মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

পিতার সমাধিতে অর্ঘ্য নিবেদনে টুঙ্গিপাড়ায়

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

পিতার সমাধিতে অর্ঘ্য নিবেদনে টুঙ্গিপাড়ায়

নির্বাচন কমিশন এমনিতেই জাতীয় আস্থা অর্জন করতে পারেনি। তার ওপর আবার হুট করে ১৫০ আসনে ইভিএমে নির্বাচনের ঘোষণায় আরও অনাস্থার শিকার হলো। নির্বাচন কমিশনের ৭০ আসনে ইভিএমের সক্ষমতা আছে তা নিয়েই ১৫০ আসনে নির্বাচনের ঘোষণা, মানে আরও ৮০ আসনে নতুন করে ইভিএম কিনতে হবে। নির্বাচন কমিশনের এ ঘোষণা গাড়ির আগে ঘোড়া না জুড়ে ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়ার মতো খুবই খারাপ সিদ্ধান্ত। এটা কেউ মানবে না। গভীর ভারাক্রান্ত দেহমনে পিতার কবরে টুঙ্গিপাড়া চলেছি। দেখতে দেখতে কত দিন কেটে গেল। যেখানে বসে লিখছি, এ ঘরেই ১৯৭৫-এর ১৪ আগস্ট রাত ২টায় এসে শুয়ে ছিলাম। অমন মরণ ঘুম আর জীবনে ঘুমাইনি। ১৪ তারিখ রাত ১টা ৪০ মিনিটে ধানমন্ডিতে দেখে এসেছিলাম। সে-ই ছিল পিতার সঙ্গে শেষ দেখা। কোথায় ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট আর আজ ২০২২ সালের ৩০ আগস্ট। পদ্মা-মেঘনা-যমুনার কত পানি গড়িয়ে গেছে, কত উথালপাথাল হয়েছে। কিন্তু আমার, আমার পরিবারের ভাগ্য বদল হয়নি। করোনায় গৃহবন্দির ফলে আড়াই-তিন বছর জীবন থেকে হারিয়ে গেল। মাঝে একবার খুবই অসুস্থ হয়েছিলাম। কিছুদিন তো হাত-পা নাড়াচাড়ায়ও কষ্ট হতো। কেন যেন আবার সবকিছু আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। যদিও এখন আর ৫-৭-১০ মাইল হাঁটতে পারব না। কিন্তু কিছুদিন আগে যে নিচতলা থেকে দোতলা, দোতলা থেকে নিচতলা ওঠানামা করতে পারতাম না সেসব কোথায় যেন কর্পূরের মতো উড়ে গেছে। অনেকদিন থেকেই মনটা ছটফট করছে পিতার কবরে যেতে। প্রথম ভেবেছিলাম পারিবারিকভাবে ১০-২০ জন যাব। মনের কথা বাইরে বেরোতেই শুরু হয় কর্মীদের মধ্যে ঝাঁপাঝাঁপি, তারা নিজের খরচে যাবে, আমাকে কিছুই করতে হবে না। তবু তারা টুঙ্গিপাড়ায় পিতার সমাধিতে যাবে। তাই আর আপত্তি করিনি। অনেকে অর্থ সাহায্য করেছেন। তাই পিতার সমাধিতে যাওয়ায় কোনো অসুবিধা হবে না। মনে হয় রাস্তাঘাটেও তেমন কষ্ট হবে না।

১৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ৫টা-৬টায় ঘর ছেড়েছিলাম, যে ঘরে বসে লিখছি। ১৬ বছর আর দেশে ফেরা হয়নি, ঘরে ফেরা হয়নি। ’৯০ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশে ফিরে ১৮ ডিসেম্বর চার-পাঁচ শ নেতা-কর্মী নিয়ে প্রথম টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে টুঙ্গিপাড়া সে যাত্রায় লেগেছিল ১৮-২০ ঘণ্টা। তখন মাওয়া রাস্তা ছিল না। আরিচা-ফরিদপুর-ভাঙ্গা-টেকেরহাট আরও কোথায় কোথায় দিয়ে যেতে হতো। রাস্তা হতো প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু হওয়ায় রাস্তা হবে ১৬০-৭০ কিলোমিটার। পদ্মা পারাপারে লাগত দেড়-দুই ঘণ্টা, ওঠানামায় লাগত আরও দুই ঘণ্টা। এখন সেখানে লাগবে ৬-৭ মিনিট। এ এক দারুণ সুবিধা, আনন্দের বিষয়। প্রথম যাত্রায় নির্মলেন্দু গুণ ছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে আনোয়ার হোসেন পাহাড়ি, সবুর খান, এনায়েত করিম, নুরুল ইসলাম, মিলন সরকার। ’৯০-এর গণআন্দোলনে এরশাদ সরকারের পতনের পর জাতীয় পার্টির সব নেতা ছিলেন ঘরছাড়া, অবাঞ্ছিত। ছোট ভাই আজাদ-মুরাদ, রানা-বাপ্পী, মোবিল রতন আরও অনেকে গিয়েছিল। কোথায় ’৯০ আর কোথায় ২০২২- অনেকের নামই মনে নেই। কতজন কত গাড়ি নিয়ে হাজির হয়েছিল। ঢাকা সিটি করপোরেশনে আমার এক মুক্তিযোদ্ধা মজিবর চাকরি করত। মনে হয় উপসচিব। সেও গাড়ি নিয়ে হাজির। তখন ডিজেল ১২-১৩ টাকা, অকটেন ২০ টাকা। আর বঙ্গবন্ধু যখন নিহত হন তখন ডিজেল ৪ টাকা, অকটেন ৬ টাকায় রেখে গিয়েছিলেন। গাড়ির কোনো অভাব ছিল না। তেমন এলোমেলোও ছিল না। রাস্তাঘাটে সাধারণ মানুষ সে যে কি সহমর্মিতা দেখিয়ে ছিল কল্পনা করা যায় না। তখন আরিচার এপারে ডাব ২ টাকা, ওপারে ৮ আনা। সাজেদা চৌধুরীর নগরকান্দার তালমা মোড়ের কুদ্দুস দেওয়ান নামে এক ভদ্রলোক রাস্তার পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শুধু কাঁদি কাঁদি ডাব নিয়ে এক চমৎকার দা হাতে একটা করে কোপ দিচ্ছেন আর একেকজনের হাতে তুলে দিচ্ছেন। মনে হয় ১৫-২০ মিনিটে ২০০ লোকের হাতে ডাব তুলে দিয়েছিলেন। আমি দেখে তো অবাক, মানুষের হাত এত দ্রুত চলে, কোনো মানুষ এত আন্তরিক হতে পারে। অনেক পীড়াপীড়ি করে প্রথমে তাকে ৫০০ টাকা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তিনি কিছুতেই নেবেন না। ডাব খেতে কর্মী বন্ধুদের যে সময় লেগেছিল তার চাইতে বেশি সময় লেগেছিল পীড়াপীড়ি করে টাকা দিতে। কিছুটা বিরক্তি কিছুটা ভালোবাসা এই করে একপর্যায়ে ডাবওয়ালার ৮-১০ বছরের ছেলে, না মেয়ের হাতে ২০০০ টাকা গুঁজে দিয়েছিলাম। বাচ্চাটা ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেছিলাম তাকে। জানি না, সে কেমন আছে। ভালো আছে, না মন্দ, না নেই। তবে সেই ডাবওয়ালার কথা, কর্মীদের ডাব খাওয়ানোর কথা আমার সব সময় মনে পড়ে। জায়গাটা ফকির আলমগীরের বাড়ির আশপাশে। হয়তো একটু দূরে হতে পারে। ফকির আলমগীরও বেশ কয়েকবার ওই ডাবওয়ালার কথা আমার সঙ্গে আলাপ করেছেন।

প্রথমবার গিয়েছিলাম একেবারে গভীর রাতে ডানে-বাঁয়ে কিছুই দেখিনি। দ্বিতীয়বার গিয়েছিলাম ২০ আগস্ট ’৯১। দেশে ফিরে জেলে গিয়ে ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের চেষ্টায় সামরিক আদালতের মিথ্যা মামলা থেকে ১৮ আগস্ট মুক্তি পেয়ে ২০ আগস্ট টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলাম। সেবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নেত্রী শেখ হাসিনাও আগের দিন গিয়েছিলেন। অনেক যত্ন করেছিলেন। কারও কোনো থাকা-খাওয়ায় অসুবিধা হয়নি। বাড়ির মালিক থাকলে বাড়ি যেমন চনমনে থাকে সবকিছু ঠিক তেমনি ছিল। ফিরেছিলাম খুবই আনন্দে। শিবালয়ের কাছে রাস্তায় এক মালবোঝাই ট্রাক আটকে ছিল। কিছুতেই উঠতে পারছিল না। রেকার এনে সরানো ছাড়া কোনো পথ ছিল না। কাছে গিয়ে যখন দড়ি বেঁধে টান দিতে বলেছিলাম প্রায় সবাই বলছিল দড়িতে কোনো কাজ হবে না। ট্রাকের লোকজনকে বলেছিলাম কয়েকটা শক্ত দড়ি বেঁধে দিন বাকিটা আমরা দেখছি। পরে ট্রাকের লোকজন ৩-৪টি মোটা দড়ি বেঁধেছিল। তাতে পাঁচ-সাত শ-হাজার লোকের ধরার সুবিধা ছিল। ৫০-৬০-১০০ জন দড়ি ধরেছিল। আমি গিয়ে ধরতেই মনে হলো চারদিক থেকে উল্কার মতো মানুষ ছুটে এলো। সাত-আট শ লোক ‘বল বল আলি আলি’ বলতেই গাড়ি উঠে এলো। ৪-৫ মিনিটে রাস্তা পরিষ্কার। কতজনের কত কথা, কত মন্তব্য, ২-৩ ঘণ্টা বসে আছি। ২-৩ হাজারের নিচে গাড়ি হবে না। কাদের সিদ্দিকী এলো আর এক মিনিটে রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গেল। আমারও ভীষণ ভালো লেগেছিল। বারবার মনে হচ্ছিল আল্লাহ যেন জাতির বোঝা এভাবে হালকা করতে দেন। এমনি আরেকদিন নারায়ণগঞ্জে সভা করতে যাচ্ছিলাম। ফতুল্লার কাছে একটা ছোট ছোট বাঁশবোঝাই ভ্যান স্পিডব্রেকার পার হতে পারছিল না। গাড়ি থেকে নেমে ভ্যানটা ধরেছিলাম। মনে হয় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ১৫-২০ জন এসে হাত লাগিয়েছিল। আমিসহ আর দু-এক জনের ধাক্কাতেই অবলীলায় ভ্যানটি পার হয়ে যেতে পারত। সেখানে অত মানুষ। ভ্যানওয়ালা বুঝতেও পারেননি তার বোঝা অত হালকা হলো কী করে। কিন্তু অন্যের বোঝা আর হালকা করতে পারলাম না। ধীরে ধীরে কেমন যেন হয়ে গেল। এখন তো শুধু বোঝা আর বোঝা। যারা খেটে খায় তারা অনেকেই আর বইতে পারছে না। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন এক টাকা ছিল দিনমজুরি। এক টাকাতেই চাল-ডাল-নুন-তেল নিয়ে বাড়ি ফিরলে গৃহিণী তা দিয়েই সংসার চালাতে পারতেন। চার-পাঁচ জনের সংসার এক টাকা-পাঁচ সিকায় সুন্দর চলে যেত। এক টাকা সের গরুর মাংস, এখন ৭০০ টাকা। আট আনা সের সরিষার তেল, এখন ৩৫০ টাকা। তাই এখন পাঁচ-ছয় শ টাকায় দিনমজুরি করেও অনেকের পেটে ভাত নেই। চাল হয়তো এক কেজির জায়গায় দুই কেজি কিনতে পারেন। কিন্তু মাছ-মাংস-নুন-তেল কোনো কিছুরই ফের পায় না। এই যে কত দিন চা বাগানের শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন। ১২০ টাকা দিনমজুরি সকালের নাশতাতেই ফুরিয়ে যায়, সংসার চলবে কী করে?

বহুদিন পর যাচ্ছি টুঙ্গিপাড়া পিতার কবরে ফাতিহা পাঠ করতে। কতবার কতজন গেছে। প্রথমবার ডলফিনের মালিক কলাবাগানের রাজু ভাই কয়েকটা গাড়ি দিয়েছিলেন। রাজু ভাই আবার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর বন্ধু। জিগাতলার মোহসীন বুলবুল, রাজমণি ঈশা খাঁর আহসান উল্যাহ মণি কে যায়নি? বেশ কয়েকবার বোন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অসীম কুমার উকিল, প্রেসিডিয়ামের সদস্য হাবিবুর রহমান, রেন্টু, সেন্টু আরও অনেককে পাঠিয়েছেন। কতবার কত পরিশ্রম করেছেন ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান, আমাদের সবার প্রিয় আলী আকবর খান কালো খোকা, তার স্ত্রী মনোয়ারা, মেয়ে রুমানাকে নিয়ে গেছেন। যতবার গেছি টুঙ্গিপাড়ায় পিতার কবরে অনেকবারই আবুল কালাম আজাদ বীরবিক্রম, আনোয়ার হোসেন পাহাড়ি বীরপ্রতীক, ফজলুল হক বীরপ্রতীক, আবদুল্লাহ বীরপ্রতীক রাতদিন পরিশ্রম করেছেন। দল বেঁধে আখতারুজ্জামান ফিরোজ, আশরাফ খান রতন, তাঁর স্ত্রী বিউটি, বন্ধু হায়দার শিকদার, আবুল কালাম আজাদ, বায়জীদ, সোলেমান, হাফিজুল হক খান মিনু, মশিউর রহমান হিরণ, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জাহাঙ্গীরের ছোট ভাই আলমগীর, টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র জামিলুর রহমান মিরন, কিসলু, রানা-বাপ্পী, আজাদ-মুরাদ, কাজী শহীদ, প্রশান্ত, বিশ্বজিৎ নন্দী, জিন্নাহ আরও কতজন গেছেন তার হিসাব নেই। কয়েক বছর আমাদের কাজই ছিল টুঙ্গিপাড়া গিয়ে পিতার কবরের আশপাশের ২-৩ কিলোমিটার ঝাড়পোঁছ করে ঝকঝকে তকতকে করা। প্রথম প্রথম টুঙ্গিপাড়ার লোকজনের সাড়া না পেলেও এক-দুই বছর পর তারা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে। মনে হয় অনুষ্ঠানটি আমাদের নয়, অনুষ্ঠানটি তাদের। মুন্নি, মিলি, রুনু, মিতা, আক্কাস, আতিয়ার, নজরুলের মতো ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারা আরও বেশি করে আমায় উদ্দীপ্ত করে তোলে। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে ছোট ছোট শিশুরা পাল্লা দিয়ে পয়পরিষ্কারে অংশ নেয়। মনে হয় না আর কোথাও আমার পরিবারের সবাই ওভাবে কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছে। বাবা-মা, রহিমা, শুশু, শাহানা, আজাদ, মুরাদ, রোমেল, গালিব, ইয়ামনি, বাবু, রিম, জিৎ, ইমু, দুলাল কেউ বাদ থাকেনি। কুমিল্লার তাজু কিছুদিন হয় দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। টুঙ্গিপাড়ায় সে যে কি অভাবনীয় শ্রম দিয়েছে কল্পনা করা যায় না। যাতায়াতে শ্রমিক লীগ নেতা নারায়ণগঞ্জের শুকুর মামুদের কথা কখনো ভুলতে পারি না। উল্লাপাড়া কলেজের জিএস আবদুল জলিল মুক্তিযুদ্ধে কীভাবে কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। সে বিআইডব্লিউটিএতে চাকরি করত। টুঙ্গিপাড়ার প্রোগ্রাম হলে পাগলের মতো হয়ে যেত সাহায্য করতে। মানুষের সক্রিয় সাড়া পেলে কোনো কাজই যে কঠিন না তা তখন দেখেছি। সাভারের রাজীব যখন যেভাবে পারত আটা-ময়দা-লবণ-মরিচ-চাল-ডাল সংগ্রহ করে টুঙ্গিপাড়া নিয়ে যেত। রাতদিন কাজ করত হুমায়ুন, কুদ্দুস, কামাল, শাহীন, মঞ্জু, মিশলু, মিঠু, নিয়ামুল, মাসুদ, কামাল হোসেন, নজরুল, লুৎফর, মোস্তফা আরিফ বাবু, ঝলক, মনি, নবী, রিপন। একবার তো মোস্তফা আরিফ বাবুকে লক্ষ্য করেছিলাম ঢাকা থেকে টুঙ্গিপাড়া, টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকা কখনো তার হ্যান্ডমাইক বন্ধ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে যেমন অসংখ্য নিবেদিত কর্মী পেয়েছিলাম, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ যুদ্ধে যেমন ঠিক তেমনি দেশে ফিরেও হাজারো নিবেদিতপ্রাণ বঙ্গবন্ধুর ভক্ত-অনুরক্ত অনুসারী আমার সাথী হয়েছিল। হয়তো আমিই সফলভাবে তাদের কাজে লাগাতে পারিনি। এ ব্যর্থতা কর্মীদের নয়, আমার।

বড় ইচ্ছা ছিল সুফিয়া খালা টুঙ্গিপাড়া যাক। আমার সে ইচ্ছা পূরণ হয়েছিল মার সঙ্গে সুফিয়া খালা টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলেন। আমার অন্তরাত্মা জুড়িয়ে গিয়েছিল। টুঙ্গিপাড়া গিমাডাঙ্গা স্কুলমাঠে তাঁর কথা শুনে আমি বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। তাঁর কোনটুকু দেহ আর কোনটুকু আত্মা আলাদা করতে পারছিলাম না। কী করে যে তাঁরা এক ঐতিহাসিক ছবি তুলেছিলেন মা-খালা, বঙ্গবন্ধুর দুই বোন, পেছনে দাঁড়ানো আমার দুই বোন। ছবিটা যখনই দেখি তখনই বুক জুড়িয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর বোনেরা বঙ্গবন্ধুকে ভীষণ ভালোবাসতেন। আমার বোনেরাও ছিল ভাইদের জন্য পাগল। প্রাসঙ্গিক হবে কি না জানি না, নিজের কথা নিজে বলতে গেলে মুখে বাধে তবু ঘটনাটা ঐতিহাসিক বলে বলছি। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার পর তাঁর বোনজামাই সৈয়দ হোসেনকে গ্রেফতার করে জেলে রাখা হয়েছিল। তিনি ছিলেন ডায়াবেটিকসের রোগী। তাই ওষুধ পাঠানোর জন্য বঙ্গভবনে ফোন করেছিলেন। এ কথা-ও কথার পর বঙ্গভবনের ডেপুটি সেক্রেটারি সৈয়দ হোসেন সাহেবের স্ত্রী বঙ্গবন্ধুর বোনকে বলেছিলেন, তেমন কিছু বলবেন না। ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফোন ট্যাপ করে। কোনো ক্ষতি হতে পারে। বঙ্গবন্ধুর বোন তার স্বামীকে কীভাবে ওষুধ দিতে পারবেন এইটা জানতে চেয়েছিলেন। ডেপুটি সেক্রেটারির কথা শুনে বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘আমার ভাই কি তাহলে এক কাদের সিদ্দিকী ছাড়া আর সব ছাগল-ভেড়া রেখে গেছেন?’ বলে রাগ করে ফোন ছেড়ে দিয়েছিলেন। যাকে কথাটি বলেছিলেন তিনিই আমাকে বলেছেন। বড় চিন্তা হয় আমরা কেমন যেন হয়ে গেলাম।

গত মঙ্গলবারের লেখা পড়ে খুলনার ডা. মোস্তাফিজুর রহমান উতালা হয়ে ফোন করেছিলেন। বললেন, ‘খুব আগ্রহ নিয়ে আপনার লেখা পড়ি। যে মেজর বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিল তার নাম মেজর হায়দার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতা থাকতে সেই মেজর একবার নেত্রীর কাছে গিয়ে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর লাশ টুঙ্গিপাড়া নিয়ে যেতে কেউ রাজি ছিল না। আমি আগ্রহ নিয়ে গিয়েছিলাম। সুন্দর করে দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করেছিলাম।’ এমনই হয়। শুনেছি, ১৫ আগস্ট ৩২-এর বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাশ ভালোভাবে গোনাগুনতি করেছিলেন বলে আমার বোনের সরকারের আমলে কেউ কেউ প্রমোশন পেয়েছেন। এসব আমিও জানি। ডা. মোস্তাফিজুর জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করছিলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন এনএসএফ করতেন। লতিফ ভাইকে জিজ্ঞেস করবেন, তিনি জানেন। তিনি বলতে পারবেন। কাকে কী বলি! অমন অনেকেই করেছেন। আমার ওসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। আমার মাথাব্যথা জনাব মোমেন যে আমাদের বেহেশতে রাখলেন আবার ভারতকে সরকার টিকিয়ে রাখতে বললেন এসব নিয়ে যত কথা যত মাথাব্যথা।

এবার পিতার সমাধিতে এসেছি কবে চলে যাই, আল্লাহ কবে নিয়ে নেন তা তিনিই জানেন। পিতা জন্মেছিলেন টুঙ্গিপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান ও মোছা. সায়েরা খাতুনের ঘরে। তিনি তাঁর শ্রমঘাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও কর্ম দিয়ে ঘরকে জয় করেছিলেন, দলকে জয় করেছিলেন। সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির দূতে পরিণত হয়েছিলেন। সে কথাটিই তাঁর সমাধিতে দাঁড়িয়ে বলতে চাই, পিতা কোনো দলের নন, গোষ্ঠীর নন। পিতা বাংলার, বাঙালির সম্পদ, তথা সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের সম্পদ। তথাকথিত বঙ্গবন্ধুপ্রেমীদের জন্য, আমাদের অযোগ্যতার জন্য পিতা বিতর্কিত হতে পারেন না, নেতা বিতর্কিত হতে পারেন না। তিনি যেমন আওয়ামী লীগের, তেমনি তিনি বিএনপি-জাতীয় পার্টির, তিনি তেমনি আমাদের সবার সম্পদ। শুধু এটুকুই যদি প্রতিষ্ঠা করে যেতে পারি তাহলে মনে করব জীবন সার্থক হয়েছে। পরিবার-পরিজন- আত্মীয়স্বজন দলবল নিয়ে আমাদের সমাধিতে আসা সফল হয়েছে। তাই এসেছি পিতার কবরে হৃদয়ের সব অর্ঘ্য নিবেদন করতে। আল্লাহ রব্বুল আলামিন সপরিবারে পিতাকে বেহেশত নসিব করুন। আর পিতা আমাদের দোয়া করুন, আমরা যেন সব বাঙালি জাতি দেশের আপামর জনসাধারণের সঙ্গে স্বস্তি, শান্তি ও নিরাপদে থাকতে পারি।

 

লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর