শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা
ইতিহাস

মাৎস্যন্যায়

মাৎস্যন্যায়

রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর থেকে পাল রাজবংশের অভ্যুদয়ের আগ পর্যন্ত বাংলার রাজনীতিতে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করে। প্রায় সমসাময়িক লিপি, খালিমপুর তাম্রশাসন ও সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতম কাব্যে পাল বংশের অব্যবহিত পূর্ববর্তী সময়ের বাংলার নৈরাজ্যকর অবস্থাকে ‘মাৎস্যন্যায়’ বলে উল্লেখ করা হয়। খ্রিস্টীয় আট শতকের প্রথমার্ধে পুনঃ পুনঃ বৈদেশিক আক্রমণে বাংলা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল কনৌজ রাজ যশোবর্মণের (৭২৫-৭৫২ খ্রি.) আক্রমণ। কাশ্মীরের ললিতাদিত্য যশোবর্মণের গৌরব ম্লান করে দেন। গৌড়ের পাঁচজন রাজা ললিতাদিত্য কর্তৃক পরাজিত হয়েছিলেন বলে কলহন (কাশ্মীরের ইতিহাসবিদ) উল্লেখ করেন। এ থেকে গৌড়ের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কেন্দ্রীয় শক্তির অভাবে স্থানীয় প্রধানরা স্বাধীন হয়ে ওঠেন এবং নিজেদের মধ্যে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে লিপ্ত হন। পুনঃ পুনঃ বৈদেশিক আক্রমণ রাজনৈতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করে এবং তাতে বিচ্ছিন্নতার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। তাই শশাঙ্কের মৃত্যু-পরবর্তী ১০০ বছর বাংলায় কোনো স্থায়ী সরকারব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারেনি বলা চলে। গোপালের উত্থানের আগে খ্রিস্টীয় আট শতকের মাঝামাঝি সময়ের রাজনৈতিক অবস্থাকে খালিমপুর তাম্রশাসনে (পাল আমলের লিপি) মাৎস্যন্যায় বলে উল্লেখ করা হয়। তিব্বতী সন্ন্যাসী তারনাথ ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে ‘ভারতে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস’ গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি এ মত সমর্থন করে লিখেন : ‘প্রত্যেক ক্ষত্রিয়, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, ব্রাহ্মণ ও বণিক নিজ নিজ ঘরে (অথবা প্রভাবাধীন এলাকায়) ছিলেন এক এক জন রাজা, কিন্তু সমগ্র দেশে কোনো রাজা ছিলেন না।’

সংস্কৃত শব্দ ‘মাৎস্যন্যায়ম্’ বিশেষ অর্থবহ। কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’-এ (১.৪.১৩-১৪) শব্দটির নিম্নরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে : যখন দন্ডদানের আইন স্থগিত বা অকার্যকর থাকে তখন এমন অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয় যা মাছের রাজ্য সম্পর্কে প্রচলিত প্রবচনের মধ্যে পরিস্ফুট। অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত বড় মাছ ছোটটিকে গ্রাস করে, কারণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অবর্তমানে সবল দুর্বলকে গ্রাস করবেই। সমসাময়িক পাল লিপিতে এ অর্থবহ শব্দটির প্রয়োগ করে বাংলার তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার মতো শক্তিশালী শাসন ক্ষমতার অভাবে সম্পূর্ণ অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। উপরোক্ত বিবরণ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, শশাঙ্কের রাজত্বের পরবর্তী শতকে বাংলায় শাসন খুব অল্পই স্থিতিশীল ছিল। দেশটি অনেক ছোট ছোট রাজ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং তাদের পারস্পরিক যুদ্ধবিগ্রহের ফলে অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হয়। আইনশৃঙ্খলা বিধানে সক্ষম কোনো শক্তির অনুপস্থিতির ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা-ই মাৎস্যন্যায়। সে সময়ে দৈহিক শক্তির প্রাধান্যে দেশজুড়ে চলছিল অবাধ্য শক্তির উত্তেজনা। পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল এ বিশৃঙ্খল অবস্থায় রাজক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন এবং মাৎস্যন্যায়ের অবসান ঘটান।

গোপাল কীভাবে ক্ষমতায় আসেন তা নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। কেউ কেউ যুক্তি দেখান, জনগণই গোপালকে রাজা নির্বাচিত করে। তিনি কিছুসংখ্যক প্রভাবশালী ব্যক্তি বা নেতার সমর্থন লাভ করেই রাজা হন ও মাৎস্যন্যায়ের অবসান ঘটিয়ে জনসমর্থন লাভ করেন। পাল লিপিতে দাবি করা হয়েছে, ‘গোপাল বেপরোয়া ও স্বেচ্ছাচারী লোকদের পরাভূত করে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর