বৃহস্পতিবার, ৪ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

একটি সংকলিত দুঃখগাথা : কপট অকপট সমাচার

ওয়াহিদা আক্তার

একটি সংকলিত দুঃখগাথা : কপট অকপট সমাচার

‘মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে আমি নিজে যা জানি অথবা অন্য সব যোদ্ধার সঙ্গে আলোচনা করে নতুন যা কিছু জানতে পেরেছি তার ওপর ভিত্তি করেই A Tale of Millions (লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে) রচনা করেছি।’ লেখক রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম কৃতজ্ঞতা স্বীকারে উক্ত কথাগুলো বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন, ‘স্বাধীনতার যুদ্ধ কোনো সামরিক অভিযান নয়, স্বাধীনতার যুদ্ধ জনগণের যুদ্ধ।’ স্বাধীনতাযুদ্ধের সঠিক মূল্যায়ন ও পরিমাপ করতে হলে আমাদের লাখো কোটি মানুষের স্বাধীনতার চেতনার উৎসে যেতে হবে। অনুধাবন করতে হবে সেই সব মানুষের। মুক্তির স্বপ্ন যা যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় সযতেœ লালিত এবং বাহিত হয়ে চলেছে মহান বিজয়ের পথে। অবিস্মরণীয় ত্যাগ আর তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে। ভূমিকায় লেখক লিখেছেন, ‘আমরা ২৫ মার্চ রাত ৮টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার তিন ঘণ্টা পরেও অবশ্য কিছু বাঙালি সামরিক অফিসার পাকিস্তানিদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করে চলেছিলেন একযোগে এবং চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গরকৃত সমুদ্রগামী মালবাহী জাহাজ এমভি সোয়াত থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নামিয়ে আনার কাজ বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করে যাচ্ছিলেন। পাকিস্তানিরা পরে এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদই ব্যবহার করেছিল লক্ষ লক্ষ বাঙালি হত্যায়। তবে উল্লেখিত বাঙালি সামরিক অফিসারগণ নিতান্তই সৌভাগ্যবান যে, কঠিন সংকটের ঠিক ক্রান্তিলগ্নে পাকিস্তানিরা তাদের হত্যা করতে পারে এ কথা চিন্তা করে তাঁরা আমাদের সঙ্গে যোগ দেন।’ স্বতঃস্ফূর্ততা নয়, সার্বিক অবস্থা এবং স্বীয় নিরাপত্তার বিবেচনাই তাঁদেরকে শেষ মুহূর্তে যোগ দিতে বাধ্য করে। এসব বিবেচনায় তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের কয়েকটি সুস্পষ্ট দলে ভাগ করা যায়।

১. স্বাধীনতার চেতনায় অনুপ্রাণিত এবং আক্রান্ত হওয়ার আগেই পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ করার মানসিক ও দৈহিক প্রস্তুতি ছিল এমন নিবেদিত ব্যক্তিগণ প্রথম পর্যায়ভুক্ত। তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রথম অবস্থাতেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ২. দ্বিতীয় দলটিও স্বাধীনতার চেতনায় অনুপ্রাণিত ছিল। কিন্তু তারা পাকিস্তানিদের প্রাথমিক আক্রমণের ব্যাপারে ততখানি সজাগ এবং প্রস্তুত ছিলেন না। তবুও যে মুহূর্তে এটা তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে শুধু চাকরি নয়, তাদের জীবনও বিপন্ন; তখনই তারা পাকিস্তানি শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন।

প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে দেশবাসী যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে জনযুদ্ধের রূপরেখা পেয়ে যায়। আজকের এই লেখায় আমি এই বইয়ের ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য হুবহু তুলে ধরার চেষ্টা করেছি- ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের রাত। টেলিফোনে দুটি গোপন মেসেজ পাঠানো হয় হালিশহরস্থ ইপিআর হেড কোয়ার্টারে। গোপন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দুটো মেসেজই ইপিআর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে উত্তরে শুভপুর থেকে দক্ষিণে টেকনাফ পর্যন্ত সব ইপিআর পোর্টে পাঠানো হয়। প্রথম মেসেজটি ছিল, ‘আমার জন্য কিছু কাঠের ব্যবস্থা কর’ এবং সেই সঙ্গে দ্বিতীয় মেসেজটি ছিল ‘আমার জন্য কিছু কাঠ নিয়ে আস’। দুটি মেসেজই রুটিন ধরনের বিধায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের সন্দেহ করার মতো কিছুই ছিল না মেসেজে। মেসেজ দুটি পাঠিয়ে অজানা আশঙ্কায় বিদ্রোহের আবেগে শিহরিত লেখকের চিন্তায় ছেদ পড়ে দুজন বাঙালি সামরিক অফিসার লে. কর্নেল এস আর চৌধুরী ও মেজর জিয়াউর রহমান ট্যাক্সিযোগে আসায়। মেসেজ দুটিতে ছিল বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের বিদ্রোহের ইঙ্গিত।

তাদের কথোপকথন ছিল এমন, ‘এই মুহূর্তে তোমার এ ধরনের কিছু করা উচিত নয়। কেন এর উত্তরে কর্নেল বলেন, বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে আমাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানিরা মারাত্মক কোনো ব্যবস্থা নেবে না। এমন বিশ্বাসে লে. কর্নেল ও মেজর সাহেব সংযত হতে বললেন। আমি বললাম আমাদের এখন সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করার সময় এসেছে, ওরা আমাদের আঘাত করার আগেই আমাদের আঘাত করতে হবে। এটা হতে হবে এখনই এই মুহূর্তে, না হলে আর কোনো দিনই পারব না। আমরা যদি আগে আঘাত করতে ব্যর্থ হই, তাহলে ওরা আমাদের হত্যা করবে। এক ভয়াবহ গণহত্যা শুরু করার জন্য ওরা প্রস্তুত হয়ে আছে। অতখানি আশঙ্কা করার কিছু নেই, ওরা অমন চরম ব্যবস্থা নেবে না, মেজর বললেন। লে. কর্নেল বললেন, আমিও তাই মনে করি, তুমি তোমার লোকজনকে এই মুহূর্তে কোনো সামরিক কার্যক্রম শুরু করা থেকে বিরত রাখ।’ (পৃ.-২৯)।

‘অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি আবার সেই টেলিফোনে হালিশহরে ইপিআর সৈন্যদের আমার দেওয়া দ্বিতীয় মেসেজটি বাতিল করার নির্দেশ দিলাম। আমার লোকজনকে বললাম, এই বাতিল আদেশ সাময়িক। আমার প্রথম মেসেজটি কিন্তু আমি বাতিল না করে অপরিবর্তিত রাখলাম। ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে এদের বিশ্বাস করে আপনারা কি ভুল করছেন না! আমি আবার লে. কর্নেল ও মেজরকে বুঝাবার চেষ্টা করলাম, ওরা তো আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। তা সত্ত্বেও তুমি যে চরম ব্যবস্থার প্রস্তুতি নিয়েছ শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়ে এমন একটা ব্যবস্থা নেওয়া যায় না লে. কর্নেল বললেন। কিন্তু যদি একটু বুঝেসুঝে এই ঝুঁকিটুকু আমরা না নেই, তাহলে হয়তো এর চেয়েও বড় বিপদ ডেকে আনব। তাদের দুরভিসন্ধি সম্পর্কে আমাদের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। কেন তারা বাঙালি ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে বদলি করে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে এনেছে। কেন তারা ‘জেটিতে’ বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা করছে, কেন সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ নামাতেই হবে? তাদের শত্রু কোথায়, সেটা কি আমরা নই? আপনারা কি মনে করেন, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রত্যেক রাতে বিমানে করে ওরা অন্য কিছু নয় স্রেফ কমলা আর মালটা আনছে! কিছুটা বিদ্রƒপের সুরেই কথাগুলো তিনি বলেন। এ দুজন অফিসার সশস্ত্র যুদ্ধের পথ থেকে সরিয়ে আনতে চাইছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে এরা বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। সেজন্য তাঁরা দুজনে চরম ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে ছিলেন না। দু’জন অফিসারই সব দিক সামলে এবং বেশ হিসাব করেই পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে চাইছিলেন। লে. কর্নেল তাঁর কাঁধে হাত রেখে বলেন, ‘রফিক, তুমি তো জানো কি কারণে আমরা সতর্কতার সঙ্গে চলতে চাইছি। তুমি তোমার ইপিআর সৈন্যদের নিয়ে যেভাবে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে চাও তা তোমার একার জন্যই বিপজ্জনক নয়, বরঞ্চ বাঙালি অফিসারদের সেনাবাহিনীতে চাকরির ভবিষ্যৎ সংকটময় করে তুলবে। “আমি বিজয়ী হব। চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সৈন্য সংখ্যা মাত্র শ’তিনেকের মতো। আমার অধীনে ইপিআর এ পনেরোশ’ বাঙালি সৈন্য আছে”। তা সত্ত্বেও সংযত হওয়ার পরামর্শ দিয়ে সব ঠিক হয়ে যাবে বললেন। তখন মেজর তাদের অনুপস্থিতি সন্দেহ সৃষ্টি করবে মনে করিয়ে দিলে তাঁরা দুজন দ্রুত প্রস্থান করেন। এখন থেকে আমি সম্পূর্ণ একা সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার ইপিআরের সৈন্যদের সহায়তায় কিছু করে যাব, জনগণ আমাদের সঙ্গে নিশ্চয়ই সংগ্রামে অবতীর্ণ হবেন, আমি স্বগতোক্তি করলাম। তখনো রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে পোর্ট এলাকা থেকে রাইফেল ও গুলির আওয়াজ আসছিল। তখনো কানে বাজছিল তাদের দু’জনার আশ্বাস বাণী, ‘তারা কোনো চরম ব্যবস্থা নেবে না। পৃথিবীতে এমন কোনো জঘন্য কাজ নেই যা এরা করতে পারে না। তিনি তাঁর ডায়েরিতে লিখলেন পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রথমে আঘাত না হানার এই ব্যর্থতার দায়িত্ব ওরা কোনো দিনই এড়াতে পারবে না। ওরা বলতে ওই দুই জন অফিসারকে বোঝানো হয়েছে।

নিয়তির কি বিধান ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ এর রাত। সেই দু’জন অফিসারের একজন লে. কর্নেল এম আর চৌধুরীকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বন্দী করল। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের যে বিশ্বাস করেছিলেন ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে সেই বিশ্বাসের জবাব দিল। আর অফিসার দ্বয়ের অন্যজন, মেজর জিয়াউর রহমান, রাত সাড়ে ১১টায় যাচ্ছিলেন চট্টগ্রাম পোর্টে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র গোলাবারুদ নামিয়ে ক্যান্টনমেন্টে আনার কাজে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাহায্য করার জন্য (পৃ.৩১)।

২৬ মার্চ ভোর ৪টার দিকে টেলিফোনে মেসেজ পেলাম যে, পাকিস্তানি সেনাদের ৮০-১০০ সারির বড় একটা কনভয় কুমিল্লা ছেড়ে চট্টগ্রামের দিকে রওনা দিয়েছে। সাহসী সৈনিকেরা পাকিস্তানিদের যে কনভয়টি কুমিল্লা থেকে আসছিল এরা সবাই ২৬ মার্চ সকাল ৩টার দিকে কুমিল্লা থেকে ১০০ মাইল দূরে চট্টগ্রামের পথে অনেকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিজ, কালভার্ট অতিক্রম করে এগুচ্ছিল। পাকিস্তানি সৈন্যদের চলাচলে বাধা সৃষ্টির জন্য স্থানীয় জনগণ এই কালভার্ট ও ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত করে রেখেছিল। ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি ও তাঁর সৈন্যদল চট্টগ্রাম থেকে ১২ মাইল দূরে কুমিরায় পৌঁছে যায়। ইপিআর সৈন্যরা পূর্বেই সেখানে অ্যামবুশে অপেক্ষায় ছিল। কুমিরার অ্যামবুশে পাকিস্তানিদের অনেক যানবাহন ধ্বংস হয় এবং ৭০ জনের অধিক হতাহত হয়। পাকিস্তানিরা ২৪ এফ, এফ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার এবং ১০ জন সৈন্য ঘটনাস্থলেই নিহত ও অনেকে আহত হয়। পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের দিকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায় ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি (পৃ:-১৪৯)। আমাদেরও ১৪ জন সৈন্য হতাহত হয়।

পাকিস্তানি সামরিক অফিসাররা জরুরি ভিত্তিতে বিমানে সৈন্য পাঠানোর অনুরোধ করছিল এবং হতাহতদের জরুরি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থার অনুরোধ করছিল। ওয়্যারলেসে পাঠানো কথাগুলো ইন্টারপ্টেড হয়ে যায়। আমাদেরও প্রয়োজন ছিল অধিক সৈন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ। কুমিরায় আমাদেরও বেশ হতাহত হয়েছিল। আমরা তখন ইপিআরের সেই সৈন্যদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, যারা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য সীমান্ত এলাকাগুলো থেকে শহরের দিকে ছুটে আসছিল (পৃ. ১৫০)।

২৬ মার্চ ভোরে ক্যাপ্টেন হারুন চট্টগ্রাম শহরের মাত্র পাঁচ মাইলের মধ্যে এসে পৌঁছে। সমস্ত পথে আসার সময় হারুনের সৈন্যরা উল্লসিত কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছিল। কিন্তু শহরের কাছাকাছি এসে তারা দেখল যে কিছু বাঙালি সৈন্য কালুরঘাট ব্রিজের দিকে চলে যাচ্ছে শহর ছেড়ে। হারুন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল কিছুক্ষণের জন্য- শত্রুরা কি তাহলে শহর পুরোপুরি দখল করে ফেলেছে। এই ভাবনা হারুনকে কিছুটা দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়। পরে হারুন দেখতে পেল যে, এই সৈন্যরা হচ্ছে ইবি আরসি এবং ৮ বেঙ্গল রেজিমেন্টের এবং কালুরঘাট ব্রিজ অতিক্রম করে ওরা পটিয়ার দিকে চলে যাচ্ছে। শহরের অবস্থা জানার জন্য হারুন চলে আসে চট্টগ্রাম শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে কালুরঘাট ব্রিজে এবং সেখানে মেজর জিয়ার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। মেজর জিয়া তখন হারুনকে কালুরঘাট ব্রিজ এলাকাতেই থাকতে বলেন। এর ফলে আমার সঙ্গে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী শহরের যুদ্ধে যোগ দেওয়া হারুনের পক্ষে আর সম্ভব হলো না (পৃ:-১৫০)।

ইপিআরের দুটি কোম্পানি নিয়ে সুবেদার মফিজ কক্সবাজার থেকে আমার সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম অভিমুখে রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু কালুরঘাট ব্রিজ ক্রস করার আগে ব্রিজের পূর্ব প্রান্তেই তাঁকে থামিয়ে দেওয়া হয় (পৃ:-১৫১)। মেজর জিয়া তাকে ইবি আরসি ও ৮ বেঙ্গলের সৈন্যদের সঙ্গে সেখানেই ডিফেন্স নিতে বলেন। সুবেদার মফিজ পরে সৈন্যদের সঙ্গে সেখানেই ডিফেন্স নেওয়া বিষয়ে আমাকে বলেছিলেন, আমি যে আপনার সঙ্গে শহরে এসে যুদ্ধে যোগ দিতে পারিনি, ওতে আমার কোনো দোষ নেই এবং আমি কোনো আদেশ অমান্য করিনি। মেজর জিয়া আমাদের ব্রিজের ওপারেই থামিয়ে দিলেন। আমি তাঁকে বললাম, আমাকে যেন শহরে এসে আপনার সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দিতে দেওয়া হয়। কারণ আমার ওপর সেটাই ছিল আপনার নির্দেশ। কিন্তু তিনি আমাকে বললেন যে, শহরে আর কেউ-ই নেই। অথচ পরে আমি দেখলাম যে আপনি তখনো শহরে যুদ্ধ করছেন।

আমরা অবশ্য তখনো শহরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি এবং শহরের বিভিন্ন অংশে বেশ সংঘর্ষ চলছিল। কিন্তু কালুরঘাট ব্রিজ এলাকায় ইপিআর এই সৈন্যদের আটকে রাখার ফলে শহরে আমাদের পজিশনগুলো প্রচ- চাপের সম্মুখীন হয়। পাকিস্তানিরা বিমানে করে প্রচুর সৈন্য নিয়ে আসছিল। ফলে শহরে এই অবস্থানগুলো টিকিয়ে রাখা আমাদের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।

আমার যে সৈন্যরা কক্সবাজার এবং কাপ্তাই এলাকা থেকে আসছিলেন তারা মেজর জিয়ার সঙ্গে রয়ে গেল কালুরঘাট ব্রিজ এলাকায়। রামগড় এলাকার সৈন্যরাও শহরে আসতে পারল না। কুমিরা সংঘর্ষে চলাচলের পথ অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় শহরে যা কিছু সৈন্য ছিল তাদের দিয়ে কোনোমতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। এর ফলে নেভাল বেইজ ও পোর্ট এলাকা দখলের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে বের হতে পাকিস্তানিদের বেগ পেতে হয়নি। কারণ আগের রাতেই তারা সেখানে ইবি আরসির ওপর আক্রমণ চালিয়ে ১০০০-এর অধিক বাঙালি সৈন্য হত্যা করে ফেলেছিল। আর ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মেজর জিয়ার নির্দেশে শহর ছেড়ে চলে যায়।

“২৬ মার্চ সকালে ড. জাফর, জনাব কায়সার এবং আওয়ামী লীগের আরও কয়েকজন আমার সৈন্যদের জন্য রেলওয়ে হিলে চা এবং রুটি নিয়ে এলেন। টেলিফোনে আমি জনাব হান্নান, জহুর আহমদ চৌধুরী এবং জনাব সিদ্দিকীকে অনুরোধ করলাম চট্টগ্রাম শহরে আমরা যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি, এই বিষয়টা জনগণকে জানাবার জন্য তাঁরা যেন রেডিওতে একটা ঘোষণার বন্দোবস্ত করেন। সেই অনুযায়ী আওয়ামী লীগ নেতারা একটি খসড়া তৈরি করেন এবং তা সংশোধন করে দিলেন ড. জাফর। এই ঘোষণা বাণীতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ থেকে নিরীহ বাঙালিদের রক্ষা করার জন্য বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন ছাড়াও বাঙালিদের যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান করা হয়। ২৬ মার্চ আনুমানিক ২:৩০টার সময় চট্টগ্রাম শহরের কয়েক মাইল বাইরে কালুরঘাট রোডস্থ চট্টগ্রাম রেডিওর ট্রান্সমিশন সেন্টার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি এম এ হান্নান এই ঘোষণা বাণীটি পাঠ করেন। পরবর্তীতে এই সেন্টারের নামকরণ করা হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের এই ট্রান্সমিটারের প্রচার ক্ষমতা ছিল খুবই সীমিত, দেশের অবশিষ্ট অংশের জনসাধারণের পক্ষে এখান থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠান পরিষ্কার শোনা সম্ভব হয়নি। অল্প ক্যাপাসিটির ট্রান্সমিটারটির প্রচারের এই সীমাবদ্ধতার কারণে ২৬ মার্চ জনাব হান্নানের প্রথম ঘোষণা, ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমানের ঘোষণা এবং ওই সময়ে অপর কয়েকজনের ঘোষণাও স্পষ্টভাবে শোনা যায়নি। এমনকি প্রথম দিকে অনেকে রেডিও কার্যকর প্রচার সীমার মধ্যে থেকেও জনাব হান্নানের প্রথম ভাষণ শুনতে পাননি। কারণ চারদিকের পরিস্থিতি এত ভীতিজনক এবং বিভ্রান্তিকর যে, চট্টগ্রাম রেডিওর বদলে বরং ঢাকা রেডিওতে কি বলা হচ্ছিল সবাই সেদিকেই মনোযোগ দিচ্ছিল বেশি এবং ঢাকা রেডিও স্টেশন খুলে সে সব শোনার চেষ্টা করছিল। রেডিওর ঘোষণার অনেক আগেই পুরো দেশজুড়ে জনগণ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। সংঘর্ষ চলছিল সর্বত্র। চট্টগ্রামে আমরা ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ৮:৪০ মিনিটে যুদ্ধ শুরু করেছিলাম। পাকিস্তানিরা অপারেশন সার্চলাইট নামে জেনোসাইড শুরু করেছিল রাত ৮:৪৫ মিনিটে। ২৬ মার্চ দেশজুড়েই পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপক প্রতিরোধ।

শত্রু পরিবেষ্টিত শিরোনামে (পৃ:১৬০) চ্যাপ্টারে তিনি লিখেছেন, শহরের উপকণ্ঠে চকবাজারে শেষ প্রান্তে দেখলাম আমার একজন সৈন্য ফিরে আসছে। কোন্ জাহান্নামে যাচ্ছ তুমি? আমি তাকে শাসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। আমি তো আপনার খোঁজেই আসছি স্যার, বিষণœ কণ্ঠে জবাব দিল সে এবং আমার আর কোনো প্রশ্নের অপেক্ষা না করে বলে চলল, আপনি আমাদের পাঠিয়েছেন ক্যান্টনমেন্টের পেছনে গিয়ে অবস্থান নিতে কিন্তু একজন অফিসার এই সৈন্যদের নিয়ে যাচ্ছে কালুরঘাটের ব্রিজের দিকে। আমি চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলাম, কে সেই অফিসার? আমি তার নাম জানি না স্যার; পরে জনাব হান্নান এবং ড. জাফরকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম আমার এই সৈন্যদেরকে মেজর জিয়া কালুরঘাটের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি তখন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ করলাম তাঁরা যেন মেজর জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং আমার সৈন্যদের ছেড়ে দিতে তাঁকে অনুরোধ জানান। এই প্রেক্ষিতে ড. জাফর, জনাব হান্নান, মি. মান্নান, কায়সার এবং আর কিছু নেতৃবৃন্দ কালুরঘাটের দিকে চলে গেলেন। গোমদন্ডী রেলওয়ে স্টেশনের কাছে তাঁরা মেজর জিয়া, ক্যাপ্টেন অলি, মেজর শওকত এবং আরও কয়েকজন বাঙালি অফিসারকে পেলেন। এই নেতৃবৃন্দ মেজর জিয়াকে অনুরোধ করলেন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে শহরে ও অন্যত্র যুদ্ধ করার জন্য যেন তিনি আমার সৈন্যদের ছেড়ে দেন। মেজর জিয়া নেতৃবৃন্দকে বললেন যে, সৈন্যদের পুনর্গঠিত করে শহরে এসে আমাদের সঙ্গে মিলিত হবেন। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ফিরে এসে আমাকে এসব কিছু অবহিত করলেন।

মেজর জিয়া এবং তার সঙ্গের অফিসাররা অবশ্য শহরের যুদ্ধে আসতে পারেননি। এদিকে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ প্রস্তুতির জন্য শহরের বাইরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যেতে পারছিলাম না। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে তখন অনুরোধ করি তাঁরা যেন কালুরঘাট ব্রিজ এলাকা থেকে যে কোনো একজন সিনিয়র বাঙালি আর্মি অফিসারকে দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে একটা বিবৃতি পাঠ করান যে, সেনাবাহিনী বাঙালি অফিসার জেওসি ও সৈন্যরা জনগণের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। সেদিন অপরাহ্ণেই তাঁরা কালুরঘাট ব্রিজের পূর্বপ্রান্তে গিয়ে দেখেন মেজর জিয়া তখনো সেখানে আছেন। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের অনুরোধে ২৭ মার্চ বিকেল বেলা মেজর জিয়া স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্রে আসেন এবং সে দিন সন্ধ্যায় তিনি সেখান থেকে বক্তৃতা দেন।

রেডিওতে তাঁর প্রথম ভাষণে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান বলে উল্লেখ করলেন, কিন্তু ঘোষণায় এ ধরনের বক্তব্য আসার কথা নয়। কথা ছিল যে, তিনি রেডিওতে ভাষণে বলবেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং বাঙালি মিলিটারি, ইপিআর ও পুলিশ জনগণের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার কোনো অধিকার সামরিক অফিসারদের নেই। সে অধিকার শুধু জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের। জিয়ার প্রথম ভাষণে এই বক্তব্যের ফলে বেশ ভুল বোঝাবুঝি এবং বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। জনাব সিদ্দিকী তৎক্ষণাৎ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেন যে এ ধরনের ঘোষণা আন্দোলনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে জনগণ এবং বিশ্বের সামনে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করবে। ফলে মুক্তিযুদ্ধ জনগণের সংগ্রাম হিসেবে হয়ে সামরিক অভ্যুত্থান রূপে চিহ্নিত হতে পারে (পৃ:-১৬১)।

রাজনৈতিকভাবে আমাদের সবার জন্য তা হবে বিরাট বিপর্যয়। ঠিক যে ধরনের ঘোষণা তাঁরা প্রচার করতে চান তার একটা খসড়া তৈরি করে মেজর জিয়ার কাছে পাঠাবার জন্য আমি জনাব সিদ্দিকীকে অনুরোধ করলাম। মেজর জিয়া যেন সেটাই রেডিওতে পড়ে শোনাতে পারেন। সেভাবেই আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ একটা খসড়া তৈরি করে মেজর জিয়ার কাছে যান এবং তাঁর ভাষণে যে ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে তা তাঁকে বুঝিয়ে বলেন। নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান ঘোষণা করা যে একটা গুরুতর ব্যাপার এবং ভুল; মেজর জিয়া তা বুঝতে পারলেন এবং নতুন করে তৈরি একটি বিবৃতি রেডিওতে পাঠ করে শোনান। এবার তাঁর ভাষণে তিনি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করলেন যে, তিনি বক্তব্য রাখছেন বাঙালি জাতির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে (পৃ:-১৬২)।

এদিকে কালুরঘাটের প্রতিরক্ষার অধিকাংশ সৈন্যই ছিল ইপিআরের। এরা আমাদের নির্দেশে কক্সবাজার এবং কাপ্তাই এলাকাগুলো থেকে শহরে যুদ্ধ করতে আসছিল। পথে কালুরঘাটে দেখা মেজর জিয়া ও অন্যদের সঙ্গে তাঁরা চলে যাচ্ছেন শহর ছেড়ে। মেজর জিয়া অন্যদেরও কালুরঘাটেই থেকে যেতে এবং অবস্থান নিতে বলেন। সব মিলিয়ে সেখানে প্রায় এক হাজার বাঙালি সৈন্যকে থেকে যেতে হয়েছিল। ‘কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর অপর পাড়ে এত সৈন্যকে শুধু পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণ করার অপেক্ষায় রেখে দেওয়ার ব্যাপারে সব রাজনৈতিক নেতা, অন্যান্য সামরিক অফিসার, সৈন্য এমনকি সাধারণ মানুষও অসন্তোষ প্রকাশ করেন। সেই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল চট্টগ্রাম শহর, ক্যান্টনমেন্ট, পোর্ট, নেভাল বেইস এবং বিমানবন্দর দখল করা। কালুরঘাটে লক্ষ্যহীনভাবে বসে এসবের কোনোটাই অর্জন সম্ভব ছিল না। অথচ পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী চট্টগ্রাম শহরের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এই সৈন্যদের অপেক্ষায় ছিলাম। আমরা পাকিস্তানিদের পরাজিত করতে পারতাম যুদ্ধের ইতিহাস হতো আরও ভিন্ন ও সাফল্যমন্ডিত। ‘অনেকেই সেদিন দেখতে পেল চট্টগ্রাম পোর্ট এলাকা, কর্ণফুলী নদীর মোহনা এবং বঙ্গোপসাগরের উপরে উড়ছে অসংখ্য শকুন। পাকিস্তানি সৈন্যরা যে বাঙালিদের পোর্টে হত্যা করে নৌবাহিনীর ‘গানবোটে করে লাশ ফেলে আসে বঙ্গোপসাগরে, সেসব হতভাগ্য বাঙালির লাশের সন্ধানে শকুনীরা সব উড়ে চলছিল সমস্ত এলাকাজুড়ে। শান্তির প্রতীক সাদা গাঙচিলগুলো সেদিন যে কোথায় চলে গেছে তা কেউই বলতে পারবে না। আক্ষেপের শেষ নেই যে, কিছু কপট মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল এবং মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে তাঁরাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকান্ডে জড়িত ছিল।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

তথ্যসূত্র : লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে

রফিকুল ইসলাম, বীরউত্তম

                লেখক : অতিরিক্ত সচিব।

সর্বশেষ খবর