রবিবার, ২৪ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

যেভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

অধ্যক্ষ জসীম উদ্দীন হায়দার চৌধুরী

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দেশের তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৬০ সালে পাকিস্তানের তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় চট্টগ্রাম বিভাগে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণার পর বিশ্ববিদ্যালয়টি নিজেদের এলাকায় পাওয়ার জন্য কুমিল্লা, সিলেট ও নোয়াখালীর মধ্যে শুরু হয় তীব্র প্রতিযোগিতা। বিভাগীয় সদর হিসেবে চট্টগ্রামে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা থাকলেও নিজেদের পক্ষে জোরালো দাবি তুলে ধরার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম ছিল পিছিয়ে। মন্ত্রিসভায় সে সময় কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেটের প্রতিনিধিত্ব ছিল বেশি। আমলাদের মধ্যেও ছিল তাদের আধিপত্য। ফলে মনে হচ্ছিল চট্টগ্রাম নয়, কুমিল্লা, সিলেট কিংবা নোয়াখালীর কোথাও প্রতিষ্ঠিত হবে চট্টগ্রাম বিভাগের বিশ্ববিদ্যালয়। স্মর্তব্য, সে সময় আজকের বাংলাদেশে চারটি বিভাগ ছিল। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দেশ বিভাগের আগে সেই ব্রিটিশ আমলে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তৎকালীন পূর্ব বাংলায় রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয় প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে। চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কর্মপরিকল্পনা যখন ঘোষণা দেওয়া হয় তখন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন আশরাফ উদ্দিন আহমদ। যিনি ছিলেন কুমিল্লার অধিবাসী। চট্টগ্রামের বাসিন্দার মধ্যে মন্ত্রী ছিলেন তখন মাত্র দুজন। একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ানহাটের সুলতান আহমদ ও রাঙামাটির চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের পত্নী বিনীতা রায়। এ দুজনের কেউই প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ছিলেন না। প্রতিদ্বন্দ্বী বৃহত্তর তিন জেলা কুমিল্লা, সিলেট ও নোয়াখালীতে মন্ত্রীর সংখ্যা ছিল বেশি এবং তাঁরা ছিলেন প্রভাবশালী। সিএসপি অর্থাৎ কেন্দ্রীয় আমলাদের মধ্যেও ছিল ওই তিন জেলার প্রাধান্য। চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কেউ দাবি জানালেও এ দাবিতে কোনো সুসংবদ্ধ আন্দোলন ছিল না। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় চট্টগ্রামবাসীর নিস্পৃহ ভূমিকায় আমি ব্যক্তিগতভাবে ছিলাম হতাশ। এ হতাশা ঝেড়ে ফেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার পরিকল্পনা করি। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। আতাউর রহমান খান কায়সার ছিলেন একই বিভাগের অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। সে সময় সরকারি দল কনভেনশন মুসলিম লীগ সমর্থক ছাত্র সংগঠনের নাম ছিল এনএসএফ। আতাউর রহমান খান কায়সার ছিলেন এনএসএফের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি। তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার প্রখ্যাত জমিদার ও মুসলিম লীগ নেতা মরহুম এয়ার আলী খানের জ্যেষ্ঠ পুত্র। সিদ্ধান্ত নিই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হবে আতাউর রহমান খান কায়সারের নেতৃত্বে। কারণটি স্পষ্ট। প্রথমত, কায়সার ভাই ছিলেন এনএসএফের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সভাপতি। সেহেতু তৎকালীন সরকারের ওপর তাঁর প্রভাব ছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় এমন নেতৃত্বের প্রয়োজন ছিল। এ উদ্দেশ্য নিয়েই আমি কায়সার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি তখন থাকতেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সামনের দক্ষিণ-পশ্চিম ব্লকের দোতলার একটি কক্ষে। তাঁকে জানাই আমরা তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলতে চাই। সমাবেশের মাধ্যমে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় দুজনের বৈঠকে। ১৯৬৩ সালের ২৪ জানুয়ারি বিকালে এ উদ্দেশে সমাবেশ ডাকা হয় বর্তমান ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ হলের উত্তর দিকের দোতলা দালানের দোতলায়। সে সমাবেশে কক্সবাজারের এমএলএ গিয়াসউদ্দিন আহমদ চৌধুরী, হাটহাজারীর এমএলএ আবুল খায়ের চৌধুরী, চান্দগাঁও-বোয়ালখালীর এমএলএ শারাফতুল্লাহ যোগ দেন এবং চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবির প্রতি জোরালো সমর্থন জানান। প্রাদেশিক পরিষদের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা উপস্থিত থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েও সমাবেশে থাকেননি। আতাউর রহমান কায়সার ভাই সমাবেশে থাকবেন এটি ছিল নিশ্চিত। কিন্তু যে কারণেই হোক সেদিন তিনি সময়মতো হাজির হতে পারেননি। ফলে সভায় আমাকে সভাপতিত্ব করতে হয়। আমাকে আহ্বায়ক করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। সভায় আমি যখন সভাপতির সমাপনী বক্তব্য দিচ্ছিলাম ঠিক তখনই হাজির হন কায়সার ভাই। তাঁকে কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক হওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি সম্মতি দেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন সংগ্রাম কমিটির তালিকা নিচে তুলে ধরা হলো- জসীম উদ্দীন হায়দার চৌধুরী আহ্বায়ক, আতাউর রহমান খান কায়সার যুগ্ম আহ্বায়ক, ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক, মোহাম্মদ ইদ্রিস চৌধুরী যুগ্মসাধারণ সম্পাদক, আবুল ফজল চৌধুরী সাংগঠনিক সম্পাদক, মোহাম্মদ হোসেন খান প্রচার সম্পাদক, এ কে এম সামসুল ইসলাম কোষাধ্যক্ষ। সদস্য ছিলেন মোহাম্মদ নুরুল হুদা, জিয়াউদ্দীন মাহমুদ, এ কে এম বজলুল করিম চৌধুরী, বাদল বরণ বড়ুয়া, আমিনুল ইসলাম বেদু ও আহমদ ছফা। কমিটির খবর পরদিনের প্রতিটি দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হয়। দৈনিক আজাদ, ইত্তেফাক, সংবাদ, মিল্লাত, মর্নিং নিউজ, পাকিস্তান অবজারভারে তা গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়। কমিটির সদস্যরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে ব্যাপক প্রচার চালান। আতাউর রহমান খান কায়সারের নেতৃত্বে আমরা মন্ত্রী সুলতান আহমদ, বিনীতা রায়, হাই কোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের কৃতী সন্তান ইনাম হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এ কে খান ও এ কে এম ফজলুল কাদের চৌধুরী চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়নে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে প্রভাবিত করার আশ্বাস দেন। ১৯৬৩ সালের ১০ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় নিখিল পাকিস্তান আইনজীবী সম্মেলন। সম্মেলন উদ্বোধন করেন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান। সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা তাঁর কাছে স্মারকলিপি পেশ করেন সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন তাঁরা পরে জাতীয় জীবনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। আতাউর রহমান খান কায়সার ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি তাঁর নির্বাচনী পোস্টারে গর্বের সঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক পরিচিতিটি উল্লেখ করেন। কমিটির সর্বশেষ নাম আহমদ ছফা দেশের বুদ্ধিবৃত্তির জগতে এক প্রাতঃস্মরণীয় নাম।

                লেখক : শিক্ষাবিদ।

সর্বশেষ খবর