শনিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

কতটা ফলবে অনাবৃষ্টির আমন

শাইখ সিরাজ

কতটা ফলবে অনাবৃষ্টির আমন

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বব্যাপীই ছড়িয়ে পড়েছে। পরিবর্তনের এ প্রভাব শুধু এশিয়ার কৃষিতে নয়, ইউরোপ-আমেরিকাসহ সারা বিশ্বেই। তার প্রমাণ গণমাধ্যমে দেখেছি, পৃথিবীর বিভিন্ন বনভূমিতে আগুন, বরফাচ্ছাদিত পাহাড় গলে পড়াসহ ঘটছে নানারকম দুর্ঘটনা। ঋতুবৈচিত্র্যের এ পরিবর্তন গোটা বিশ্বের কৃষি ও প্রকৃতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। আমাদের দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের বহুমুখী বিরূপ প্রভাব। বর্ষা প্রায় শেষ প্রান্তে। কিন্তু পর্যাপ্ত বৃষ্টির দেখা নেই কোথাও। অনাবৃষ্টির কারণে দেশের অনেক জেলায় ব্যাহত হচ্ছে আমনের চাষাবাদ। দেশের মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ৩৫-৩৭ শতাংশই আসে আমন থেকে। সারা দেশে ৫৯ লাখ হেক্টর জমিতে আমনের চাষ হয়। উৎপাদন হয় প্রায় দেড় কোটি টন ধান। সাধারণত আমনের চাষ বৃষ্টিনির্ভর। কিন্তু এ বছর পুরো বর্ষা বৃষ্টিহীন। আবহাওয়া দফতর বলছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন অনাবৃষ্টির বর্ষাকাল আর আসেনি। এ বছর জুলাইয়ে ৫৭.৬% কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। শুকিয়ে গেছে ধান খেত। আগামী মাসেও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। একদিকে বিদ্যুতের লোডশেডিং, অন্যদিকে বড়েছে ডিজেলের দাম। ফলে দিশাহারা কৃষক। এ ছাড়া সার, কীটনাশক ও শ্রমিকের সংকট মিলে আমন আবাদে যা খরচ দাঁড়াচ্ছে তাতে কৃষক ব্যাপক হতাশ হচ্ছে। দেশের অনেক জেলায়ই এবারের আমনের মাঠ ফেটে চৌচির হতে দেখা যাচ্ছে। এতে কৃষকের উৎকণ্ঠা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

খবর নিয়ে জেনেছি, উত্তরাঞ্চলে, রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলায় এবার কাক্সিক্ষত বৃষ্টিপাত হয়নি। এ বিভাগের পাঁচ জেলায় এবার আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ লাখ ১৫ হাজার ৬৮৫ হেক্টর জমিতে। গতকাল পর্যন্ত এ অঞ্চলে আমনের চারা রোপণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার ২১ হেক্টর জমিতে; যা লক্ষ্যমাত্রার ৫৮.৪৭ শতাংশ। রাজশাহী বিভাগের অধিকাংশ জায়গার চিত্র একই রকম। শ্যালো মেশিন অথবা বৈদ্যুতিক সেচে চলছে বেশির ভাগ আমনের আবাদ। এ বিভাগের আট জেলায় এবার রোপা আমনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩ হাজার ৪৬৬ হেক্টর জমিতে। গতকাল পর্যন্ত ২ লাখ ২ হাজার ৭১৪ হেক্টর জমিতে ধান রোপণ করা হয়েছে। ওই এলাকার কৃষক বলছে, আমন মৌসুমে বর্ষার পানি ছাড়া চাষ করে লাভ হয় না। খরা ও অনাবৃষ্টির শিকারে পড়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষকও। পানির অভাবে তাদের জমিগুলো খালি পড়ে আছে। বৃষ্টির অপেক্ষায় থেকে এখন সেচের পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

গোটা দেশের আমন রোপণের পরিস্থিতি প্রায় একই রকম। এখনো বহু জমি অনাবাদি পড়ে আছে। বৃষ্টির অভাবে শুকিয়ে গেছে ছোট ছোট নদী-খাল। কোনো কোনো পুকুর-ডোবানালায়ও পানি নেই। রোদে খাঁ খাঁ করছে চারপাশ। আবহাওয়ার এ পরিবর্তনে সমস্যায় পড়ছে কৃষিভিত্তিক জীবনব্যবস্থা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবার আগে দরকার কৃষকের আবহাওয়ার পূর্বাভাস সম্পর্কে জানা। এ বিষয়ে তথ্য ও সরকারি উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে গিয়েছিলাম বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের কৃষি আবহাওয়া বিভাগে। কথা হয় এ বিভাগের প্রধান ড. মো. শামীম হোসেন ভূঁইয়ার সঙ্গে। তিনিও মনে করছেন, আবহাওয়ার এ বিরূপ আচরণ আগামীর জন্য বিপৎসংকেত। চেনা আবহাওয়া দিন দিন অচেনা হয়ে উঠছে। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে ঋতুভিত্তিক আবহাওয়া ঠিক পাওয়া যাচ্ছে না। শামীম হোসেন বলছিলেন, আবহাওয়ার এ পরিবর্তনকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। বিশেষ করে কৃষি অনুশীলনে এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হতে হবে, পাশাপাশি কৃষককেও দক্ষ করে তুলতে হবে ভবিষ্যতের কৃষি অনুশীলনে।

আগেই বলেছি, আবহাওয়া দফতরের তথ্যমতে এ বছরের জুলাইয়ে গড় বৃষ্টিপাত শতকরা ৫৭.৬ ভাগ কম হয়েছে। যা গত ৪২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত ১০ বছরের জুলাইয়ের তাপমাত্রার রেকর্ডেও এ বছর সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে রাজশাহীতে ৩৯.৫ সেলসিয়াস। আবহাওয়াবিদ ড. মো. আবদুল মান্নান বলছিলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক কিছুই এখন দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে পরিস্থিতি। আমরা চেষ্টা করছি আবহাওয়ার যে কোনো পরিবর্তনই মানুষকে ঠিক সময়ে অবহিত করার। কিন্তু পরিবর্তন এত দ্রুত এবং আকস্মিক হচ্ছে যে তা মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে উঠছে। যেমন বৃষ্টি আগের সময় মেনে হচ্ছে না, সাগরে বাতাসের প্রবাহও ঠিক আগের মতো নেই। জলবায়ুর এমন পরিবর্তনের কারণেই বদলে যাচ্ছে দেশের ঋতুচক্র। বদলে যাচ্ছে পরিবেশ, প্রকৃতি ও কৃষি। যার প্রভাব ইতোমধ্যে কৃষি উৎপাদনের ওপর পড়তে শুরু করেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য আমরা কতটুকু প্রস্তুত? আগামী দিনেই বা আমাদের করণীয় কী? এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম জলবায়ু ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাতের কাছে। তিনি বললেন, পরিবর্তিত সময়ের জন্য পূর্ব প্রস্তুতির বিকল্প নেই। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সার্বিক সমন্বয় ও সমন্বিত উদ্যোগ। জলবায়ু পরিবর্তনে গবেষণাকে যেমন প্রাধান্য দিতে হবে, মানুষের কাছে সেই গবেষণার ফলাফল পৌঁছাতে হবে ঠিক সময়ে। এ ক্ষেত্রে সবার কাজে সমন্বয় থাকাটা জরুরি।

আবহাওয়ার এমন বিরূপ প্রভাব কাটিয়ে ওঠার জন্য কতটা প্রস্তুতি আছে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের জানতে চেয়েছিলাম প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীরের কাছে। তিনি আশান্বিত করলেন। বললেন, খরাসহিষ্ণু বেশ কিছু ভ্যারাইটি তাঁরা উদ্ভাবন করেছেন। তবে কৃষক পর্যায়ে সব ভ্যারাইটি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে না। তিনি বন্যাসহিষ্ণু জাতের ধানের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘যেমন ধরুন কৃষক যখন দেখে তার খেত ডুবে গেছে, তখন সে ভাবে তার সব শেষ হয়ে গেল। অথচ বন্যাসহিষ্ণু ধানের ভ্যারাইটিগুলো সাধারণত ২১ দিন পর্যন্ত পানির নিচে থাকতে পারে। পানি নেমে গেলেই ফলন আসবে।’ ড. শাহজাহান আরও বলছিলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত যতটা দ্রুত বিপর্যস্ত করছে, গবেষণার ফলাফল তত দ্রুত মাঠে নেওয়া যাচ্ছে না। এ ধরনের প্রস্তুতিগুলো আরও আগে নেওয়া উচিত ছিল।

তবে মূল বাস্তবতা হচ্ছে চলতি মৌসুমে এখনো অনেক জায়গায় আমন রোপণ করা সম্ভব হয়নি। বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন বৃষ্টির পানিতে এ বছর সম্ভব হবে না। যদিও কৃষি বিভাগ বলছে বৃষ্টি শুরু হলেই পরিস্থিতি সামলে ওঠা যাবে। কিন্তু অনাবৃষ্টির কারণে উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষকের উৎকণ্ঠা কাটছে না। অন্যদিকে যারা রোপণ করেছেন তারাও দফায় দফায় সেচের পানি দিয়ে আমন ধানে আশানুরূপ ফলনের ব্যাপারে শঙ্কিত। জলবায়ু ও প্রকৃতির এ কঠিন পরিস্থিতি নতুন করে জানান দিচ্ছে কৃষি ব্যবস্থাপনায় আমাদের আরও আধুনিক হতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব আমাদের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সময়োপযোগী করতে হবে। যাতে বৈরী আবহাওয়া-সহিষ্ণু ফসলের জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে দ্রুত কৃষকের কাছে পৌঁছানো যায়। কেননা জলবায়ুর ক্রমপরিবর্তনের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ছে খাদ্য উৎপাদনের ওপর। ফলে কৃষকই সবার আগে ক্ষতির মুখে পড়ছে। গত বছর হাওরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অকস্মাৎ হিট ওয়েবে ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। এভাবে প্রতি বছরই আবহাওয়ার বিরূপ আচরণের শিকার হচ্ছে আমাদের কৃষি ও কৃষক। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখেই আমাদের আগামীর কৃষির পরিকল্পনা করা অত্যন্ত জরুরি।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর