বৃহস্পতিবার, ১৮ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

কৃষ্ণপ্রেমের অমিয় ধারায়

ফনিন্দ্র সরকার

কৃষ্ণপ্রেমের অমিয় ধারায়

সনাতন ধর্মের অনুসারী হিন্দু সম্প্রদায় শ্রীকৃষ্ণকে স্বয়ং ভগবানরূপে পূজা করে। অর্থাৎ মহাশক্তির আধার মানুষরূপে শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন এ পৃথিবীতে। ভাদ্রের রোহিণী নক্ষত্রযোগে কৃষ্ণা অষ্টমী তিথিতে দেবকীর গর্ভে ভগবান বিষ্ণু অবতাররূপে আবির্ভাব হন ধরণিতে; কৃষ্ণ নাম ধারণ করে পালিত হন মা যশোদা দেবীর ঘরে। এ আবির্ভাব ঘটে ৫ হাজার বছরের কিছু আগে। এ নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক থাকতে পারে। পৌরাণিক কাহিনিতে শ্রীকৃষ্ণের জন্মকথার বিশদ বর্ণনা রয়েছে আমি সে বর্ণনায় যেতে চাই না। শাস্ত্রমতে শ্রীকৃষ্ণ মানুষ, কিন্তু মানুষ নন, তিনি পরপুরুষ নন পরম পুরুষ, তিনি পরাৎপর ব্রহ্মের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবীয় অনুবাদ। প্রকৃতির অনবদ্য নির্যাস। এ নির্যাস থেকেই উৎসারিত হয়েছে প্রেম পুণ্য ভালোবাসা। প্রেমের মতো মহাসত্যকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কীভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন কিংবা কেন করেছেন তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী অনুষ্ঠানকে উৎসর্গ করছি। জীবশ্রেষ্ঠ মানব জাতির সভ্যতা বিকশিত হয়েছে প্রেম ও ভালোবাসা ঘিরেই। প্রেমের বহ্নিশিখায় নানা ধর্ম নানা বর্ণের সূত্র বিদ্যমান রয়েছে। ধারণ ক্রিয়া থেকে উৎপন্ন নানা ধর্মের ধারণায় বেড়ে উঠছে মানব জাতি। বৈচিত্র্যগত দিক থেকে ধর্মের বিভিন্নতায় মানুষের বিচরণ থাকলেও সব ধর্মের আধ্যাত্মিকতায় কোনো ভিন্নতা নেই। এ যেন বহুভাবে একেরই উপলব্ধি। সেই উপলব্ধিটা হচ্ছে প্রেম। অর্থাৎ মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, সহমর্মিতা সর্বোপরি মানবিকতা। শ্রীকৃষ্ণ মানবরূপে আবির্ভূত হয়ে মানবীয় লীলা প্রদর্শন করে গেছেন। শ্রীকৃষ্ণ প্রেমলীলার মাহাত্ম্য প্রচার করে গেছেন শ্রীশ্রীচৈতন্য দেব। যাঁকে আমরা গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু হিসেবে কৃষ্ণরই প্রতিবিম্ব মনে করি কলিযুগে। ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে নবদ্বীপে জন্মগ্রহণকারী মহাপ্রভুর করুণায় জানতে পারি শ্রীকৃষ্ণপ্রেমের অমিয় গাঁথা।

ভগবান নিজে ধরা না দিলে তাঁকে ধরা যায় না। কিন্তু ভক্তের প্রেম তিনি উপেক্ষাও করতে পারেন না। আবার তিনি মানুষকে না ডাকলে মানুষের মনও তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয় না। তাই মানুষের সঙ্গে প্রেমের যোগসূত্র হিসেবে মনুষ্য দেহ ধারণ করে কখনো পুত্ররূপে, বন্ধুরূপে, স্বামীরূপে তিনি প্রকটিত হন। পুত্ররূপেই হোক, পতিরূপেই হোক বা ঈশ্বরভাবেই হোক শ্রীকৃষ্ণকে চিন্তা করতে করতে ভক্তরা কৃষ্ণপ্রেমে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন, ফলস্বরূপ কৃষ্ণ প্রাপ্তি। হৃদয়ের সহজ শুদ্ধ ভালোবাসা দিয়েই ভগবান বা মহাশক্তির নৈকট্য লাভ করা সম্ভব। শ্রীমৎভগবতের একটি সুন্দর কথা হচ্ছে, তপস্যা করে মানুষ যেমন ব্রহ্মত্ব লাভ করে, পরমব্রহ্মও তেমন তপস্যা করে মানবত্ব লাভ করেন। মানুষের তপস্যা মানে সাধনা, ঈশ্বরের তপস্যার নাম করুণা। মানুষ তপস্যায় ওপরে উঠে করুণায় ঈশ্বর নামেন। নামতে নামতে ভগবান যখন মানুষরূপ ধারণ করেন তখন মোর পুত্র, মোর সখা, মোর প্রাণপতি হয়ে প্রেমের খেলায় মত্ত হয়ে যান। প্রেমের এ খেলায় সুন্দরতম সমাজ বিনির্মাণ হয়। তাই শ্রীকৃষ্ণও সুন্দরতম। শ্রীকৃষ্ণ লীলা করেছেন মথুরায়, গোকুলে ও বৃন্দাবনে। বাঙালির একটা গৌরবময় ইতিহাস হচ্ছে বৃন্দাবনের বনজঙ্গলে আবাদ করে প্রেম ও ভক্তির পত্তন করেছে। বাঙালি যখন এ নববৃন্দাবন সৃষ্টি করে তখন নবদ্বীপে শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আবির্ভাব ঘটে। প্রেম ভক্তি পত্তনকালে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিল। গৌরাঙ্গদেব অপরিণত বয়সে অলৌকিক শক্তি দ্বারা সব সমস্যা ও বিবাদের অবসান ঘটিয়েছিলেন। এটা গোটা ভারতীয় ইতিহাসের একটি নবযুগ। প্রেম পুণ্যের ইতিহাসের যে নতুন ধারা প্রবাহিত হয়েছিল তার প্রধান কেন্দ্র ছিল বৃন্দাবন। শ্রীগৌরাঙ্গদেব মহাপ্রভু স্থায়ীভাবে বৃন্দাবনে বসবাস না করলেও তাঁরই প্রেরণায় এবং তাঁর প্রেরিত ভক্ত সম্প্রদায়ের একাগ্র প্রচেষ্টায় শ্রীবৃন্দাবনে বাঙালির উপনিবেশ স্থাপিত হয়েছিল। বাঙালির একমাত্র সাধনা ভক্তির রাজ্য প্রতিষ্ঠা, ভক্তিবাদ এবং প্রেমের ভিত্তি পত্তন ও লীলাধর্মের প্রবর্তন। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে শ্রীকৃষ্ণ দুই বছর তিন মাস বয়সে বেশ দুরন্ত হয়ে উঠেছিলেন। দেবকীর উদরে জন্ম নিলেও লীলাবিলাসের লক্ষ্যে পালিত হচ্ছিল মা যশোদার ঘরে, যা আগে বলেছি। মা যশোদা শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ন্ত্রণে বেঁধে রাখতে চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুতেই বাঁধতে পারছেন না, অলৌকিকভাবে রশি ছোট হয়ে যায়। দুই আঙুল ফাঁক থেকে যায়, ভগবান ও ভক্তে দুই আঙুল ব্যবধান। ভক্ত অগ্রসর হবে সাধনায় এক আঙুল, ভগবান আসবেন করুণায় এক আঙুল। ভক্তবাৎসল্য দর্শনের জন্য ভগবান জননী কর্তৃক বন্ধন গ্রহণ করলেন। উদূখলে বাঁধা শ্রীকৃষ্ণ। কার্তিক মাসে মা যশোদা রজ্জু দ্বারা শ্রীকৃষ্ণকে বন্ধন করেছিলেন বলেই এ মাসকে দামোদর মাস বলা হয়। মা যশোদার সঙ্গে এ বন্ধন খেলাটিতেও প্রেমের মাহাত্ম্য বিদ্যমান। শ্রীকৃষ্ণের বাল্য ও শৈশব লীলাক্ষেত্র ছিল মথুরায়। পাপী কংসকে বধ করতেই মথুরায় লীলা করেছেন। শ্রীকৃষ্ণ ব্রজের গোপাল হয়ে চারটি মাধুর্যে প্রকটিত হন। এগুলো হচ্ছে- রূপমাধুর্য, বেণুমাধুর্য, প্রেমমাধুর্য ও লীলামাধুর্য। বৃন্দাবনে গোপীদের বাস। গোপীদের শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের লালসা প্রবল। কাত্যায়নী পূজা এ লালসারই অপূর্ব অভিব্যক্তি। শ্রীকৃষ্ণের সুমধুর বংশীতানে ব্রজ রমণীরা তাদের নিজ নিজ কর্ম (বিধিমার্গ) ত্যাগ করে শরৎ ঋতুর পূর্ণিমা তিথিতে রাস নৃত্যে সমবেত হতেন। রাসস্থলে শ্রীকৃষ্ণ যত গোপী তত নিজরূপ পরিগ্রহ করেন। শ্রীরাধিকা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠ সহচরী। শ্রীরাধা ও গোপীদের শ্রীকৃষ্ণ অভিমুখে অভিসার রজনিই রাসরজনি, রাধা বলতে বোঝায় রা, অর্থ লাভ করা অর্থাৎ মুক্তি লাভ করা এবং ধা, অর্থ ধাবমান হওয়া, ভগবান পদে ধাবমান হওয়া, শ্রীরাধা ও গোপীরা মুক্তিলাভের আশায় রাসস্থলীতে কৃষ্ণের কাছে এসেছিলেন। জ্ঞান ছাড়া ভক্তি ও প্রেমের সাহায্যে শ্রীভগবানের সান্নিধ্য পাওয়া যায়। শ্রীকৃষ্ণ ভগবান আর রাধা হচ্ছে মানবাত্মা। রাসমঞ্চে রাধা-কৃষ্ণের মিলন হচ্ছে ভক্ত ভগবানেরই মিলন। সংসার চক্রে কীভাবে জীবন চালনা করতে হবে তার নিখুঁত শিক্ষা মেলে এ রাসে।

সর্বশেষ খবর