হিন্দু, ইসলাম ও খ্রিস্ট ধর্মে নিঃসন্তান ব্যক্তিদের দত্তক নেওয়ার বিধান নিয়ে নানা আলোচনা- সমালোচনা রয়েছে। হিন্দু আইনে সরাসরি দত্তক নেওয়ার বিধান থাকলেও রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী মুসলিমরা আইনত দত্তক নিতে পারে না; কিন্তু সন্তানের অভিভাবকত্ব লাভ করতে পারে। অভিভাবকত্ব ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০-এর ৭ ধারার অধীন আদালতে আবেদন করে দত্তক নেওয়া সন্তানের অভিভাবক হতে পারে। পোষ্য সন্তান সম্পত্তির উত্তরাধিকারী না হলেও তার নামে সম্পত্তি দান, হেবা, উইল কিংবা অসিয়ত করে দিতে পারে। মনে রাখবেন, দত্তক নেওয়ার সময় মা-বাবা আর কখনো ওই শিশুর মা-বাবা হিসেবে পরিচয় প্রকাশ করতে পারবেন না, এমন শর্তে কোনো সন্তানকে একজন মুসলিম দত্তক নিতে পারেন না। কেননা ইসলাম সওয়াবের নিয়তে অসহায়ের পাশে দাঁড়াতে বলেছে, কিন্তু সন্তান দখল করা কিংবা তার প্রকৃত পরিচয় গোপন করার অনুমতি দেয়নি। এরকম শিশুদের আইনি অভিভাবকত্ব পাওয়ার পর বিদেশে নেওয়ার ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি নিতে হবে। আদালত যদি অনুমতি দেন পরবর্তীতে বাচ্চাটার পাসপোর্ট করে বিদেশে নিয়ে যেতে বাধা নেই।

খ্রিস্টধর্মেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দত্তক নেওয়ার বিধান নেই। বাংলাদেশের খ্রিস্টানরাও মুসলমানদের মতো শিশুর শুধু অভিভাবকত্ব নিতে পারে। শুধু হিন্দু আইন অনুযায়ী অন্যের দেওয়া সন্তানকে নিজের সন্তানরূপে দত্তক নেওয়ার বিধান রয়েছে। নিজের ঔরসজাত সন্তান না থাকলে অথবা সন্তান থাকলেও ধর্মীয় ক্রিয়া সম্পাদনে অযোগ্য হলে হিন্দু আইনের বিধান অনুযায়ী অন্যের সন্তানকে দত্তক নেওয়া যায়। দত্তক নেওয়ার উদ্দেশ্য দুটি- ধর্মীয় ও পার্থিব। ধর্মীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে হিন্দু পন্ডিত ও ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী ‘পুত’ নামক নরক থেকে কেউ উদ্ধার করতে পারে না। সুপুত্র বা গুণবান পুত্র ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী পিতার আত্মার উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধ, পি-দান প্রভৃতি পারলৌকিক কর্ম করলে পিতা স্বর্গে যেতে পারেন। যে ব্যক্তির পুত্র নেই তিনি এ উদ্দেশ্যে অন্যের পুত্রকে নিজের পুত্র হিসেবে দত্তক নিয়ে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারেন। এটা হচ্ছে ধর্মীয় দিক। আর পার্থিব দিক হচ্ছে নিজের বংশানুক্রম রক্ষা ও সম্পদের উত্তরাধিকারী প্রদান। রামদুলাল বনাম সুরবালা দাস্যা, ১৯৬২ সালের একটি মামলা, যা ১৪ ডিএলআর ৮১০ মামলায় বলা হয়েছে, দত্তক পারলৌকিক মুক্তি লাভ এবং জাগতিক কারণের মধ্যে রয়েছে উত্তরাধিকারী প্রতিষ্ঠা এবং দত্তক গ্রহণকারীর বংশ রক্ষা।

আর স্বামীর একাধিক স্ত্রী থাকলে এর মধ্যে স্বামী যদি একজনকে দত্তক গ্রহণের অনুমতি দিয়ে যান, তাহলে সেই স্ত্রী অন্য বিধবাদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই দত্তক নিতে পারেন। তবে একজন অবিবাহিত নারী দত্তক নিতে পারেন না। যেহেতু পিতৃবংশের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য পুত্র থাকা প্রয়োজন সেহেতু একমাত্র পুত্রকে দত্তক হিসেবে দান বা গ্রহণ করা উচিত নয়। তবে মাদ্রাজের প্রিভি কাউন্সিল একটি মামলায় সিদ্ধান্ত দেয় যে, একমাত্র পুত্রকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করা আইনগতভাবে অবৈধ নয়। আবার বোনের পুত্রকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। তবে সম্প্রতি উচ্চ আদালতের নজির অনুযায়ী কিছু ক্ষেত্রে বোনের পুত্রকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ বৈধ। অন্যদিকে দত্তক গ্রহীতাকে পিতার স্বজাতি ও সমগোত্রীয় হতে হবে। কায়স্থ কর্তৃক নমঃশূদ্রকে দত্তক গ্রহণ বিষয়ে অনাথবন্ধু বনাম সুধাংশু শেখর হালদার মামলার রায়ে, যা ২৮ ডিএলআর ৩১৩ মামলায় বলেছেন, বাঙালি কায়স্থ এবং নমঃশূদ্র উভয়েই শূদ্র শ্রেণিভুক্ত। কাজেই কায়স্থ কর্তৃক নমঃশূদ্রকে দত্তক গ্রহণে কোনো বাধা নেই। ওই মামলায় আরও সিদ্ধান্ত হয় যে, বাঙালি কায়স্থকে নমঃশূদ্র হিসেবে গণ্য করে সুধাংশু শেখর হালদারকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।

লেখক : আইনের শিক্ষক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক।

Email : [email protected]