শনিবার, ২৩ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

নেদারল্যান্ডসের ওয়ার্ল্ড হর্টি সেন্টার আধুনিক কৃষিচর্চার হাব

শাইখ সিরাজ

নেদারল্যান্ডসের ওয়ার্ল্ড হর্টি সেন্টার আধুনিক কৃষিচর্চার হাব

গত এপ্রিলে সুযোগ হয়েছিল নেদারল্যান্ডস ভ্রমণের। বাংলাদেশে শত বছরের বদ্বীপ পরিকল্পনার সহযোগী হিসেবে কাজ করছে এ বদ্বীপ রাষ্ট্র। তাদের ডেল্টা প্ল্যান ও কৃষিবিষয়ক জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা সম্পর্কে জানার জন্য নেদারল্যান্ডস গিয়েছিলাম বাংলাদেশে তাদের অ্যাম্বাসির আমন্ত্রণে। শেষ এপ্রিলের এক বিকালে নেদারল্যান্ডসের নাল্ডভেইকে অবস্থিত ওয়ার্ল্ড হর্টি সেন্টারে গিয়ে উপস্থিত হই আমরা। ওয়ার্ল্ড হর্টি সেন্টার মূলত কাচঘেরা এক সুন্দর স্থাপনা। প্রবেশ করতেই অভ্যর্থনা জানালেন সেন্টারের অ্যাকাউন্ট ম্যানেজার উইল জেইডারভেইক। আপাদমস্তক সৃজনশীল একজন মানুষ। পুরো ওয়ার্ল্ড হর্টি সেন্টারের সবকিছুই তাঁর আয়ত্তে। তিনি আমাদের এ বিশাল স্থাপনা ও এর কার্যক্রম সম্পর্কে বললেন। ওয়ার্ল্ড হর্টি সেন্টার হলো নলেজ অ্যান্ড ইনোভেশন সেন্টার। আন্তর্জাতিক গ্রিনহাউস মডেলের জন্য এটি বিখ্যাত। একই প্ল্যাটফরমে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষিবিষয়ক কোম্পানি ও সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে এ প্রতিষ্ঠান। উদ্যানতত্ত্ববিষয়ক গবেষণা, শিক্ষা ও ব্যবসা পরিচালনার পাশাপাশি কৃষি সমস্যার পরামর্শক হিসেবেও কাজ করছেন তারা।

উইল বললেন, ‘ওয়ার্ল্ড হর্টি সেন্টার তিনটি ভাগে বিভক্ত। এক পাশে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম, এ পাশটায় মূলত ব্যবসার দিকটা দেখা হয়। এখানে যুক্ত আছে অনেক আন্তর্জাতিক কোম্পানি। আর ওই পাশে চলছে গবেষণা। শিক্ষা, ব্যবসা ও গবেষণা সবকিছুর সঙ্গেই সরকার জড়িত আছে। ফলে সব মিলিয়ে এটাকে উদ্যানতত্ত্বের বিশ্ব হাব বলতে পারেন।’

হর্টিকালচার বিষয়ে পড়াশোনায় এ সেন্টারটি বিশেষ ভূমিকা রাখছে। সারা পৃথিবী থেকেই এখানে শিক্ষার্থীরা শিখতে আসেন। আসেন গবেষণা করতে। বর্তমানে ১ হাজার ৩০০ শিক্ষার্থী রয়েছেন। স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য উৎপাদন তাদের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ওয়ার্ল্ড হর্টি সেন্টারকে খাদ্য ও ফুলের সিলিকন ভ্যালি বলেন অনেকে। উইল আমাদের ৩৬০ ডিগ্রি মুভি দেখালেন। যেখানে আমরা জানতে পারলাম বিজ্ঞানকে কীভাবে ব্যবহার করছেন তাঁরা। টেকসই কৃষিতে বিশ্বাসী ওয়ার্ল্ড হর্টি সেন্টার। ছাদে এবং বেসমেন্টেও কৃষিকাজে তাঁরা পরামর্শ দেন। ৩৬০ ডিগ্রি মুভি দেখে বের হয়ে উইল আমাদের দেখালেন আউটডোর অর্থাৎ খোলা মাঠে গ্রিনহাউস ও ইনডোর ফার্মিংয়ের তুলনামূলক একটা চিত্র। আউটডোর অর্থাৎ মাঠের কৃষিতে প্রচুর পানির অপচয় হয়। পানিই হয়ে উঠবে ভবিষ্যৎ কৃষির মূল সংকট। তাই এ নিয়ে যথেষ্ট সচেতন তাঁরা। তাঁরা বলছেন, পানির ব্যবহার ৯০ ভাগ কমিয়েও অধিক ফলন সম্ভব। সে প্রযুক্তিও রয়েছে তাঁদের কাছে।

উইল ব্যাখ্যা করলেন, ‘আপনি যদি খোলা মাঠে চাষ করেন তবে পানি বেশি লাগবে, গ্রিনহাউসে তার চেয়ে কম আর ইনডোরে একেবারেই কম। অন্যদিকে খোলা মাঠে আপনার এনার্জি বা বিদ্যুৎ খরচ কম হবে, কারণ সূর্যের আলো পাচ্ছেন। গ্রিনহাউসে বিদ্যুৎ খরচ তুলনামূলক বাড়বে। আর ইনডোরে বড় রকমের একটা ইনভেস্ট করতে হবে এনার্জির পেছনে। তবে ইনডোরে উৎপাদনের পরিমাণ ও ফসলের মান নিয়ে কোনো সংশয় নেই। ঘরের ভিতরে চাষাবাদ বলে বাইরের প্রতিকূলতা যেমন প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা কীটপতঙ্গের প্রভাব তেমন থাকে না। এটা একেবারেই নিয়ন্ত্রিত কৃষি ব্যবস্থাপনা।’

উদাহরণস্বরূপ তুলে ধরা হয়েছে প্রতি স্কয়ার মিটারে খোলা মাঠে যেখানে উৎপাদন হয় ৬ কেজি, সেখানে গ্রিনহাউসে উৎপাদন হয় ৮০ কেজির বেশি। আর ইনডোরে উৎপাদন হয় ১০০ কেজির বেশি। তাঁদের গবেষণা বলছে, একটি লেটুস খোলা মাঠে চাষ করতে প্রয়োজন ৬০ লিটার পানি, গ্রিনহাউসে ৫ লিটার আর ইনডোরে ০.২৫ লিটার। অন্যদিকে, ১ হাজার কেজি টমেটো উৎপাদনে মাঠে কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় ১.২ কেজি, গ্রিনহাউসে ০.১ কেজি আর ইনডোরে ০.০৫ কেজি। উইলের কাছে আমার প্রশ্ন ছিল, জিরো পেস্টিসাইডে উৎপাদন সম্ভব কি না। উইল জানালেন, তাঁরা এ বিষয়ে এখনো গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। উইল আমাদের নিয়ে এলেন অদ্ভুত এক কক্ষে যেখানে নিয়ন্ত্রিত আলো, বাতাস, তাপমাত্রা এমনকি আলোর রঙের মাত্রাও প্রভাব রাখছে গাছের স্বাস্থ্য বৃদ্ধিতে। কক্ষটিতে চোখধাঁধানো গোলাপি আলোয় চাষ হচ্ছে লেটুসের মতো সবজি। উইল জানালেন, বড় বড় ফুটবল স্টেডিয়ামের মাঠের ঘাস এ উপায়ে চাষ করা হয়। শুনে বিস্মিত হলাম। পৃথিবীতে আধুনিক ফার্ম ইনস্টল করছে এ প্রতিষ্ঠান। চার শর বেশি কোম্পানি, স্টার্টআপ, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যুক্ত রয়েছে ওয়ার্ল্ড হর্টি সেন্টারের সঙ্গে। তাঁদের কার্যক্রম এত দ্রুত ছড়াচ্ছে যে প্রতি বছর পৃথিবীজুড়ে ২ হাজার ফুটবল মাঠের চেয়ে বড় জায়গায় তাঁদের কার্যক্রম প্রসারিত হচ্ছে। উইল আমাদের নিয়ে গেলেন নিচের অংশে যেখান রয়েছে নানারকম আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি। নিচের অংশটিতে মূলত কৃষি যন্ত্রপাতির সমারোহ। আধুনিক কৃষির পূর্বশর্ত আধুনিক কৃষিযন্ত্র। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আধুনিক সব কৃষিযন্ত্র রয়েছে। উইল একটি রোবট দেখিয়ে বললেন, ‘এটা এমন একটা রোবট যা আপনাকে বলে দেবে আগামী মাসে আপনার বাগানের কী পরিমাণ গোলাপ কাটার উপযোগী হবে। এ তথ্যটা কিন্তু কৃষি বিনিয়োগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এ রোবটটা আগামী সপ্তাহ বা মাসে কী পরিমাণ টমেটো হার্ভেস্ট হতে পারে তার ধারণা দেয়। এই যে ছোট ড্রোনটা দেখছেন এটা গ্রিনহাউসে স্ক্রিন করে দেখতে পারে কোথাও কোনো কীটপতঙ্গের আক্রমণ হয়েছে কি না। ফলে আপনাকে গ্রিনহাউসে কোনো মানুষ পাঠাতে হবে না। কোথায় কী হলো দেখার জন্য খুঁজে খুঁজে হয়রান হতে হয় না। ড্রোনই চিহ্নিত করে দেয় আক্রান্ত স্থান ও পরিমাণ।’

সত্যি আধুনিক বা স্মার্ট ফার্মের কথা আমরা যদি বলি, আমাদের দেশ একেবারে সূচনালগ্নে রয়েছে, আমরা আমাদের প্রতিবেদনের মাধ্যমে দু-একটি দেখিয়েছি, কিন্তু বিশ্বব্যাপী এর পরিধি বাড়ছে, ব্যাপকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। কারণ বিকল্প আসলে নেই। কৃষি এখন পুরোপুরি বাণিজ্যিক হয়ে যাচ্ছে, ফলে এখানে ইনভেস্টমেন্ট প্রয়োজন। ইনভেস্টমেন্টের প্রশ্নে আমাদের দেশের সাধারণ কৃষকের পক্ষে এটা সম্ভব নয়। ব্যবসায়িক গ্রুপ এখন আসতে শুরু করেছে এবং তারা এগিয়ে এলেই এ কাজগুলো সম্ভব হবে। আর তখন আমাদের কৃষিও পুরোপুরি বাণিজ্যিক হয়ে উঠবে।

এরপর আমরা ওটার রিসাইকেল হাবে গেলাম। যেখানে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে কীভাবে বছর ধরে ব্যবহার করা হয় তা বিস্তারিত বিশ্লেষণ করে দেখানো হলো। উইল বললেন, ‘আমাদের ১৬টি গ্রিনহাউসের পানি ও পুষ্টি ব্যবস্থাপনা এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। আপনি জানেন, প্রতিটি গ্রিনহাউসের জন্য পানি ও পুষ্টি উপকরণ প্রয়োজন। এখান থেকে পুষ্টিকণা-মিশ্রিত পানি গ্রিনহাউসে ফসলের গাছে যায়। গাছ যতটুকু প্রয়োজন গ্রহণ করে। বাকি পানি ও পুষ্টিকণা এখানে ফিরে এসে বিশ্লেষিত হয়ে পৃথকভাবে জমা হয়। কিছু পানি হয়তো খরচ হয় বাকি পানি এভাবেই রিসার্কুলেট হতে থাকে।’ কৃষিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে যত কাজকারবার, যত গবেষণা ঘুরেফিরে দেখা মিলল সবকিছুর। এরপর উইল আমাদের নিয়ে গেলেন তাঁদের গবেষণা প্লট দেখাতে। বললেন, ‘আমাদের এখানে ৩৬টি ছোট গ্রিনহাউস রয়েছে। আমরা দেখছি কীভাবে ব্যয় কমিয়ে বেশি উৎপাদন করা সম্ভব। এ গবেষণাগুলো যেমন শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে হয়, আবার অনেক গবেষণাই করছেন খ্যাতিমান গবেষকরাও। এতে সরকারি সহযোগিতা যেমন আছে, আছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণও।’

গ্রিনহাউসগুলো আকারে বেশ বড়। গ্রিনহাউসের ভিতরে গ্রিনহাউস। যেসব খরা ও উত্তপ্ত এলাকা রয়েছে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের কথাই যদি ধরি- কাতার, কুয়েত, আবুধাবিসহ সেসব অঞ্চলে কৃষিতে প্রচুর বিনিয়োগ করছে তারা। বিশেষ করে কাতারের সুলাইতিন গ্রুপকে আমরা বহু আগে দেখিয়েছি, তাদের উপযোগী করে গ্রিনহাউস, গ্রিনহাউসের ধরনটা কেমন হবে, চেহারাটা কেমন হবে তা-ও এখানে আছে। উইল একটি গ্রিনহাউসকে দেখিয়ে বললেন, ‘এটা অটোনোমাস গ্রিনহাউস। কারণ বীজ বপনের পর থেকে ওই গ্রিনহাউসে আর আপনার প্রবেশের প্রয়োজন নেই। সবকিছুই স্মার্টফোন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। শুধু হার্ভেস্টের সময় আপনি পুনরায় প্রবেশ করলেই হয়।’ আমার মনে পড়ল চীনের অ্যাগ্রো মেশিনারিজ এগ্জিবিশনে গিয়েছিলাম, তখন দেখেছি একদল খুদে শিক্ষার্থী রোবটিক হার্ভেস্টের ওপর তাদের নির্মিত যন্ত্রের প্রদর্শনী করছে। আমি উইলকে সেটা জানালাম।  তিনিও সম্মতি দিলেন যে কৃষিকাজ করতে এখন আর মানুষের প্রয়োজনই নেই। ফসল বপন থেকে শুরু করে হার্ভেস্ট অবধি সবই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে করা সম্ভব।

প্রযুক্তির কৃষি মানেই নিশ্চিত অঙ্কের কৃষি। এখানে বিনিয়োগ থেকে উৎপাদন সবই হিসাব করা। জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে আধুনিক বিশ্ব এখন পুরোপুরি ঝুঁকছে প্রযুক্তির কৃষির দিকে। আর আধুনিক কৃষিচর্চার বড় একটি হাব বলা চলে ওয়ার্ল্ড হর্টি সেন্টারকে। ওখানকার কৃষিপ্রযুক্তি নিয়ে যত গবেষণা তা সমৃদ্ধ করবে বিশ্ব কৃষিকে। আগামী কৃষিচর্চার একটি নিদর্শনও মিলতে  পারে ওয়ার্ল্ড হর্টি সেন্টার থেকে; যা আমাদের প্রযুক্তির কৃষির জন্য হতে পারে অনুসরণীয়।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর