সোমবার, ১৫ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

তোমার হত্যার বদলা নেবে বৈকি দেশবাসী

ওয়ালিউর রহমান

তোমার হত্যার বদলা নেবে বৈকি দেশবাসী

১৯৭৮ সাল। আমি জেদ্দায়। ইসলামী কনফারেন্সের (O I C) সেক্রেটারিয়েটে চাকরি নিতে বাধ্য হলাম। সেনেগালের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি সেক্রেটারি জেনারেল। জিয়াউর রহমান আমার ওপর ক্ষিপ্ত। আমি কেন বঙ্গবন্ধুকে জেনেভায় সেবা করলাম লন্ডনে অপারেশনের পর। উনি আমাকে বললেন, 'I went beyond the call of my duty' ! তাই আমাকে যখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তিনি বের করে দিলেন। OSD করলেন। আমি তড়িঘড়ি করে Organisation of Islamic
Conference-এ আমাদু করীম গায়ের অফার নিয়ে চলে গেলাম জেদ্দায়। ঠিক ওই মুহূর্তেই আমি উত্তর-পর্ব মুজিবনগর বইটি পেলাম। শওকত ভাইয়ের একান্ত বাল্যবন্ধু আমার ফুফাতো ভাই সৈয়দ মাসুদ রুমী সাহেবের সৌজন্যে। আমি মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। ওপরের পঙ্ক্তিটি আমাকে বিশেষভাবে দোলা দিল। আরও পড়লাম... ‘তোমার হত্যার বদলা নেবে বৈকি দেশবাসী। তোমার ঘাতকরা জানে না’।

এক বছর জেদ্দায় কাটিয়েছিলাম। প্রতীক্ষায় ছিলাম। আমি ও আমার স্ত্রী শাহরুখ আমরা প্রায়শ দ্বিতল বাড়ির ছাদের ওপর চলে যেতাম সন্ধ্যার পর। আলোচনা চলত দেশের অবস্থা নিয়ে। ১৫ আগস্টের কালরাত। আর আমাদের দেশে-বিদেশের বঙ্গবন্ধুর শুভানুধ্যায়ী যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় সাহায্য করেছেন বিভিন্নভাবে। সৌদি আরব যেহেতু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল। তাই সে মুহূর্তেও জায়গাটি যেন একটি ড্রামাটিক ফইল (Dramatic Foil)-এর মতোই মনে হতো।

রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাসায় বেশিক্ষণ কাটাতাম। শওকত ভাইয়ের ওই বইয়ের কথাও তাঁকে বললাম। হুমায়ুন ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ইন্দোনেশিয়ায়। আগরতলা ষড়যন্ত্র-উত্তর সময়ে আমরা অনেক প্ল্যান-প্রোগ্রাম করতাম। শুরু করেছিলাম জনাব কিবরিয়া সাহেবের সময় থেকেই জাকার্তা শহরে। শামসুর রহমান খানকে (জনসন ভাই) কয়েকদিন আগেই জাকার্তা থেকে পাকিস্তান সরকার তলব করল। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনিও একজন আসামি। জেদ্দায় এ সবকিছু আমাদের মানসপটে ফিরে আসত। যুদ্ধ করেছি। জয়লাভ করলাম বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। জেনেভায় রিফুজি ছিলাম নয় মাস। এক বছর পর বাংলাদেশের নতুন কূটনৈতিক পাসপোর্ট পেলাম। সে কী আনন্দমুখর দিন ছিল। তারপর পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। সব ওলট-পালট হয়ে গেল। সেই ট্রমা থেকে এখনো মুক্তি পাইনি। জেদ্দায় তো আরও বেশি ছিল। এসব চিন্তা-ভাবনার মাঝে শওকত ভাইয়ের বইটি ছিল আমার যেন মুক্তির পাথেয়। আর ছিল বঙ্গবন্ধুর ছবির অ্যালবাম। জেনেভায় থাকাকালীন দুবার তিনি নিয়েছিলেন।

শওকত ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় তাঁর ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসের মাধ্যমে। এটি বোধহয় কার্জন হলে মঞ্চস্থও করা হয়েছিল। মুক্তচিন্তা ধারার ছাত্র হিসেবে এটি একটি বড় রেখাপাত করেছিল তখন।

জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া যে আমাকে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করেছেন তার বিরুদ্ধেও তিনি প্রতিবাদ জানালেন। বললেন, ‘কম্প্রোমাইজ কর না। আমি বললাম, ‘প্রশ্নই ওঠে না’। সেই সুযোগেই আমি শওকত ভাইকে বললাম, তার উত্তর-পর্ব মুজিবনগর বইয়ের কথা। এবং কীভাবে তাঁর বলিষ্ঠ লেখনী আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল সে দুঃসময়ে।

এত ঘাত-প্রতিঘাতের পর যখন স্বাধীনতার পক্ষের সরকার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এলো ২৩ জুন ১৯৯৬ সালে। শওকত ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হতো, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন জায়গায়। ৬ নভেম্বর ১৯৯৬ সালে যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে চাকরিতে রেইনস্টেট (r e i n s t a t e) করলেন- সকাল বেলার প্রথম টেলিফোন শওকত ভাইয়ের।

এর তিন মাস পর শামছুদ্দীন আবুল কালাম সাহেবের মৃত্যু তাকে খুব মুহ্যমান করেছিল। তিনি রোম শহরে একা থাকতেন। ছোট্ট ঘরে। মৃত্যুর খবর আমরা সময়মতো পাইনি কেন, মৃত্যুর পর এতদিন কেন আমাদের অ্যাম্বাসি সময়মতো আমাদের খবর দেয়নি ইত্যাদি। ঢাকা থেকে তো এসব প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারিনি; কিন্তু তার সংবেদনশীল মনের একটি কান্নার শব্দ যেন আমি পেয়েছি। ক্যামেলিয়া কোথায় তিনি কয়েকবার জিজ্ঞাসা করলেন। আমি শুধু বললাম, বাংলা একাডেমির সঙ্গে আমি যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছি আমাদের অ্যাম্বাসিকে যাতে করে তাঁর ম্যানুস্ক্রিপ্টগুলো খোয়া না যায়।

শওকত ভাই আপসহীন ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। নব্য স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। সবার ওপরে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যার বিরুদ্ধে। তাই ১৯৯৭ সালে ১৯ জুলাই এ যখন আমাদের সঙ্গে দেখা হলো তিনি সঙ্গে সঙ্গে ওই মাসের শেখের পম্বরুর সঙ্গে দুটি পঙ্ক্তি লিখে দিলেন। লিখেই বললেন, ‘তুমি যে তিন বা চারটি ইংরেজি কলাম লিখেছ জবাবদিহিতার ওপর, স্বচ্ছতার ওপর, তার উদ্দেশেই কথাগুলো লিখলাম’।

আমি একেবারে চুপ। এটিই বোধহয় আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। আর পাওয়া হলো বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার এই বাংলাদেশেই। তিনি যা লিখেছিলেন ১৭ মার্চ ১৯৭৮ সালে।

                লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক।

সর্বশেষ খবর