শিরোনাম
শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

সংলাপের রাজনীতি, রাজনীতির সংলাপ

মহিউদ্দিন খান মোহন

সংলাপের রাজনীতি, রাজনীতির সংলাপ

সংলাপ শব্দটি আমাদের সবার কাছেই পরিচিত এবং বহুল ব্যবহৃতও বটে। সংলাপের ইংরেজি প্রতিশব্দ ডায়ালগ। সাধারণত নাটক-সিনেমায় এর ব্যবহার ছিল বেশি। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মুখনিঃসৃত কথাকেই বলা হয় সংলাপ। যে অভিনেতা বা অভিনেত্রীর ‘ডায়ালগ থ্রোয়িং’ অর্থাৎ সংলাপ উচ্চারণ যত বেশি শুদ্ধ, স্পষ্ট এবং জড়তাবিহীন তিনি তত বেশি সমাদৃত দর্শক-শ্রোতাদের কাছে। যখন দেশে টেলিভিশনের ছড়াছড়ি ছিল না, তখন নাটকপিপাসু আমরা রেডিওতে প্রচারিত নাটক শুনে তৃপ্ত হতাম। রেডিওর নাটক পুরোটাই হয় সংলাপনির্ভর। পাত্র-পাত্রীর সংলাপ শুনেই ঘটনার চিত্র মনে এঁকে নিতে হয়। চোখে দেখা না গেলও মনের দেখা ও কানে শোনা ওইসব নাটক খুবই শ্রোতাপ্রিয় ছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশ বেতারের ঢাকা কেন্দ্রের প্রতি রবিবার দুপুর আড়াইটায় এবং প্রতি বুধবার রাত পৌনে ১০টায় প্রচারিত নাটক ট্রানজিস্টারের সামনে বসে হাঁ করে শুনতাম। আমার মনে আছে, মাথার কাছে ট্রানজিস্টার রেখে খুব অল্প ভলিউমে রাতের নাটকটি শুনতাম। সে সময় গ্রামে রাত ৮টা বাজলেই সবকিছু নীরব নিস্তব্ধ হয়ে যেত। তাই পৌনে ১০টা, মানে গভীর রাতে রেডিওতে নাটক শুনছি, তা যেন বাবা-মা টের না পান, সেজন্য এ সতর্কতা। এসব নাটক শোনার পর তা নিয়ে সমঝদার বন্ধুদের মধ্যে আলোচনা-পর্যালোচনাও হতো। কোন নাটকের কাহিনি বাস্তবনির্ভর, কোন অভিনেতা-অভিনেত্রীর সংলাপ ছিল শ্রুতিমধুর তা নিয়ে তর্কবিতর্কও হতো। আবার সিনেমা নিয়েও একই ধরনের আলোচনা হতো। এখন কেউ রেডিওতে নাটক শোনে কি না জানা নেই। টিভি-নাটকও আগের দর্শকপ্রিয়তা হারিয়েছে। আর সিনেমার যে মন্বন্তর চলছে তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের কৈশোর বা যুব বয়সে কোনো কোনো নাটক-সিনেমা এতটাই দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করত যে, এর কোনো কোনো নায়ক-নায়িকা বা চরিত্রাভিনেতার উচ্চারিত সংলাপ বা ডায়ালগ মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হতো। এখন আর তা শোনা যায় না। তবে নাটক-সিনেমার ডায়ালগ জনপ্রিয়তা হারালেও তা একেবারে হারিয়ে যায়নি। স্থান বদল করে বেশ ভালোভাবেই টিকে রয়েছে। নাটক-সিনেমার পরিবর্তে তা এখন আমাদের রাজনীতিতে বেশ পাকাপোক্ত স্থান করে নিয়েছে। সংবাদমাধ্যমের খবরে বা আলোচনায় প্রায়ই শোনা যায় সে কথা। কোন দল কার সঙ্গে সংলাপে বসছে, কোন সংলাপের ফল কী হতে পারে এসব নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা মন্তব্য-বিশ্লেষণের অন্ত নেই। সাধারণত যখন দেশের রাজনীতিতে সমস্যা-সংকট ঘনিয়ে আসে তখনই আবির্ভূত হয় সংলাপ। শোনা যায়, ‘সমস্যার সমাধান বা সংকট নিরসনে সংলাপ শুরু হচ্ছে’।

রাজনীতিতে সমস্যা-সংকট নতুন কোনো বিষয় নয়। যখন থেকে রাজনীতি নামের ক্রিয়াকর্মটির শুরু, তখনই সমস্যা-সংকটেরও আবির্ভাব। তবে আগের দিনে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে সরকার কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেসব আলোচনা হতো, সেগুলো ‘সমঝোতা বৈঠক’, ‘আলোচনা’ হিসেবে অভিহিত হতো। একাধিক দল যখন সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বসত, তখন বলা হতো ‘গোলটেবিল’ আলোচনা। কটি গোলটেবিল বৈঠকের কথা আমার মনে আছে। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আহূত গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন। সে সময় দেশের বামপন্থি দলগুলো ওই গোলটেবিল বৈঠকের বিরোধিতা করে স্লোগান দিয়েছিল, ‘গোলটেবিলে যাবে যারা, আইয়ুব খানের দালাল তারা’। এমনকি মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও ওই বৈঠকের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে আইয়ুবের গোলটেবিলে যোগ দিতে নিষেধ করে বলেছিলেন, এসব গোলটেবিল বৈঠক পূর্ব বাংলার মানুষের মুক্তি এনে দিতে পারবে না। তা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু সেই গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবেই। বলা বাহুল্য, সেই গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হয়েছিল, কোনো সফলতা বয়ে আনেনি। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতনের মধ্য দিয়েই সে সময়ের সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটের আপাত সমাধান হয়েছিল। তবে পূর্ব বাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশের মুক্তি আসেনি। সে মুক্তি শেষ পর্যন্ত এসেছিল একটি সশস্ত্র ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে। এখন আর রাজনৈতিক দল বা সরকারের মধ্যে গোলটেবিল বৈঠকের কথা শোনা যায় না। গোলটেবিল এখন আশ্রয় নিয়েছে জাতীয় প্রেস ক্লাব এবং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে। রাজনৈতিক দল এবং তাদের অনুগামী-অনুসারী নানা কিসিমের খুচরো সংগঠনের আয়োজনে হয়ে থাকে সেসব গোলটেবিল আলোচনা। সেসব কথিত গোলটেবিল আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা রাজনৈতিক বক্তৃতা করেন পল্টনি কায়দায়। ওইসব বক্তৃতা শুনলে ওগুলোকে আর গোলটেবিল আলোচনা মনে হয় না। যেন জনসভার মাইক্রো সংস্করণ। যদিও দেশের রাজনৈতিক ঘটনাক্রমে ওইসব গোলটেবিল কতটা ভূমিকা রাখছে তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে ওইসব অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করে অনেক অপরিচিত রাজনৈতিক কর্মী বেশ পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। শোনা যায়, একশ্রেণির বক্তা রয়েছেন যারা ওই ধরনের আলোচনায় অংশ নেওয়ার আশায় প্রতিদিনই প্রেস ক্লাব-ডিআরইউর আশপাশে ঘুরঘুর করেন আর সুযোগ বুঝে একটা বক্তৃতা করার মওকা খুঁজে নেন।

কথা শুরু করেছিলাম সংলাপ নিয়ে। একসময়ের গোলটেবিল আলোচনা এখন রূপ নিয়েছে সংলাপের। সরকার বনাম বিরোধী রাজনৈতিক দল, সমমনা রাজনৈতিক দল কিংবা মত ও পথের ভিন্নতার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মাঝেমধ্যেই সংলাপের কথা শোনা যায়। বর্তমানে দেশে চলছে সংলাপের মৌসুম। একদিকে নির্বাচন কমিশন সংলাপ চালাচ্ছে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে, অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সংলাপ শুরু করেছে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিপরীতে ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’ গড়ে তোলাই এ সংলাপের ঘোষিত উদ্দেশ্য। তবে লক্ষণীয় হলো, এ পর্যন্ত তারা যে কটি দলের সঙ্গে সংলাপ করেছে, তার সবকটিই তাদের পূর্বতন জোটের অংশীদার। পুরনো সহগামীদের সঙ্গে নতুন সংলাপকে অবশ্য কেউ কেউ ‘নতুন বোতলে পুরনো মদ’ প্রবাদের সঙ্গে তুলনা করতে চান। তা যে-যা খুশি বলুন তাতে কীই-বা আসে যায়। রাজনীতিতে একটা কিছু হচ্ছে এটাই বড় কথা। সবচেয়ে বড় কথা, তাদের এ ‘সংলাপ’ সংবাদমাধ্যমগুলোর দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদা কিছুটা হলেও মেটাতে সাহায্য করছে। বিএনপি ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’ গড়ার লক্ষ্যে সংলাপ শুরু করলেও তাদের কয়েকটি পুরনো মিত্র ইতোমধ্যে সাতদলীয় ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ গঠনের কাজ শুরু করেছে। তাদের এ নতুন মঞ্চ দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে বিশেষ কোনো প্রভাব না ফেলতে পারলেও বিএনপির বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার পথে যে ‘নাটাবনের চোরাকাঁটা’ হয়ে পায়ে বিঁধবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। শোনা যাচ্ছে, নিজেদের জোটের পরিধি বিস্তারের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগও তাদের মিত্রদের সঙ্গে শিগগিরই সংলাপ শুরু করবে। নির্বাচন কমিশন এ পর্যন্ত বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ সেরেছে। তাতে অংশ নেওয়া অধিকাংশ রাজনৈতিক দল আগামী নির্বাচনে ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে প্রবল আপত্তি জানিয়েছে। অবশ্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের অনুগামীরা ইভিএমে তাদের অনাপত্তির কথা জানিয়েছে। বিএনপি নির্বাচন কমিশনের সংলাপ বর্জনের ঘোষণা দিয়ে বলেছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা না হলে তারা কোনো সংলাপে অংশ নেবে না। তারা অবশ্য একই শর্ত দিয়ে বলে চলেছে, দাবি পূরণ না হলে তারা নির্বাচনেও অংশ নেবে না।

জাতীয় নির্বাচন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করার ক্ষেত্রে বিএনপি-আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ একটা বড় পূর্বশর্ত তা নিয়ে কারও কোনো দ্বিমত আছে বলে মনে হয়ে না। স্বাধীন বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট যে, এ দুটি দলের অংশগ্রহণ ছাড়া অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো কখনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ১৯৮৮, ১৯৯৬ (১৫ ফেব্রুয়ারি) ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন তার উদাহরণ। দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের সাবলীল পথপরিক্রমণের স্বার্থেই জাতীয় নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ অতীব জরুরি, এটা সবাই স্বীকার করেন। কিন্তু আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রশ্নে বিএনপি যে অবস্থান নিয়েছে এবং এখন পর্যন্ত যে ধরনের অনড়তা প্রদর্শন করে চলেছে, তা দেশকে শেষ পর্যন্ত কোন পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যায় এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে অবস্থাদৃষ্টে এটা অনুমান করা যায় যে, বিএনপি নির্বাচন কমিশনের সংলাপ বর্জন করায় তা নিষ্ফল হতে পারে। যদিও প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, তাঁরা বিএনপির জন্য শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। তবে তাঁদের সে অপেক্ষার পালা শেষ পর্যন্ত শেষ হবে কি না তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় রয়েছে। বলা বোধকরি অতিশয়োক্তি হবে না, নির্বাচন কমিশনের এ সংলাপ থেকে কোনো ফল বেরিয়ে আসবে না। রাজনৈতিক সংকট নিরসনে আমাদের দেশে অনেক সংলাপ হয়েছে অতীতে। কিন্তু এর কোনোটিই কোনো সমাধান এনে দিতে পারেনি। মনে থাকার কথা, প্রেসিডেন্ট এরশাদ ১৯৮৪ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতায় আসার লক্ষ্যে বঙ্গভবনে সংলাপের অয়োজন করেছিলেন। তাঁর প্রথম আহ্বানে একটি রাজনতিক দলও সাড়া দেয়নি। দ্বিতীয় দফার সংলাপে অনেক দল অংশ নেয়। বিএনপি অংশ নিতে গেলেও বৈঠকে সাতদলীয় জোট ত্যাগ করে এরশাদ ক্যাবিনেটে প্রধানমন্ত্রী হওয়া আতাউর রহমান খানকে দেখে বেগম খালেদা জিয়া ‘বিট্রেয়ারের সঙ্গে কোনো বৈঠক নয়’ বলে সটান চলে এসেছিলেন। এরশাদের ওই সংলাপ ব্যর্থ হয়। এরশাদ জমানার রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হয়েছিল শেষ পর্যন্ত রাজপথে ১৯৯০ সালে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর আন্দোলনে সৃষ্ট সংকট নিরসনেও সংলাপ হয়েছিল। কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যায়নি। সমাধান হয়েছিল রাজপথে বিএনপি সরকারের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে। ২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের শেষ সময়ে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফলে নির্বাচন নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ সংলাপ হয় বিএনপি মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া এবং আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের মধ্যে। সপ্তাহখানেক তাঁরা ‘আলোচনা অগ্রগতি হচ্ছে’ বলে সাংবাদিকদের জানালেও পরে জানা গেল সংলাপ ব্যর্থ হয়েছে। সেবার সংকট নামের বিষফোঁড়ার উপশম হয়েছিল জরুরি অবস্থা জারির মধ্য দিয়ে। সময়ে সময়ে সৃষ্ট আমাদের রাজনৈতিক সংকট এবং তা সমাধানকল্পে আহূত সংলাপগুলোর পরিণতি এ কথাই বলে যে ‘সংলাপ’ ফলপ্রসূ হয় না। তাই অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে দেশের চলতি সংলাপ প্রক্রিয়ার সফলতা নিয়ে সংশয় ব্যক্ত করা বোধকরি একেবারে অমূলক হবে না।

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর