড. আবুল বারকাতের মতো মেধাবী উদ্ভাবনী চিন্তার অধিকারী অর্থনীতিবিদ বেশি দরকার। নবনিযুক্ত গভর্নর নিঃসন্দেহে দক্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তা। কিন্তু দীর্ঘদিন নথির মধ্যে থাকতে থাকতে তিনি হয়তো বর্তমান সংকটের সমাধানও নথিতেই খুঁজবেন। আমলারা কোনো সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান করেন না বা করতে পারেন না। সৃজনশীলতা উপেক্ষা করেন। গৎবাঁধা রুটিনে কাজ করতে চান। এক ক্ষমতাবান আমলা বিদ্যুৎ সংকটের ‘কুইক রেন্টাল’ সমাধান আবিষ্কার করে নিজের ক্যারিয়ার তরতর করে ওপরের দিকে উঠিয়েছিলেন। এখন সেই কুইক রেন্টাল সরকারের গলার কাঁটা।

এভাবেই আমলারা ভবিষ্যতের কথা ভাবেন না। তাৎক্ষণিক সমাধান করে নিজেদের ‘দক্ষ’ প্রমাণ করতে চান। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারকে যেমন আমলাতন্ত্রের শিকল ছিঁড়ে বেরোতে হবে, তেমনি সরকারকেও রাজনীতির ধারায় ফিরিয়ে আনাটা জরুরি। প্রশ্ন উঠতেই পারে, প্রবীণ হেভিওয়েট কিংবা জনপ্রিয় নেতাদের মন্ত্রী বানালেই কি সংকটের সমাধান হবে? সংকট তো দেশে তৈরি হয়নি। মন্ত্রী বদল করে সমাধান হবে কীভাবে? সংকট সমাধান নয়, এখন প্রয়োজন জনগণকে সাহস দেওয়া। তাদের অনিশ্চয়তা দূর করা। আমলাতন্ত্রের দফাওয়ারি সুপারিশের পর ‘আতঙ্কের কোনো কারণ নেই’ ধরনের বক্তব্যে জনগণের মধ্যে স্বস্তি ফিরবে না। জনগণ বুঝতে পারে এমন ভাষায় কথা বলে জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে। জনগণের কাছে শেখ হাসিনার বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। এরকম বহু যোগ্য নেতা আওয়ামী লীগে আছেন। এঁদের ভুলত্রুটি আছে, আছে অতীত স্খলনও। কিন্তু এ সংকটে তাঁরাই হবেন যোগ্য সহযোগী। এতে মানুষ ভরসা পাবে। অযোগ্যদের ভারমুক্ত হবে জাতি। এই তো এক বছর আগের কথা। করোনা, অর্থনৈতিক সংকট, কৃষক বিদ্রোহ সব মিলিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তায় নিম্নমুখী স্রোত। এর মধ্যেই ৯ জুলাই, ২০২১-এ ১২ জন মন্ত্রীকে ছাঁটাই করে মন্ত্রিসভা রদবদল করলেন। এটা গণতান্ত্রিক একটি বহুল ব্যবহৃত কৌশল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিভিন্ন মেয়াদে এটি করেছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেও নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় তিনি হেভিওয়েট নেতাদের যুক্ত করেছিলেন। সৈয়দ আশরাফের মতো কঠিন সময়ের পরীক্ষিত নেতার দফতর বদলেও তিনি পিছপা হননি। কর্নেল (অব.) ফারুক খানকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দিয়ে প্রশংসিত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।  এরকম বহু উদাহরণ আছে শেখ হাসিনার ১৮ বছরের দেশ পরিচালনায়। এ সংকট একটা বিশ্ববাস্তবতা। এখন ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়াতে হবে মমতায়, ভালোবাসায়।  যেভাবে আওয়ামী লীগ জনগণের পাশে দাঁড়ায় সব সংকটে। এ সংকটে যোগ্যদের সামনে আনাটা এখন সময়ের দাবি।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর