রবিবার, ৭ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

সন্তান থাকুক আমার দুধে-ভাতে

মেজর (অব.) আখতার

সন্তান থাকুক আমার দুধে-ভাতে

১৮০০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্য ছিল ১ বিলিয়ন অর্থাৎ ১০০ কোটি। ১৯৫০ সালে ২.৫ বিলিয়ন তথা ২৫০ কোটি। ২০১১ সালে তা দাঁড়ায় ৭ বিলিয়ন অর্থাৎ ৭০০ কোটিতে। পরবর্তী ১০ বছরে ২০২১ সালে জনসংখ্যা হয় ৭.৯ বিলিয়ন মানে ৭৯০ কোটি। ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্য দিবসে জনসংখ্যা রীতিমতো ভয়াবহ সংখ্যা ৮০০ কোটি অর্থাৎ ৮ বিলিয়ন অতিক্রম শুরু করে। বিশ্বের জনসংখ্যা হাজার হাজার বছর ধরে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে ১৮০০ সাল পর্যন্ত ১ বিলিয়ন তথা ১০০ কোটি হয়েছিল অথচ পরবর্তী ২২২ বছরে ৮ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২ সালে ৮ বিলিয়ন তথা ৮০০ কোটি হয়ে যায়। জাতিসংঘ দুশ্চিন্তায় আছে এ কারণে যে, ২০৩০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ৮.৫ বিলিয়ন, ২০৫০ সালে ৯.৭ বিলিয়ন এবং এ শতাব্দীর শেষে তা ১১.৯ বিলিয়ন মানে ১ হাজার ১৯০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ বিশাল জনসংখ্যার চাপ মানবসভ্যতা সহ্য করতে পারবে কি না। একজন খাঁটি মুসলমান হিসেবে আমি হয়তো মনে করি আল্লাহ মুখ দিয়েছেন, আহারও দেবেন। কাজেই এ নিয়ে আমাদের ভাবনার কিছু নেই। কিন্তু জাতিসংঘ তো আল্লাহর কথায় চলে না! তারা চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে এ ক্রমহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে পৃথিবীর অস্তিত্ব বিপদের মুখে পড়তে পারে।

আগেই বলেছি, ১৮০০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল ১০০ কোটি। কিন্তু পরবর্তী ২২২ বছরে তা বৃদ্ধি পায় আরও ৭০০ কোটি। ১৯৫০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল ২৫০ কোটি কিন্তু ওই ২৫০ কোটির মধ্যে আমি ছিলাম না। কারণ আমার জন্ম ১৯৫১ সালে। বর্তমান বিশ্বে আমার সমবয়সী বা তার চেয়ে ছোট মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫৫০ কোটির কাছাকাছি। কাজেই আমি দাবি করতে পারি বিশ্বের তাবৎ মানবকুলের মধ্যে আমি একজন অতি বয়স্ক নাগরিক। কারণ ১৯৫০ সালের তৎকালীন ২৫০ কোটি মানুষের মধ্যে সিংহভাগই আর বেঁচে নেই। সেই ২৫০ কোটি বাদ দিয়েও বর্তমান জনসংখ্যা ৮০০ কোটি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এভাবে যে জনসংখ্যা বাড়ছে তার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, মানুষের গড় আয়ু বেড়ে গেছে, শিশুমৃত্যুর হার অনেক কমে গেছে এবং মাতৃত্বকালীন মৃত্যুও কমে গেছে। স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষিত হওয়ায় পৃথিবীর অনেক দেশে মানুষের গড় আয়ু দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গেছে যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ বলে আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আধুনিক বিশ্বের আগে যখন বিশ্ব অনেক দরিদ্র ছিল তখন মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩০ বছর। কিন্তু অনেক দেশে তা বেড়ে এখন ৭০ বছরের ওপরে চলে গেছে। বিশ্ব আধুনিক ও উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর সব উন্নত দেশে মানুষের আয়ু বাড়তে শুরু করে। ১৯ শতকের প্রথম দিক থেকেই অনেক উন্নত দেশে মানুষের বেঁচে থাকার বয়স বেড়ে যায়। বিশেষ করে শিল্পবিপ্লবের পর সব শিল্পোন্নত দেশে মানুষের আয়ু অনুন্নত দেশের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। এর ফলে বিশ্বে মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ-সুবিধায় ব্যাপক অসমতা সৃষ্টি করে যা অনেক অনুন্নত দেশে বেঁচে থাকার বয়সের তারতম্য তৈরি হয়। ধনী দেশগুলোয় প্রচুর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হয় পক্ষান্তরে বিশ্বের অনেক দেশের মানুষকে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে হয়। কিন্তু গত এক দশকে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবায় দারুণ পরিবর্তন হয়েছে যার ফলে মানুষের কম বয়সে মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক কমে গেছে। ১৮০০ সালের চেয়ে পৃথিবীর সব দেশেই এখন মানুষের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্যতা অনেক বেশি নিশ্চিত হয়েছে, যার ফলে সব দেশেই মানুষের গড় আয়ু বেড়ে গেছে। অতীতে যেসব দেশের মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যেত আজ সেসব দেশে অনেক উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছে। ফলে মানুষের মৃত্যুহার দিন দিন কমে যাচ্ছে। এখন মানুষের তার স্বাভাবিক জীবৎকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকার এক ধরনের নিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলা যায়। গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের জনসংখ্যাও ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে।

বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ শিশুমৃত্যু হার ব্যাপকভাবে কমে যাওয়া। বিশ্বব্যাপী যেখানে জন্মহার বেড়ে গেছে সেখানে নাটকীয়ভাবে অনেক দেশে শিশুমৃত্যু হার কমে গেছে। ১৯৯০ সালে ১২.৬ মিলিয়ন অর্থাৎ ১.২৬ কোটি শিশু মারা গিয়েছিল সেখানে ২০১৭ সালে শিশুমৃত্যু প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাপী ৫৪ লাখ শিশু মারা যায়। শিশুমৃত্যু রোধে কিছু কিছু দেশ দারুণ সফলতা দেখায়। তার মধ্যে প্রথম ভারত, যেখানে ৩.৪ মিলিয়ন থেকে শিশুমৃত্যু ১ মিলিয়নে নেমে আসে। তার পরে চীন, যেখানে শিশুমৃত্যু হার ৯ গুণ কমিয়ে ১.৪ মিলিয়ন থেকে ১ লাখ ৬০ হাজারে নামিয়ে আনে। বিশ্বব্যাপী শিশুমৃত্যু রোধে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বাংলাদেশ শিশুমৃত্যু ৫ গুণের বেশি কমিয়ে ৫ লাখের বেশি শিশুমৃত্যু থেকে ১ লাখে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়। এর পরে ইথিওপিয়া ও ব্রাজিল, যারা শিশুমৃত্যু হার কমাতে সক্ষম হয়। ইত্যাকার বিভিন্ন কারণে পৃথিবীর জনসংখ্যা বাড়ছেই। সেই সঙ্গে অনেক দেশে জনবসতির ঘনত্ব বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। অনেক ছোট দেশে মানুষের বসবাসের ঘনত্ব মানুষকে ব্যাপক ঝুঁকির সামনে নিয়ে আসছে। যেখানে পৃথিবীতে মানুষের বসবাসের প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড় ঘনত্ব মাত্র ৬১ জন, সেখানে অনেক ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রে মানুষের বসবাসের ঘনত্ব অনেক বেশি। পৃথিবীর মধ্যে মানুষের বসবাসের সবচেয়ে বেশি ঘনত্ব হলো পাঁচটি দ্বীপরাষ্ট্রে- ম্যাকাও, মোনাকো, সিঙ্গাপুর, হংকং ও জিব্রাল্টার। সিঙ্গাপুরে মানুষের বসবাসের ঘনত্ব ৮ হাজারের কাছাকাছি, যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ২০০ গুণ এবং অস্ট্রেলিয়া থেকে ২ হাজার গুণ বেশি। এর পরে বৃহৎ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ঘনত্বের বসবাসকারী দেশ। বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ২৫২ জন বাস করে যা কাছের প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়ে ৩ গুণ বেশি। বাংলাদেশের পরে লেবানন, যাদের বসবাসের ঘনত্ব হলো ৫৯৫ জন এবং তার পরে দক্ষিণ কোরিয়া ৫২৮ জন, নেদারল্যান্ডস ৫০৮ জন। জনসংখ্যার ক্রমবৃদ্ধির হার লক্ষ্য করলে আমাদের দেশে মানুষের বসবাসের ঘনত্ব যে একটি তীব্র সমস্যা নিয়ে আসছে তা বুঝতে আমাদের খুব বেশি জ্ঞানী হওয়ার দরকার নেই। আমাদের যেমন জনসংখ্যা বাড়ছে তেমন পাল্লা দিয়ে বসবাসের ঘনত্বও বাড়ছে। আমাদের রিজিকের হয়তো সমস্যা হবে না কারণ তা সম্ভবত সৃষ্টিকর্তা ব্যবস্থা করে দেবেন বা করে রেখেছেন। তবে বণ্টনে যে সমস্যা হবে তা স্থির নিশ্চিত। অবশ্য এ ব্যাপারে বেশি কথা বলা যাবে না। তাতে আমাদের অনেক বন্ধু অসন্তুষ্ট হতে পারেন। কিন্তু আমাদের রিজিকের চেয়ে বড় সমস্যা দেখা দেবে বাসস্থানের এবং বসবাসের পরিবেশের। ইতোমধ্যেই ছোট বড় শহরগুলো প্রায় পরিপূর্ণ। কোনো শহরেরই এখন আর শহরতলি নেই। বাণিজ্যিক, আবাসিক এলাকা একাকার হয়ে যাচ্ছে। গ্রামগুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ। প্রতিটি গ্রাম এখন ঘনবসতিপূর্ণ বস্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। সরকার নিজেও বসবাসের ভয়াবহ ঘনত্ব সৃষ্টি করে আবাসনের নামে বস্তি সৃষ্টি করছে। আগামী দিনে বসবাসের পরিবেশ এক ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে। সরকার অনেক মানুষ বা পরিবারকে এক জায়গায় ঘনীভূত করছে যেখানে তাদের কাজের সুযোগ নেই। কিন্তু প্রজননের সব অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে এ জনগোষ্ঠী জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

আগামী দশকে আমাদের ব্যাপক চ্যালেঞ্জ হবে বর্ধিত জনসংখ্যা। সরকার ইতোমধ্যে জনসংখ্যার প্রকৃত অবস্থা চেপে রাখার নীতি গ্রহণ করেছে। সংখ্যাগত চালাকি করে সরকার হয়তো একটি চাপিয়ে দেওয়া পরিসংখ্যানের ওপর উন্নয়নের ফোলানো-ফাঁপানো স্বস্তিকর চিত্র আঁকতে পারবে কিন্তু পরবর্তী দশকে তা বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে। আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা হয়তো ২১ কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে। বর্ধিত ৫-৬ কোটি মানুষের যে নানাবিধ চাহিদা সৃষ্টি হবে তা সামাল দেওয়া সবার জন্যই বেসামাল হয়ে যেতে পারে। সরকার বলার চেষ্টা করছে আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩০ শতাংশ। কিন্তু অনেকে মনে করেন তা ১.৫১ শতাংশের বেশি। সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১২ সালে আমাদের জনসংখ্যা ছিল ১৪.৯৮ কোটি এবং ২০০১ সালে ছিল ১৩.০৫ কোটি। ১০ বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ১.৯৩ কোটি অর্থাৎ ১৪.৭৯% ভাগ। আবার সরকারি হিসাবমতে, ২০২২ সালে জনসংখ্যা ১৬.৫২ কোটি অতিক্রম করে ফেলেছে। যার অর্থ হলো গত ১০ বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১.৫৪ কোটি। যা শতকরা হিসাবে ১০.২৮% হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার বলতে চাচ্ছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার গত দশকে নিম্নমুখী ছিল। সেজন্য সরকারকে কৃতিত্ব দিতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমাদের শঙ্কা হলো নতুন ১.৫৪ কোটি মানুষের জন্য। তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও নিরাপত্তার কী ব্যবস্থা আমরা নিতে পারছি তার অব্যাহত আগ্রহ আমাদের রয়ে যাচ্ছে।

সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বিভিন্ন কারণে অনেক কম। তাই জনগণ মনে করে দেশের বর্তমান জনসংখ্যা অনেক বেশি। যদি খোলা চোখেও দেখতে চায় কেউ তাহলে দেখতে পাবে সন্তান নেই এমন দম্পতি প্রায় শূন্যের কোঠায়। এক সন্তানের দম্পতিও খুবই নগণ্য। প্রায় সব দম্পতির দুইয়ের অধিক এবং তিন ও চার সন্তান। গ্রাম, বস্তি ও নিম্ন আয়ের দম্পতিদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা। পাঁচ ও ছয় সন্তানের দম্পতির সংখ্যাও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। কাজেই এ রকম বাস্তবতায় ১.৩০% শতাংশ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ধোপে টেকে না। তবে যে যা-ই বলুক, জনসংখ্যা বৃদ্ধি আগামীতে আমাদের অস্তিত্বের বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। অনেকে বলেন, জনসংখ্যাকে সমস্যা হিসেবে না দেখে সম্পদ হিসেবে দেখলে বর্ধিত জনসংখ্যা আমাদের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে। কিন্তু তার জন্যও আমাদের একটি জুতসই পরিকল্পনা থাকতে হবে।

আমরা সবাই আমাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অধিক সন্তান কামনা করি। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। ধনী, গরিব এমনকি বিশাল সম্পদশালী থেকে হতদরিদ্র কেউই তাদের সন্তান থেকে বৃদ্ধ বয়সে কোনো নিরাপত্তা পাচ্ছে না। বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিক কলহ-বিবাদ শুরু হয়ে যায়। মানুষের গড় আয়ু বেড়ে গেছে ফলে ৬৫ বছরের পর বিরাটসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে যাচ্ছে। জাপানের মানুষের গড় আয়ু এখন ৯৫ বছরের বেশি; ফলে কোটি কোটি জাপানিকে এখন ঘরে বসে একা একা সময় কাটাতে হচ্ছে। তাঁর পাশে কোনো আপনজনকে পাচ্ছে না। ঠিকানা খুঁজতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে! এ রকম অবস্থা এখন আমাদের দেশেও চলে আসছে। আমাদের গড় আয়ু এখন প্রায় ৭৫ বছর। ফলে বৃদ্ধরা অসহায় ও একাকী হয়ে যাচ্ছেন। আমাদের দেশেও বৃদ্ধাশ্রম তৈরি শুরু হয়ে গেছে। সন্তানরা এখন আর বাবা-মার সম্পদ থাকছে না। অনেকের কাছে সন্তানরা রীতিমতো শত্রু হিসেবে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। অধিক সন্তান আরও ভয়ংকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কোনো পরিবারেই ভাইয়ে ভাইয়ে, ভাইয়ে বোনে, বোনে বোনে মিল নেই। বেঁচে থাকার সংগ্রামে সবাই আলাদা এবং পরস্পরের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রায় সব পরিবারেই সংঘাতময় পরিবেশ। ভারতের বিশাল ধনী ধিরুভাই আম্বানির দুই ছেলে মুকেশ ও অনিলের মধ্যে সম্পদ নিয়ে সংঘাত, তাদের দুই বোন নীনা ও দীপ্তির সঙ্গেও সদ্ভাব নেই। আমাদের দেশের বড়লোক বা ধনী ব্যক্তি যারা দুই ও অধিক সন্তান রেখে গেছেন তাদের সন্তানের প্রায় সবার মধ্যেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ চলছে। গরিব ও মধ্যবিত্তের অবস্থা তো আরও ভয়াবহ। মৃত বাবা-মার সম্পদ নিয়ে হামেশাই খুন-খারাবি হচ্ছে। আর যে বাবা-মা বেঁচে আছেন তাঁদের অবস্থা আরও করুণ। সন্তানরা বিয়ে করার পর কোনো ছেলেমেয়েই বাবা-মার দায়িত্ব নিতে চায় না। তখন তারা ভাগের বাবা-মা হয়ে যায়। আজকের পারিবারিক বা সামাজিক কলহের একটি অন্যতম কারণ হলো বাবা-মার সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা। কোনো ভাই-ই বোনদের বাবা-মার সম্পত্তির ন্যায্য হিসসা দিতে চায় না। বড় ভাই ছোট ভাইবোনদের বিভিন্নভাবে বঞ্চিত করতে চায়। বাবার মৃত্যুর পর মায়ের কর্তৃত্ব মেনে নিতে চায় না আপন ছেলেমেয়ে। মায়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করে সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা করে দেওয়ার জন্য। যেখানে সবচেয়ে কম দেওয়া হয় মাকে। তার ওপর মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে অনুৎসাহ বোধ করে। অনেক সময় মা-বোনদের পক্ষ নিয়ে পারিবারিক কলহ উসকে দিতে চেষ্টা করে। সবকিছু মিলে দেখা যায় বেশি সন্তান বাবা-মার সুখের চেয়ে দুঃখের কারণ হয় বেশি। কিন্তু সন্তান যদি একটি থাকত বা যদি না-ও থাকত তাহলে শেষ জীবনে অনেক বিড়ম্বনা থেকে জীবন মুক্ত থাকত। আমরা সবাই সন্তান চাই। আমাদের ঐকান্তিক কামনা আমাদের সন্তানরা যেন দুধে-ভাতে থাকে। এটা ঠিক, অধিক সন্তান থাকলে একটা সময় পর্যন্ত জীবন খুব মধুময় ও দাপটের হয়। কিন্তু পড়ন্ত বেলায় সন্তানরা বাবা-মার অনেক কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এভাবেই জীবন চক্র চলছে। আমাদের বাবা-মা মনে করেছিলেন তাঁদের অধিক সন্তান তাঁদের জীবনের নিরাপত্তা, সুখ-শান্তি নিশ্চিত করবে। একইভাবে আমরা ভাবছি আমাদের অধিক সন্তানও আমাদের জীবন নিরাপত্তা ও সুখ-শান্তিতে পরিপূর্ণ করে দেবে। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের সন্তানরা একই ভাবনা নিয়ে তাদের জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখবে। কিন্তু জীবনের শেষ বেলায় এসে বুঝতে পারবে দাদা-দাদি ও বাবা-মাদের অব্যক্ত বেদনার কথা যা নিয়ে তাঁরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে গেছেন। অধিক সন্তান কারও জীবনে সুখ ও শান্তি কোনোটাই আনেনি। তার চেয়ে এক সন্তানের বাবা-মা অনেক সুখী ও অনেক বেশি তৃপ্ত এবং অনেক বেশি নিরাপদ জীবনের অধিকারী। আগামী প্রজন্ম যদি এক সন্তানের পরিবার গড়ে তোলার প্রত্যয় নেয়, তাহলে আগামী দিনে অবশ্যই তাদের সন্তান দুধে-ভাতে থাকবে। বিশ্ব অনেক বেশি নিরাপদ হবে। শান্তি অনেক বেশি প্রতিষ্ঠিত হবে।

                লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর