সোমবার, ৮ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হাতছাড়া হতে দেওয়া যাবে না

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হাতছাড়া হতে দেওয়া যাবে না

অবশেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাহেব মেনে নিয়েছেন যে একের পর এক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটলেও এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়, বরং একই সূত্রে গাঁথা। তাঁর বক্তব্য নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ এই অর্থে যে অনেকেই বলার চেষ্টা করছিলেন যে এগুলো অঞ্চলভিত্তিক বিক্ষিপ্ত ঘটনা, একটির সঙ্গে অন্যটির কোনো সংযুক্তি নেই। এরা মূলত সেই ঘরানারই লোক যারা ধর্মান্ধদের উত্থানে আনন্দিত, যারা দেশে তালেবানি রাজত্ব প্রতিষ্ঠার দুঃস্বপ্নে মুখিয়ে আছে। নড়াইলে অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি হিন্দু নির্যাতনের ঘৃণিত উন্মাদনা ঘটার পর দেশের বেশ কিছু বিবেকসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী নড়েচড়ে বসেছেন ভবিষ্যতের অশনিসংকেত আঁচ করে। গবেষণাভিত্তিক সর্বজনপূজনীয় লেখক অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বহুদিন পত্রিকায় লেখালেখি থেকে বিরত থাকার পর এক অসাধারণ লেখা ছেপেছিলেন একটি অনলাইন মাধ্যমে, যা দিয়ে বুঝিয়েছেন কীভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বেহাত হয়ে যাচ্ছে। তার পরই একই ভাব নিয়ে লিখলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক স্বদেশ রায়, অধ্যাপক আবদুল মান্নান, সাংবাদিক আবু সাঈদ, অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব, কবি কামরুল হাসান বাদল ছাড়া আমি নিজে এবং আরও কয়েকজন।

অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দীক্ষিত বিশিষ্ট নির্ভীক শিক্ষাবিদ রতন সিদ্দিকী, যাঁর উত্তরাস্থ বাড়িতে তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রীকে আক্রমণ করে হত্যার চেষ্টা করেছিল সেখানকার মাদরাসার শিক্ষক এবং ছাত্রদের সমন্বয়ে গঠিত একটি ধর্মান্ধ গোষ্ঠী, তিনি বলেছেন, শুক্রবারটি আমাদের থেকে বেহাত হয়ে গেছে। এতজন গুণী ব্যক্তির সম্মিলিত এবং প্রত্যয়পূর্ণ লেখনী প্রমাণ করছে এ দেশকে ধর্মান্ধ, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। এ দেশে ধর্মান্ধদের প্রলয়নৃত্য নতুন কিছু নয়, সময়ে সময়ে এর গতি এবং প্রকৃতি পরিবর্তিত হয় মাত্র। আজ যারা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে লিপ্ত রয়েছে এদের একটি অংশ হচ্ছে তারা বা তাদের বংশধররা যারা ’৭১-এ পাকিস্তান ভেঙে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের অভ্যুদয় মেনে নিতে পারেনি, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে শোচনীয় পরাজয়ের পর চুপসে গিয়ে হয় দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল অথবা চুপটি মেরে ছিল সময়ের অপেক্ষায়। উপযুক্ত সময়ের জন্য এসব মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ধর্মান্ধকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। তাদের দেবতুল্য ত্রাণকর্তা জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যার পরই এসব পাকিস্তানি চরকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করে তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বিরোধী কর্মকান্ডে সক্রিয় করতে সাহায্য করেছিল, যার ফলে এরা নব উদ্যমে বেড়ে ওঠে; ১৯৭৫-পরবর্তী সময় থেকে শক্তি, অর্থ এবং সামর্থ্য অর্জন করে জিয়ার বদান্যতায়, এবং অতঃপর খালেদা জিয়ার প্রকাশ্য সহায়তায়। অস্বীকার করার উপায় নেই যে এরা এখন অনেকটাই জোরালো অপশক্তিতে পরিণত হয়েছে। এদের পেছনে রয়েছে জিয়া প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপি। তবে এখন এদের দমন করা তুলনামূলকভাবে কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। সংখ্যায় এরা খুবই কম, এদের বাক্সে ৪%-এর বেশি ভোট কখনো পড়ে না। এদের পেছনে জনগণের সমর্থন নেই বললেই চলে। বাংলার মানুষ ধর্মভীরু হলেও ধর্মান্ধ নয়, অন্য ধর্মের মানুষের ওপর অত্যাচার তারা কখনো মেনে নেয় না। মওলানা জালালুদ্দিন রুমি এবং অন্যান্য সুফি-সাধকদের প্রদত্ত সব ধর্মের মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং সম্প্রীতির তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা ধর্মান্তরিত বাঙালিরা হাজার বছর ধরে অন্য ধর্মের মানুষের সঙ্গে সম্প্রীতির সঙ্গেই বসবাস করে আসছেন। কিন্তু এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর তেজি, হিংসাত্মক, জঙ্গিসুলভ এবং ধ্বংসাত্মক ভাব দেখে মনে হয় এরা অনেক শক্তির অধিকারী, যার কারণে অনেকেই এদের অহেতুক ভয় পেয়ে থাকেন। দেশে বিদেশে, পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থাসহ এদের অনেক প্রভু রয়েছে, যা প্রমাণিত। ধর্মের প্রতি বিশ্বাস নয় বরং অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ধ্বংস করে এটিকে পাকিস্তানি-তালেবানি দেশে পরিণত করাই এদের মূল উদ্দেশ্য, অর্থাৎ ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিই হলো তাদের চালিকাশক্তি। এসব লোকের অনেকেই এমনকি ধর্মীয় অনুশাসনও পালন করে না, অনেকেই প্রতারণায় গা ভাসিয়ে দিচ্ছে, ওয়াজকে বেআইনি এবং ইসলামবিরোধীভাবে, আয়কর না দিয়ে, আয়ের পরিমাণ ঘোষণা না করে, অর্থ আদায়ের পন্থা হিসেবে গ্রহণ করে বিশাল পুঁজিপতি শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে। এদের যত উপদেশই দেওয়া হোক না কেন, তাদের মৌলিক নীতি, অর্থাৎ তালেবানি রাষ্ট্র সৃষ্টির উদ্দেশ্য থেকে তারা কখনো বিচ্যুত হবে না। অন্য অংশটির সদস্য তারা, যারা মজ্জাগতভাবে ধর্মান্ধ নয়, বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধীও নয়। এরা দিনের পর দিন ওয়াজ ব্যবসায়ীদের ভ্রান্ত এবং ঘৃণাত্মক কথায় প্রভাবিত হয়ে সাম্প্রদায়িকতাকেই সত্যিকার ধর্মের পথ বলে মেনে নিয়েছে। কিন্তু যেহেতু তারা মজ্জাগতভাবে সাম্প্রদায়িক বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী নয়, তাই তাদের প্রকৃত উপদেশ প্রদান করে সঠিক পথে ফেরানো সম্ভব, যার জন্য প্রয়োজন সেসব প্রকৃত ধার্মিক লোকের দ্বারা ওয়াজ করানো যারা ঘৃণার বাণী, সাম্প্রদায়িকতার বাণী না ছড়িয়ে প্রকৃত ধর্মের কথা, সম্প্রীতির কথা ছড়াবে, বোঝাতে সক্ষম হবে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই বাংলাদেশের নাগরিক, প্রত্যেকেরই অধিকার রয়েছে নিজ নিজ ধর্ম বিনা বাধায় পালন করার, এরা সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। আরও বোঝাতে হবে বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। বোঝাতে হবে হিংসা, নির্যাতন, হত্যা, অন্য ধর্মের উপাসনালয়, মূর্তি ধ্বংস মোটেও ইসলাম প্রশ্রয় দেয় না, বোঝাতে সক্ষম হবে, এক ঈশ্বরই সব মানুষের স্রষ্টা, শুধু মুসলমানদেরই স্রষ্টা নন, যে কথা বঙ্গবন্ধু বারবার বলতেন। ‘যার মনের মধ্যে আছে সাম্প্রদায়িকতা সে হলো বন্য জীবের সমতুল্য’- জাতির পিতার সেই অমর বাণীও সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। কয়েক সপ্তাহ আগে পশ্চিমবঙ্গে কিছু উগ্র মুসলমান অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করলে সেখানকার কয়েকজন খ্যাতনামা আলেম এই বলে তাদের নিবৃত্ত করেছিলেন যে হিংসা, বিদ্বেষ, ধ্বংস, মানুষের জীবন দুর্বিষহ করা এগুলো ইসলামের শিক্ষা নয়, ইসলাম কখনো এসব বিদ্বেষপ্রবণ লোকদের ধর্ম হতে পারে না। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে পালাক্রমে এতগুলো সাম্প্রদায়িক তা-ব ঘটার পরেও কোনো ইসলামী বক্তা এ ধরনের কথা বলে দুর্বৃত্তদের থামানোর চেষ্টা করলেন না, যে কথাটি কিছুদিন আগে পুলিশের আইজি ড. বেনজীর আহমেদ সাহেব দুঃখ করে বলেছিলেন। একসময় আমাদের দেশে যাত্রাগান, পালাগান, কবিগান, নাটক, চলচ্চিত্র, মেলা, ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা ছিল মফস্বলের জনগণের অবসর কাটানোর শ্রেষ্ঠ উৎস। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের সম্মিলিত এসব নিষ্পাপ উৎসবের কথা ভেবেই তো বাউল কবি গেয়েছিলেন- ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান... আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।’ গ্রামে ফুটবল, কাবাডি, কুস্তি প্রভৃতি খেলাও একই উদ্দেশ্য সাধন করত। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এগুলো এখন অবক্ষয়ের পথে, যার জন্য নিরীহ মানুষগুলো অবসর সময় ওয়াজ ব্যবসায়ীদের অনুষ্ঠানে যেতে বাধ্য হয়ে ঘৃণার কথা, সাম্প্রদায়িক কথা, অন্য ধর্মের লোকদের প্রতি বিদ্বেষের কথা, মহিলাদের কর্ম গ্রহণের বিরুদ্ধে কথা শুনে শুনে অনেকটাই ধর্মান্ধে পরিণত হচ্ছে। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে কয়েকজন ওয়াজ ব্যবসায়ীর কথার চালে পড়ে তাদের অনেকেই এহসান গ্রুপ নামে একটি প্রতারক কোম্পানিতে ১৭ হাজার কোটি টাকা নষ্ট করেছে। এ ধরনের ভুয়া ওয়াজের মাধ্যমে ওয়াজ ব্যবসায়ীরা আরও অনেকের থেকেই অনেক পয়সা হাতিয়ে নিয়েছে, এ ধরনের নজিরেরও অভাব নেই। ওয়াজ ব্যবসায়ীরা প্রতিনিয়ত যেসব ঘৃণার কথা ছড়াচ্ছে তার সবই শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও কর্তৃপক্ষ কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে না, তা অবোধগম্য। মনে হচ্ছে এরা তাদের ভয়ে ভীত। কিন্তু ’৭১ এবং ২০১৩-এর ৫ মে-র পরাজিত অপশক্তিকে কেন ভয় পেতে হবে, তার কোনো যুক্তিসংগত কারণ কর্তৃপক্ষ দেখাতে অক্ষম। মনে হচ্ছে এদের তোষণ করাই কর্তৃপক্ষের নীতি, অথচ তার ফল যে ভয়াবহ হতে বাধ্য, সে কথাটি তাঁরা অনুধাবন করতে পারছেন না। অবশ্য এও সত্য যে পুলিশ, প্রশাসন এবং এমনকি নিম্ন আদালতেও বহু ধর্মান্ধ ঢুকে পড়েছে বা আগে থেকেই বিরাজ করছে। হিন্দুদের ফেসবুক হ্যাক করে কিছু ধর্মান্ধ মুসলমান সাম্প্রদায়িক অশান্তির সৃষ্টি করে আসছে বলে প্রমাণের অভাব নেই। সেসব ক্ষেত্রে হিন্দুদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, অথচ যারা শান্তি, সম্প্রীতি বিনষ্ট করল তারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার বিরুদ্ধে যে আইনগুলো রয়েছে, তা শুধু হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধেই প্রযোজ্য। ধর্মান্ধ মুসলমানরা যেন এসব আইনের ঊর্ধ্বে। সরকার প্রতিটি এলাকায় সম্প্রীতির বাণী প্রচারের জন্য ২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে বলে খবরে প্রকাশ। যে হারে সাম্প্রদায়িকতার উন্মেষ ঘটেছে, সে তুলনায় এ পরিমাণ অর্থ খুবই কম। তার চেয়ে বড় কথা এসব কাজের দায়িত্ব কাদের দেওয়া হবে? যদি ধর্মান্ধদের হাতেই এর দায়িত্ব দেওয়া হয়, যা লোকমুখে শোনা যাচ্ছে, তাহলে তা হবে হিতে বিপরীত।

প্রতিটি এলাকায় যাত্রা, নাটক, খেলাধুলার প্রসার ঘটানোর প্রকল্প হাতে নিতে হবে যার জন্য অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষদের সহায়তা চাইতে হবে। ধর্মান্ধরা এমন পর্যায়ে পৌঁছতে সাহস পেয়েছে যে যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নামাজের জায়গার মোটেও কোনো অভাব নেই, তার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্র টিএসসিতে তারা আলাদা নামাজের জায়গার দাবি তুলেছে মূলত বাঙালি সংস্কৃতি ধ্বংস করার মানসে। এদের খুব কমসংখ্যক লোকই আসলে নামাজ পড়ে থাকে। তাদের এ উদ্ভট দাবির পেছনে কাজ করছে তালেবানি শক্তি এবং পাকিস্তান হাইকমিশন। কাওয়ালি সংগীত পাকিস্তান এবং উত্তর ভারতে বেশ জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গে এটি তেমনভাবে পরিচিত নয়। তার পরও একটি পাকিস্তানপন্থি মহল দেশে মানুষের ওপর কাওয়ালি চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টায় নেমেছিল, উদ্দেশ্য ছিল রবীন্দ্র-নজরুল-পঞ্চকবি-লালন এবং শাহ আবদুল করিমসহ অন্য কবিয়াল ও বাউলদের প্রভাব নষ্ট করে পাকিস্তানি সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা। ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর মূল উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করা আর সেই উদ্দেশ্যেই প্রাথমিকভাবে তারা দেশকে হিন্দুশূন্য করার উন্মাদনায় মেতে উঠেছে, যার জঘন্যতম দিকটি আমরা দেখেছিলাম ২০০১ সালের নির্বাচনের পরে, যা প্রাথমিকভাবে ঘটিয়েছিল বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং পরে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত সরকার। এ অপশক্তিকে রোখার জন্য সরকারকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে, একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদেরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে সক্রিয় হতে হবে। যারা মনে করছেন ধর্মান্ধ-তালেবানিদের সঙ্গে আপস করে মুক্তিযুদ্ধের সরকারকে টিকিয়ে রাখা যাবে, তারা হ্যালোসিনেটারি বিভ্রান্তিতেই ভুগছেন। যে অপশক্তির উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের সরকারের উচ্ছেদ, তারা সেই সরকারকে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় বসাবে, এ ধরনের চিন্তা বাতুলতা বই কিছু নয়। যারা ওয়াজের মাধ্যমে ঘৃণা ছড়িয়ে প্রতিদিন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অপরাধ করে যাচ্ছে, তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। যারা একই কাজে সামাজিক মাধ্যমগুলো ব্যবহার করছে তাদেরও বিচারে আনতে হবে। আগেই যদি এসব ঘৃণা ছড়ানো ওয়াজ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো তাহলে মুন্সীগঞ্জ, নড়াইলসহ বিভিন্ন এলাকায় ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর আস্ফালন ঘটতে পারত না। আমরা জানি আওয়ামী লীগে বহু ধর্মান্ধ চুপিসারে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু তার পরও সত্যিকার আওয়ামী লীগারের সংখ্যা এখনো বেশি, যারা বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক নীতির প্রতি অবিচল। হেফাজতিদের চাপে পাঠ্য-পুস্তকে অসাম্প্রদায়িক রচনাগুলো সরিয়ে সাম্প্রদায়িকতাপূর্ণ তথ্য সংযোজন করে কচি শিশুদের মধ্যে অন্য ধর্মের মানুষকে ঘৃণা করার কথা শেখানো হচ্ছে। ছোট ছোট মেয়েদের মাথায় হিজাব পরা ছবি ছাপিয়ে এই মর্মে তাদের মস্তিষ্ক ধোলাই করা হচ্ছে যে হিজাব আমাদের জাতীয় পোশাকের অংশ, যা মোটেও সত্য নয় এবং এর কারণেই হিজাব পরিহিত মহিলার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।

২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতিরা নির্লজ্জভাবে পরাজিত হওয়ার পরও আমরা আশ্চর্যজনকভাবে তাদের দাবিগুলো মেনে নিয়ে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন এনেছিলাম। পরাজিত অপশক্তির শর্তে সন্ধি করার নজির ইতিহাসের কোথাও নেই, বাংলাদেশ ছাড়া। মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে বহু ভ- পীর এবং জিনের বাদশাহ অনেককে পথে বসিয়েছে। ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে চিরতরে প্রতিহত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বদ্ধপরিকর সবাইকে মাঠে বিচরণ করার এটাই উপযুক্ত সময়। পুরো বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ বিবেচনায় এবং নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, কেননা সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উত্থান রোধে তাঁর বিকল্প নেই।

পিতার মতো তিনিও অসাম্প্রদায়িক, যিনি সব সময় বলে থাকেন ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার, ধর্ম যার যার উৎসব সবার। মনে রাখতে হবে, তাঁর নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক সরকারকে হটানোই এসব ধর্মান্ধের মুখ্য উদ্দেশ্য।

                লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

সর্বশেষ খবর