বৃহস্পতিবার, ২৮ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

মমতার সততা ধরা খেল পার্থে

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

মমতার সততা ধরা খেল পার্থে

চার বছর ধরে বাংলাদেশ প্রতিদিন নরেন্দ্র মোদি ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোপন আঁতাত নিয়ে একাধিকবার নানা তথ্যসমৃদ্ধ লেখা প্রকাশ করেছে। চার বছর পর ঝুড়ি থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে ভারত সরকারের নানা দুর্নীতি নিয়ে যখন প্রকাশ্যে বিরোধী দলগুলো হইচই শুরু করেছে, তখন মমতা পাশ কাটিয়ে মোদিকে সমচিত্র করেছেন। বিজেপির দাবি, মমতাই একমাত্র নেত্রী যিনি ১৯৯৭ সালে বিজেপিকে প্রথম ক্ষমতায় আনেন। তার ২৫ বছর পর বিজেপিবিরোধী দলগুলো যখন জোট বেঁধে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রার্থী বাছাই করছে, তখন মমতাকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি সে বৈঠকে যাননি। তিনি ঘোষণা করেছেন, উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নিজে এবং তাঁর দল ভোটদান থেকে বিরত থাকবে।

এ সিদ্ধান্তের একটা নেপথ্য কারণ আছে। এবার দেখা যাক কারণটা কী? কারণটা হলো বিজেপি প্রার্থী যাতে উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হন। সেজন্য তৃণমূল ভোটদানে বিরত থাকবে। এ ডিলের উদ্যোগ হলেও প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে আসামের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা দার্জিলিং এসে সমঝোতায় উপনীত হন। বিজেপির প্রার্থী হলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়। যাঁর সঙ্গে চার বছর ধরে মমতার সরকার সকাল-বিকাল ঝগড়া করেছে। সেই ঝগড়া যে জগড়ানো ছিল, আজ তা পরিষ্কার। ভোটদানে বিরত থাকার কথা মমতা নিজে না বলে তাঁর ভাইপোকে দিয়ে বলিয়েছেন। ভাইপো নোংরা ভাষায় কংগ্রেস, বিশেষ করে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী ও তাঁর ছেলে রাহুল গান্ধীর সমালোচনা করেছেন। তৃণমূলের আক্রমণের জবাব দিতে গিয়ে কংগ্রেস মুখপাত্র পবন খেরু ২৫ বছর ধরে তৃণমূল যে বিজেপিকে পরোক্ষ মদদ জুগিয়ে আসছে তা ফাঁস করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় এবং গোয়ায় তৃণমূল পোস্টার দিয়েছে- অভিষেক নাও কংগ্রেস হঠাও। এটা যে বিজেপি-আরএসএসের রাজনৈতিক লাইন তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। মমতা বা তাঁর পরিবার থেকে যখন ফেরার মধ্যে কোথাও প্রতিবাদ করা হয়নি।

মমতা যে ‘সাতবার প্রতীক’ বলে দাবি করে আসছিলেন, তখন দেখা যাচ্ছে আসলে তা দুর্নীতির পাহাড়। তৃণমূলের জন্মের দিন থেকে মমতার একমাত্র ঘনিষ্ঠ শিক্ষা ও শিল্প মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় (যিনি বাংলাদেশেরও বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর বন্ধু) দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার হয়েছেন। শুধু গ্রেফতার নয়, তাঁর বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায় বাড়ি তল্লাশি করে ভারতের ডাইরেক্টরেট এ লেখা পর্যন্ত ২১ কোটি রুপি বাজেয়াপ্ত করেছে। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পাশাপাশি তাঁর ওই বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায় এবং আপ্ত সহায়ককে গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযান শুরুর দুই দিন ধরে ওই বিপুল পরিমাণ টাকা গোনা হয়। টাকা গোনার জন্য ব্যাংক থেকে মেশিন ও ট্রাক ভর্তি করে খালি ট্রাঙ্ক নিয়ে আসা হয়।

পার্থ রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির ডান হাত হিসেবে পরিচিত। একসময় শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন।

কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন তদন্ত সংস্থাটি এক বিবৃতিতে জানায়, ‘উদ্ধার হওয়া এ অর্থের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির সম্পর্ক থাকতে পারে। শুক্রবার আটকের পর টানা ২৭ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় পার্থকে। এরপর শনিবার তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। খবরে বলা হয়েছে, আটকের পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন দোর্দ--প্রতাপশালী পার্থ চ্যাটার্জি। তবে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি সহযোগিতা করছেন। গ্রেফতার হওয়ার পর তিনি বারবারই বলেছেন, সমস্ত শেষ! তাঁর মানসম্মান (রেপুটেশন) সমস্ত নষ্ট হয়ে গেল। গ্রেফতার হওয়া পর্যন্ত পার্থর মধ্যে তেমন কোনো অসুস্থতা দেখা যায়নি। খবর আনন্দবাজার অনলাইনের।

শুক্রবার সকাল ৭টা নাগাদ পার্থর নাকতলার বাড়িতে গিয়েছিলেন ইডির কর্মকর্তারা। প্রাথমিক জেরার পর সেখান থেকে চলে আসছিলেন। এরপর একটি দলিল তাঁদের নজরে আসে। ওই দলিলেই অর্পিতার বাড়িতে কাঁড়ি কাঁড়ি রুপি থাকার ইঙ্গিত মেলে। এরপর অর্পিতার বাড়িতে যান তাঁরা। অভিযানের পর তাঁকেও আটক করে ইডি। পার্থ চ্যাটার্জি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশনের সরকার পরিচালিত স্কুলগুলোয় অবৈধ নিয়োগ নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল।

ইডির এক সূত্র জানিয়েছেন, শুক্রবার পার্থর বান্ধবী অর্পিতার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে বিপুল অর্থ উদ্ধার করা হয়। সঙ্গে অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রীও। পার্থর আরেক সহযোগী মোনালিসা দাসের বাড়ি থেকেও উদ্ধার হয়েছে আবাসনের দলিলপত্র। প্রভাবশালী নেতা পার্থ চ্যাটার্জির দুর্নীতির খবর প্রকাশ্যে আসার পর রাজ্য রাজনীতিতে তৃণমূল কংগ্রেস অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারে বলে খবরে আভাস দেওয়া হয়েছে। তবে তৃণমূল এ অভিযানকে রাজনৈতিক বিরোধীদের হয়রানি করতে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের ‘চাল’ বলে অভিহিত করেছে।

রাজ্যের পরিবহনমন্ত্রী ও কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, ‘দেশজুড়ে শহীদ দিবস উপলক্ষে বর্ণাঢ্য সমাবেশের এক দিন পর ইডির এ অভিযান তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের হয়রানি ও ভয় দেখানোর চেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়।’ অর্পিতার বাড়ি থেকে ২০টি মোবাইল ফোনও জব্দ করা হয়েছে। এসব ফোন কী কাজে ব্যবহার করা হতো, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

পার্থ চ্যাটার্জিসহ অন্তত ১৪ নেতার বাড়িতে শুক্রবার অভিযান চালায় ইডি। বিজেপির অভিযোগ, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রাথমিক, উচ্চপ্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র কুনাল ঘোষ সামাজিক মাধ্যমে লেখেন, ইডি যে টাকা উদ্ধার করেছে তার সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের কোনো সম্পর্ক নেই। কেন দলের নাম জড়িয়ে এ প্রচার চালানো হচ্ছে, দল তা নজরে রাখছে, যথাসময়ে এ বিষয়ে দল তার বক্তব্য জানাবে।

মডেলিংয়ের পাশাপাশি তামিল ও টালিগঞ্জের চলচ্চিত্রেও কাজ করেন অর্পিতা। ইডির অভিযানে তাঁর বাড়িতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাওয়া গেছে তার উৎস সম্পর্কে তদন্তকারীদের প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

মাস দেড়েক আগে দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার কলকাতায় সাক্ষাৎকারে এসেছিলেন। তিনি কলকাতায় মমতার দুই বিশস্ত সহযোগী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও ববি হাকিমের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি দুই নেতাকে বঙ্গবন্ধুর ছবি দেওয়া চটের ব্যাগ উপহার দিয়েছিলেন। অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালানোর সময় ইডি কর্মকর্তারা সেই চটের ব্যাগ খুঁজে পান। সেই ব্যাগে ছিল ভারতীয় মুদ্রায় লাখ টাকার ডলার। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, টিভির পর্দায় ওই ব্যাগ দেখে শুধু পার্থ চট্টোপাধ্যায়ই নন, রাজ্যের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। এ প্রশ্ন ইডিরও, বাংলাদেশ থেকে ব্যাগ উপহার দেওয়া হলো পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। সে ব্যাগ তাঁর বান্ধবীর ফ্ল্যাটে গেল কেমন করে? আর তাতে অত ডলারই বা এলো কীভাবে। তদন্তকারী সংস্থাগুলো তো বটেই, চোখ কপালে উঠে গেছে পশ্চিমবঙ্গের অধ্যাপক, শিক্ষক থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক জগতের ব্যক্তিত্বদেরও। তাঁদের সরাসরি প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধুর ছবি দেওয়া শতবর্ষ উদ্যাপনের সেই উপহার ব্যাগ পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবীর হাতে কী করে গেল?

এ টাকার পাহাড় নিয়ে তৃণমূল নিজেদের আলাদা করে নিতে চাইছে। ওই দলের তরফ থেকে বলা হয়েছে, যার বাড়িতে টাকা পাওয়া গেছে, তিনি সামলাবেন। এর সঙ্গে তৃণমূলের কোনো যোগ নেই। অর্থাৎ এক কথায় তৃণমূলের অন্যতম জন্মদাতা এবং তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দায় অস্বীকার করে নিজেদের দোষ ঢাকতে চাচ্ছেন মমতা।

                লেখক : ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর