শুক্রবার, ২৬ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

মৃত্যুকূপ ঢাকা : অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে

রণেশ মৈত্র

মৃত্যুকূপ ঢাকা : অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে

বাঙালি জাতির জন্য সর্বাধিক শোকাবহ, বেদনাক্রান্ত একটি দিন ১৫ আগস্ট। ১৯৭৫ সালে মর্মান্তিক হত্যালীলায় আমরা হারিয়েছিলাম আমাদের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের প্রায় সবাইকে। সেই আঘাতের বক্তক্ষরণ আজও থামেনি, থামতে পারে যদি কোনো দিন বঙ্গবন্ধু হত্যার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র নির্মোহভাবে উদ্ঘাটিত হয় এবং সব ষড়যন্ত্রকারীকে বিচার করে তাদের প্রাপ্য শাস্তি দেওয়া হয়। যেহেতু দীর্ঘ ৪৭ বছরেও এ ব্যাপারে আমাদের রাষ্ট্র কোনো কাজই শুরু করেনি, তাই উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ কাজটি আদৌ কোনো দিন হবে- এমন বিশ্বাস খুব একটা আস্থার সঙ্গে করা যাচ্ছে না। যা হোক, ১৫ আগস্টের অতীত ইতিহাস ঘাঁটা আজকের এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। এ বছর ১৫ আগস্টে সবার মনে বিপুলভাবে ধাক্কা দেওয়া দুটি হত্যাকান্ডের নির্মোহ বিশ্লেষণ প্রিয় পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে চাইছি। কী ঘটেছিল চকবাজারে!

একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় লাল রঙা ব্যানার হেডলাইনে ‘কে নেবে এই ১১ জীবনের দায়’ শিরোনামে লিখেছে : পুরান ঢাকার চকবাজারে একটি হোটেলের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে একই ভবনে থাকা প্লাস্টিক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটেছে। এতে ঘুমন্ত অবস্থায় দগ্ধ হয়ে ছয়জন নিহত হয়েছেন। ১৫ আগস্ট সোমবার দুপুর ১২টার দিকে চাঁদনীঘাটের দেবীদাস ঘাটের কামালবাগে এ ঘটনা ঘটে। ১০টি ইউনিটের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার ব্রিগেড। আগুনে নিহতরা সবাই বরিশাল হোটেলের কর্মচারী বলে স্বজনরা জানান।

প্রত্যক্ষদর্শীরা ঘটনা সম্পর্কে বলেন, প্রথমে হোটেলের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর আগুন প্রথমে বিদ্যুতের ট্রান্সফরমারে যায়। সেখানে আরেক দফা বিস্ফোরণের পর একই ভবনের পাটাতনের ওপর থাকা প্লাস্টিকের খেলনা তৈরির কারখানায় আগুন লাগে। নিহতরা রাতের শিফটে কাজ করে ভোরে ঘুমিয়ে ছিলেন হোটেলের পাটাতনের ওপর।

নিহত বিল্লালের বোন রুমা বেগম জানান, কাজে এতটাই ব্যস্ত যে কথা বলারও সময় পেত না বিল্লাল। অনটনের সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে মরিয়া ছিলেন তিনি।  স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের বাড়িতে রেখে কাজের সন্ধানে বরিশালের মুলাদী থেকে ঢাকায় এসেছিলেন বিল্লাল। কিন্তু তার আর বাড়ি ফেরা হলো না। নিহত ওসমানের ভাই ইকবাল সরদার জানান, করোনা মহামারি শুরুর আগে কুয়েতে পাড়ি দিয়েছিলেন ওসমান। তাদের বাড়ি শরীয়তপুরের গোসাইরহাট। কিছুদিন যেতে বাড়িতে টাকা পাঠাতে শুরু করেন ওসমান। কিন্তু করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর তাকে চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে আসতে হয়। তিন ভাই, তিন বোনের মধ্যে ওসমান মেজো। অবশেষে বরিশাল হোটেলে চাকরি পেলেন তিনি। বেতন দৈনিক মজুরি হিসেবে ৬০০ টাকা।

নিহত স্বপন সরকারের চাচাত ভাই বাদশাহ সরকার জানান, তিনি থাকেন যাত্রাবাড়ী। হোটেলের কাজ শেষ হলেই স্বপন দেখা করতে যেত ভাইয়ের সঙ্গে। স্বপনের বাড়ি হবিগঞ্জের বামৈন গ্রামে। বাদশাহ জানান, স্বপন ১২টার দিকে ফোন করে জানান আগুন লাগছে। এরপর আর ভাইয়ের খবর নেই। এখন তাকে স্বপনের লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। সপ্তাহ তিনেক আগে বরিশাল হোটেলে যোগ দিয়েছিলেন কুমিল্লার চান্দিনার ছেলে শরীফ। কাজ করতেন দৈনিক ২০০ টাকা বেতনে। পরিবারের দুঃখ মেটাতে ঢাকা এসেছিলেন কাজের সন্ধানে। কিন্তু আগুন তার স্বপ্ন কেড়ে নিল। বরিশালের হিজলা উপজেলার শংকরপাশা গ্রামের এক অভাবী পরিবারের ছেলে মোতালেব। পরিবারে অভাব ছিল এত তীব্র যে মাত্র সাত বছর বয়সে তাকে ঘর ছাড়তে হয়েছিল জীবিকার তাগিদে। নিজ জেলায় নানা জায়গায় কাজের পর মোতালেব চলে আসে ঢাকায়। বিভিন্ন হোটেলে কাজ করে। শেষে বরিশাল হোটেলে। মা মমতা বেগমকে সে সব সময় বলত, মা চিন্তা কোরো না। আমি কাজ করে টাকা পাঠামু তোমার জন্য। সেই মোতালেবের নিথর দেহ ফেরত গেল মায়ের কোলে। গার্মেন্টে চাকরি হারিয়ে মেসিয়ারের কাজ পেয়েছিল মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার বাঁশবাড়ী ইউনিয়নের বাসিন্দা মোহাম্মদ রুবেল। বীর মুক্তিযোদ্ধা সাত্তারের ছেলে রুবেলও বিভিন্ন গার্মেন্টে কাজ করে করোনা মহামারিতে চাকরি হারান। বহুদিন বেকার থাকার পর চাকরি জোটে বরিশাল হোটেলে। চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে রুবেল ফিরে গেলেন সুপূর গ্রামে তার প্রিয়জনদের কাছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা দেখেছেন, সরু একটা গলি কামালবাগ মহল্লায়। গলির দুই পাশেই গড়ে উঠেছে কারখানা ও কেমিক্যালের দোকান। দোকানের পেছনেই আবাসিক এলাকা। কারখানা ও দোকানের ব্যবসায়ী-কর্মচারীরা সবাই ওই এলাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন। দুপুরে আগুনের ঘটনার পরপরই স্থানীয়রা পাইপ ও বালতি করে জল এনে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। প্রায় ২ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও ছয়জনের পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া দেহ উদ্ধার করা হয়। প্রতিটি ঘটনার পর পত্রপত্রিকায় তার নানা দিক তুলে ধরে অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। নিতান্ত স্বল্পকালের জন্য হলেও মনে হয় সরকার কঠোর ভূমিকা নিতে চলেছে। কিন্তু কিছুদিন পরই সব হিমশীতল হয়ে যায়, চাপা পড়ে যায় ঘটনা। সবকিছু অতীতের মতোই স্বাভাবিক হয়ে আসে।

উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে বলা হয় পুরান ঢাকায় কোনো কেমিক্যাল গোডাউন বা তার দোকান বা কোনো দাহ্য পদার্থের দোকান-গুদাম রাখা চলবে না। সরিয়ে নিতে হবে নির্দিষ্ট এলাকায়; কিন্তু তা আর হয় না। সব যেমন ছিল তেমনই থাকে। ফিরে ফিরে আসে মৃত্যুর ক্রন্দন। এখন প্রশ্ন ওঠে, মানুষের জীবন বাঁচাবার, কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থের গুদাম বা দোকান নিরাপদ এলাকায় সরানোর যে নির্দেশ ঘটনাকালে সরকার দিয়ে থাকে তা কার্যকর হয় না কেন? গুদাম ও দোকান মালিকরা সে নির্দেশ মানেন না, না মানার ফলে তাদের কোনো শাস্তি ও গুদাম, দোকান অপসারণের কার্যকর ব্যবস্থা সরকারিভাবে গ্রহণ করা হয় না কেন? তাই অবৈধ কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থের গুদাম ও দোকান মালিকরা এবং সরকার অবহেলা করার ফলেই যে কিছুকাল পরপরই এমন ঘটনা একের পর এক ঘটে চলেছে তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

অবশেষে ফায়ার সার্ভিস বলেছে, চকবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার আশপাশের সব ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ। সরকার কি দেখবে এবং তৎপর হবে ওই এলাকার জনজীবনের নিরাপত্তা বিধানে। সমগ্র ঢাকা শহরের সব কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থের গুদাম ও দোকান অপসারণ করে মানুষের জীবন বিপন্মুক্ত করতে?

একই দিন উত্তরায় চলন্ত প্রাইভেট কারে গার্ডার পড়ে একই পরিবারের পাঁচজন নিহত হয়েছেন। বিষয়টি এমনিতেই অনেক শোকাবহ। আরও শোকাবহ হয়ে পড়েছে যখন জানা গেল বউভাত-পরবর্তী ফিরতি একটি পরিবারের সব সদস্যই তাদের চলন্ত প্রাইভেট কারের ওপর অকস্মাৎ একটি ক্রেন থেকে গার্ডার পড়ে গাড়িটি যেমন থেঁতলে চুরমার হয়ে যায়, পাঁচ যাত্রীও তাতে তখন তখনই মৃত্যুর অসহায় শিকারে পরিণত হন। আহত হয়েছেন আরও দুজন। ১৫ আগস্ট সোমবার বিকালে উত্তরার জসীমউদ্দীন মোড়ে প্যারাডাইস টাওয়ারের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। আহত হন নবদম্পতি।

দুর্ঘটনায় নিহতরা হলেন- রুবেল মিয়া (৬০), ফাহিমা (৩৭), ঝরনা (২৬), জান্নাতুল (৬) ও জাকারিয়া (৪)। আহত বর-বধূ হৃদয় (২৫) ও রিয়া মণি (২১)। দুর্ঘটনায় নিহত রুবেল মিয়া ও ফাহিমা বরের মা-বাবা। ঝরনা রিয়া মণির খালা। আর নিহত দুই শিশু ঝরনার সন্তান। বিয়ের দুই দিন পর বৌভাত শেষে তাদের নিয়ে আশুলিয়ার বাসায় ফিরছিলেন রুবেল মিয়া। কিন্তু  তারা কি জানতেন এ যাত্রাই তাদের শেষ যাত্রা? আবার আহত অবস্থায় হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন নবদম্পতি উভয়ে।

কিন্তু সবাই জানি, স্বাভাবিক সংসার জীবন চালাতে ওই দম্পতির উভয়েরই হয়তো অনেক সময় লেগে যাবে। তত দিনে মেহেদির রং তো বিবর্ণ হয়ে আসবে উভয়ের চোখের জলও দিব্যি শুকিয়ে আসবে। তাদের জীবন দুঃসহ যন্ত্রণায় বহুদিন কাতরাবে।

সবশেষে জানা গেল, ত্রুটি ছিল ওই গার্ডার-ক্রেন প্রভৃতিতে; যার জন্য কন্ট্রাক্টর দায়ী। কিন্তু বিদেশি কন্ট্রাক্টরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়ে বিআরটির কর্তাব্যক্তিরা কি রেহাই পেতে পারেন? জানা যাচ্ছে, ক্রেনের শক্তির চাইতে বেশি ভারী ছিল গার্ডার। যদি তা সত্য হয় তবে গার্ডার যে রাস্তায় ভেঙে পড়বে তাতে তো আশ্চর্য হওয়ার কিছু দেখি না।

এখানে মিলিয়ন ডলার মূল্যের প্রশ্নটি হলো- এ প্রকল্পের কাজ চালানোর কি নীতিমালা নির্ধারিত হয়েছিল? কী পরিমাণ শক্তিসম্পন্ন ক্রেন কন্ট্রাক্টর ব্যবহার করতে পারবেন বলে স্থির করা হয়েছিল? দিনের বেলায় ওই ব্যস্ত রাস্তার ধারে ক্রেন-গার্ডার ব্যবহারসংক্রান্ত কোনো নীতিমালা যদি আগে নির্ধারিত না হয়ে থাকে তবে বিআরটি কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তার দায় কীভাবে এড়াবে? আসলে আমাদের দেশে মৃত্যুর চেয়ে সস্তা আর কিছু নেই। মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যহীন সরকারের কাছে আর কিছুই নেই। তাই দায় এড়াতে কন্ট্রাক্টরকে দোষী সাব্যস্ত করা, যেন গোটা রাস্তার এবং রাস্তার ধারের (উভয় পাশে) সবকিছুই কন্ট্রাক্টরের কাছে লিজ দিয়ে বসেছিলেন। ওই লিজের তালিকায় চলন্ত গাড়ি-ঘোড়া, পথচারী, অসংখ্য মানুষ- সবাই পড়েন। বস্তুত নিরাপত্তাহীন নির্মাণের খেসারত একের পর এক দিতে হচ্ছে।

চকবাজারের ঘটনায় বরিশাল হোটেলের মালিককে দায়ী করে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়নি সেই কর্তৃপক্ষকে যারা পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন ও দাহ্য পদার্থের গুদাম দোকান সরাননি তাদের। তারা অতীতের মতো এবারও পার পাবেন। আবার উত্তরার মতো ঘটনা অতীতে আরও কয়েকবার ঘটলেও উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মানুষের মৃত্যুর মিছিল লম্বা হচ্ছেই।

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর