মঙ্গলবার, ৩০ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

একটি নিরানন্দ সড়কের কথা

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

একটি নিরানন্দ সড়কের কথা

আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগের কথা। ভিয়েতনামের গেরিলারা তখন প্রাণপণে যুদ্ধ করছিল ফরাসি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। আমাদের রাজধানী ঢাকার সঙ্গে উত্তরের গাজীপুরের যেমন একটি প্রধান সড়ক আছে, তেমনি একটি সড়ক ভিয়েতনামের কেন্দ্রকে সংযুক্ত করেছিল উত্তরের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের সঙ্গে। এ সড়কের কেতাবি নাম ছিল ‘রুট ওয়ান’। সড়কটির দুই পাশেই ছিল ভিয়েতনামিদের গ্রাম, ডোবা, বিল ও জঙ্গল। এ সবকিছুর সুবিধা গ্রহণ করে ভিয়েতনামি গেরিলারা রুট ওয়ানের বিভিন্ন স্থানে ওত বা ফাঁদ (অ্যাম্বুশ) পেতে থাকত এবং ফরাসিদের যে-কোনো সামরিক যান বা পায়ে চলা সেনা দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ত। ১০ আগস্ট ১৯৫৩ সালে এমনি এক অ্যাম্বুশে ভিয়েতনামের রেজিমেন্ট ৯৫-এর গেরিলাদের হামলায় ফ্রান্সের ১৭ সেনা প্রাণ হারিয়েছিল এবং শতাধিক সেনা আহত হয়েছিল। রুট ওয়ান পরে ফ্রান্স এবং আরও পরে আমেরিকার সেনাদের কাছে এক আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এ সড়কে চলাচলের আদেশ পেলেই তাদের মুখ শুকিয়ে যেত এবং নানা অজুহাতে তারা এ সড়কে চলাচল এড়িয়ে যেত। ভয়ংকর ও আতঙ্কজনক এ সড়কটি পরে ‘স্ট্রিট উইদাউট জয়’ বা ‘নিরানন্দ সড়ক’ নামে কুখ্যাতি পায়। ১৯৬১ সালে এ ইতিহাস নিয়ে প্রথম জীবনে ফরাসি সৈনিক এবং পরবর্তীতে আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক এবং ভিয়েতনাম ও কমিউনিস্ট বিষয়ক গবেষক বার্নার্ড বি ফল একটি বই লেখেন, যার নাম দেওয়া হয় ‘স্ট্রিট উইদাউট জয়’। স্টাক পোল বুকস থেকে প্রকাশিত এ বই ব্যাপক সাড়া ফেলে। দুঃখের বিষয়, ১৯৬৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি একটি গবেষণা ও সংবাদ সংগ্রহের কাজে আমেরিকার নবম মেরিন কোরের প্রথম ব্যাটালিয়নের সেনাদের সঙ্গে ভ্রমণকালে কুখ্যাত এ ‘স্ট্রিট উইদাউট জয়’-এ ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে মাত্র ৪০ বছর বয়সে প্রাণ হারান অকুতোভয় সৈনিক, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক ও গবেষক বার্নার্ড বি ফল। পুরনো ইতিহাসের এ কথাগুলো মনে পড়ে গেল রাজধানী ঢাকার সঙ্গে উত্তরের গাজীপুর জেলাকে সংযোগকারী ‘বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট’ (সংক্ষেপে বিআরটি) নামক সড়কের অব্যবস্থাপনা ও চলাচলজনিত ঝুঁকির বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে। বেহায়াপনা, রাগিয়ে দেওয়া আর টিটকারী মারাকে যদি সংক্ষেপে বিআরটি বলা হয়, তবে এ নাম সার্থক বলা যায়। একটি বিদেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং তাদের নিয়ন্ত্রণকারী দেশি কর্তাব্যক্তিরা কতটা বেহায়া হলে ২০১২ সালের সাড়ে ২০ কিলোমিটার সড়ক ২০২২ সালেও শেষ হয় না এবং কবে হবে তা-ও নিশ্চিত বলতে পারে না তা নিরূপণ করা সত্যিই কঠিন। আরও কঠিন বেহায়াপনার কোন স্তরে পৌঁছলে ২ হাজার ৩৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকার প্রজেক্টের জন্য ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা ব্যয় করার অনুমোদন দেওয়া হয়, তা অনুধাবন করা। এ বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি কিলোমিটার বিআরটি নির্মাণে আপাত খরচ ধরা হয়েছে ২০৮ কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ ১ মিটার বা প্রতি ২ হাত বিআরটি নির্মাণে খরচ হচ্ছে ২০ লাখ টাকার বেশি। অথচ ২০১৮ সালের ২৬ আগস্ট দেশের ইংরেজি দৈনিক দি ডেইলি স্টারে বুয়েটের শিক্ষক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হকের বরাতে লেখা হয়, বিশ্বে স্বীকৃত বিআরটি নির্মাণ খরচ প্রতি কিলোমিটারে ৬ মিলিয়ন ডলার বা ৬০ লাখ ডলার। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ডলারপ্রতি ১০০ টাকা বিনিময় হার ধরলেও এ মূল্যমান দাঁড়ায় ৬০ কোটি টাকা। তাহলে ৮০-এর ঘরে ডলার মূল্য থাকা অবস্থায় কিলোমিটারপ্রতি ৬০ লাখের স্থলে ২০৮ লাখ টাকা নির্মাণ ব্যয় ধরা প্রস্তাব করা ও অনুমোদন করতে কেমন বুকের পাটা দরকার, তা-ও ভাবিয়ে তোলে। সহজেই বলা যায়, এ মূল্যে জাপান, আমেরিকা বা ফ্রান্সের বিশ্বসেরা নির্মাণ প্রতিষ্ঠানও এ বিআরটি নির্মাণে রাজি হতো। অথচ শুরুতে নির্মাণ ব্যয় অর্ধেক ধরে কাজ দেওয়া হয় চীনা নির্মাণ প্রতিষ্ঠান গেজুবা গ্রুপকে যা বৃহত্তর গাজীপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও আংশিকভাবে সমগ্র উত্তরবঙ্গবাসীর জীবনে ‘গজব’ ডেকে আনে।

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞসম্পন্ন দেশি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানও যে মূল্যে একটি প্রকল্প করার সাহস পায় না, সেই মূল্যে বিদেশি বিশেষত চায়নিজ কোম্পানিকে প্রকল্প দেওয়া এবং পরে নানা কারণে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়িয়ে ঠিকাদারের লাভের অঙ্ক বাড়ানোর এ ঘৃণ্য প্রবণতা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কীসের ভিত্তিতে প্রকল্পের ব্যয় শুরুতে অর্ধেকের কম ধরা হয়েছিল এবং কারা এর নেপথ্যে ছিল তা বের করা জরুরি। একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিকল্প সড়ক বানিয়ে নির্বিঘ্নে যান চলাচল নিশ্চিত করা, নির্মাণসামগ্রীর কারণে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তা নিশ্চিত করা, নির্মাণকাজ চলাকালে নির্মাণশ্রমিক, এলাকাবাসী ও পথচারীদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রভৃতির জন্য বরাদ্দ থাকে। বিআরটি প্রকল্পে যানবাহন চলাচল চরমভাবে বিঘ্নিত হয়ে দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল হাজার হাজার গাড়ি। এতে কত কোটি শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়েছে, কত লিটার জ্বালানি অতিরিক্ত খরচ হয়েছে, গাড়ির ইঞ্জিন কত ঘণ্টা অতিরিক্ত চালু থেকে আয়ু হারিয়েছে তার হিসাব নেই। খানাখন্দে পড়ে বহু গাড়ির যন্ত্রাংশ বিকল হয়েছে যা কেনা হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রায়। ধুলাবালি, অসহনীয় গরম এবং গাড়ির ধোঁয়া ও উত্তাপে অসুস্থ হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। এসব ক্ষয়ক্ষতির কথা কেউ কখনো ভাবলে এমন বেহায়াপনা করার কথা নয়। বিআরটির ‘আর’ অক্ষর দিয়ে দিয়ে যদি রাগিয়ে দেওয়া বোঝায়, তবেও বিআরটি নামটি সার্থক। এ প্রকল্প বহুবার রাগিয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, গাজীপুরের এমপি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী অ ক ম মোজাম্মেল হক, টঙ্গীর এমপি যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম ও গাজীপুরের মেয়রকে। ১৫ মার্চ ২০২১-এ গাজীপুরের তৎকালীন মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বিআরটি নির্মাণকাজ পরিদর্শনে গিয়ে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রীর ব্যবহার দেখতে পান এবং নিজের ভেরিফায়েড পেজ (ফেসবুক)সহ বিভিন্ন মাধ্যমে এ নিম্নমানের নির্মাণকাজ বন্ধের দাবি জানান। গাজীপুর-ঢাকা সড়ক সংস্কারের দাবিতে চলতি বছরের শুরুতে ময়মনসিংহ চেম্বার অব কমার্স ও পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের যৌথ ডাকে হরতাল ডাকা হয় ও যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। পরে যোগাযোগ সচিবের আশ্বাস ও অনুরোধে হরতালের অবসান ঘটে। দেশে এমন কোনো গণমাধ্যম নেই যারা এ প্রকল্পের জন্য সৃষ্ট দুর্বিষহ জনদুর্ভোগের কথা তুলে ধরেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও এ নিয়ে সরব ছিল। কিন্তু সব রাগ, ক্ষোভ  ও অসন্তোষ বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এবং ‘কানে দিয়েছি তুলো, পিঠে বেঁধেছি কুলো’ এ মন্ত্র ধারণ করে গাজীপুরে গাজী সালাউদ্দিনের মতো বুক উঁচিয়ে চলেছেন বিআরটি ও চীনা কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা। বিআরটির ‘টি’ অক্ষর যেন টিটকারীর সমার্থক। প্রাথমিক বা প্রারম্ভিক প্রাক্কলিত ব্যয় দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি করে এবং দুই বছরের প্রকল্প ১০ বছরেও হস্তান্তর করতে না পেরে আরও অর্থ ও সময়ের জন্য অনুরোধ আমাদের পরিকল্পনাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও প্রকৌশলীদের সক্ষমতাকে টিটকারী মারে। একটি চীনা কোম্পানির যাচ্ছেতাই আচরণ, অদক্ষতা, কাজের ও  নির্মাণসামগ্রীর নিম্নমান সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতা আমাদের চুক্তি প্রণয়নে দক্ষতা, চুক্তি যাচাই-বাছাইয়ের আইনি দক্ষতা ও কূটনৈতিক পারঙ্গমতার প্রতি টিটকারীর শামিল। আমাদের পরিবেশ অধিদফতর, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জনসহ নানা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ১০ বছরেও এমন দূষণ সৃষ্টিকারী ঝুঁকিপূর্ণ প্রকল্পের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি, যা উপরোক্ত সবার সক্ষমতার প্রতি টিটকারী। সাম্প্রতিক প্রাণহানির পর ঢাকা উত্তরের মেয়র এ প্রকল্পের লাগাম টেনে ধরেছেন। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’ প্রকল্পটি সবচেয়ে বড় টিটকারী মানুষের জীবনের প্রতি। এ প্রকল্পে মানুষের কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার সঠিক তথ্য-উপাত্ত কোনো দিনই পাওয়া যাবে না। ১৫ জুলাই ২০২২-এ গাজীপুরের চান্দুরায় বিআরটির একটি অংশ নির্মাণকালে একটি ক্রেন উল্টে যায়। এতে নির্মাণশ্রুমিক জিয়াউর রহমান (৩০) মৃত্যুবরণ করেন। আহত হন আরও এক পথচারী। ১৫ মার্চ ২০২১-এর রাত আড়াইটায় একটি দ্রুতগামী গাড়ি আবদুল্লাহপুরে ধাক্কা মারে বিআরটির ২২ নম্বর পিলারে। এতে আহত হন একজন। একই দিন একই প্রকল্পের বিমানবন্দর অংশে ধসে পড়ে ৩ নম্বর স্প্যান। এ স্প্যান বসানোর কথা ছিল রাতে। তবে দিনের ১০টায় ব্যস্ত সড়কেই চলছিল এ নির্মাণযজ্ঞ। এ দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন দুই চীনা নির্মাণশ্রমিকসহ মোট চারজন (মতান্তরে ছয়জন)। সর্বশেষ ১৫ আগস্ট ২০২২ জাতীয় শোক দিবসে সমগ্র জাতিকে আবারও কাঁদাল বিআরটি প্রকল্প। এদিন উত্তরা অংশে একটি গার্ডার নামানোর সময় তা একটি প্রাইভেট কারের ওপর পড়ে। এতে দুমড়ে-মুচড়ে যায় সেই প্রাইভেট কার আর ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান কারে থাকা একই পরিবারের পাঁচজন। আগের দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা না নিয়ে মানুষের জীবনের প্রতি যখন টিটকারী বা অবজ্ঞা প্রকাশ করা হয় তখনই ঘটতে পারে এমন দুর্ঘটনা নামক অবহেলাজনিত হত্যাকান্ড।

মূলত বাংলাদেশে ভারী নির্মাণযন্ত্র চালানোর জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। কোনো বিশেষ লাইসেন্সও নেই। ভারী গাড়ি (হেভি ভেহিকল) চালানোর লাইসেন্সকেই ভারী নির্মাণযন্ত্র চালনোর লাইসেন্স গণ্য করা হয়। কয়েকটি বিদেশি প্রকল্প ছাড়া এ লাইসেন্সও চাওয়া হয় না অধিকাংশ প্রকল্পে। অথচ বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে চলছে কয়েক লাখ নির্মাণযন্ত্র। সাধারণত দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা এবং শিক্ষাবঞ্চিত জীবিকার প্রত্যাশীরা হেলপার হিসেবে এসব নির্মাণযন্ত্র পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং পর্যায়ক্রমে তারাই হয়ে ওঠে অপারেটর। বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি ভারী যন্ত্রের অপারেটরের বেতনও ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা হওয়ার নজির আছে। অথচ এ দেশের শিক্ষিত বা ভদ্র পরিবারের ছেলেরা এমন পেশায় আসতে নারাজ। একজন হেলপার শুরুতে ১৫-২০ হাজার টাকা বেতন গোনেন। অথচ ১২-১৫ হাজার টাকা বেতনে অফিসে চাকরি খোঁজে লাখো শিক্ষিত যুবক। মাদরাসায় ১০-১২ বছর আরবি পড়েও মধ্যপ্রাচ্যে ভালো চাকরি পায় না মাদরাসার ছাত্রছাত্রীরা। অথচ ফিলিপাইনের প্রবাসী শ্রমিকরা তিন থেকে ছয় মাস কর্মোপযোগী আরবি শিখে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে। নার্সিং শিক্ষার পাশাপাশি আরবি, কোরিয়ান বা জাপানি ভাষা শিক্ষার কারণে ফিলিপাইনের নার্সেরা অনায়াসে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত হচ্ছেন। আজ আমাদেরও শিক্ষাব্যবস্থায় এসব ভাবতে হবে। দুর্নীতি রোধকল্পে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ দেওয়ার সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে। এটা একশ্রেণির আমলার রক্ষাকবচ মাত্র। ৩০০ টাকার বালিশ সর্বনিম্ন দরদাতা থেকে যদি ৩ হাজার ৭০০ টাকায় কেনা হয়, তবে আইনের দৃষ্টিতে হয়তো অপরাধ নয়। কিন্তু নৈতিকতার বিচারে তা বড় অপরাধ। যে প্রকল্প দেশি প্রতিষ্ঠান একটি নির্দিষ্ট বাজেটের নিচে করতে পারছে না, তা বিদেশ থেকে কোনো প্রতিষ্ঠান আরও কম মূল্যে করে দিতে চাইলেই তাকে কাজ দিতে হয়। নইলে তাদের দেশি এজেন্ট বা সহযোগীরা দুর্নীতির ধুয়া তুলে আদালত ও মিডিয়ার আশ্রয় নেয়। এ সংস্কৃতির নির্মম শিকার বিআরটি প্রকল্প। স্বচ্ছতা ও সদিচ্ছা থাকলে যে ব্যয় ও সময় না বাড়িয়েও প্রকল্প সম্পন্ন করা সম্ভব এ উদাহরণও এ দেশে কম নয়। ২০১৯-২০ সালে কাঁচপুর, মেঘনা ও গোমতীতে সেতু নির্মাণ এবং বিদ্যমান সেতু সংস্কারে বাজেট ধরা হয় প্রায় ৮ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা। বিপরীতে ব্যয় হয় প্রায় ৭ হাজার ৯৮ কোটি টাকা। এতে সাশ্রয় হয় প্রায় ১ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা। হোলি আর্টিজান হত্যাকান্ডের পর এসব ব্রিজের নির্মাণকাজ চার মাস বন্ধ থাকলেও জাপানের নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ওব্যাসি করপোরেশন, শিমিজ করপোরেশন, জেএফই ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন এবং আইএইচআই ইনফ্রা সিস্টেমস্ কোম্পানি লিমিটেড এসব কাজ করে। এ নির্মাণকাজ শেষ হয় সরকার নির্ধারিত সময়ের সাত মাস আগে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও এমন উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। এ দেশে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া বা আমেরিকার নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের একাধিক নিরাপত্তা স্তরবিশিষ্ট ভারী যন্ত্র ব্যবহৃত হয়। লিমিট সুইচ, সেন্সর, লিমিট লাইট ও অ্যালার্মের কারণে ইচ্ছা করলেও একজন অপারেটর লিমিটের অতিরিক্ত ভারী লোড তুলতে পারেন না। এসব ভারী যন্ত্রের ভাড়া বেশি বলে তা বাজার পায় না। বাংলাদেশে বিদেশি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ভারী নির্মাণযন্ত্র ও নির্মাণসামগ্রী আমদানিতে বিশেষ সুবিধা পায়, যা দেশি প্রতিষ্ঠান পায় না। অথচ এ বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে দেশি সরবরাহকারী, সেবাপ্রতিষ্ঠান ও সাবকন্ট্রাক্টরদের পাওনা থাকে কোটি কোটি টাকা। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের রাশিয়ান ঠিকাদার, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভারতীয় ঠিকাদার, মেট্রোরেলের থাইল্যান্ড-ইতালির ঠিকাদারের কাছে দেশি বহু প্রতিষ্ঠান পাওনা টাকা উদ্ধারে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ন্যায্য পাওনার বদলে যেনতেন অঙ্কের টাকার বিনিময়ে না-দাবি দিতে বাধ্য হয় দেশি কোম্পানি যা বহুবার গণমাধ্যমে এসেছে। তার পরও বিদেশি মানহীন কোম্পানির দাপটে কোণঠাসা দেশি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো। মানহীন বিদেশি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান কীভাবে কাজ করে তার বাস্তব উদাহরণ বিআরটি প্রকল্প। এ প্রকল্পে সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা ঘটানোর ক্রেনটির কোনো ফিটনেস সার্টিফিকেট ছিল না। চালকরা ছিলেন অদক্ষ। নিরাপত্তা রক্ষায় কোনো ব্যারিকেড বা নিরাপত্তারক্ষী ছিল না। এসব নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েই নিম্নদরদাতা হিসেবে কাজ পেয়েছিল চায়না গেজুবা গ্রুপ। ইন্টারনেটে স্বল্প সময়ের অনুসন্ধানে দেখা যায়, চায়নার কিংডাও মেট্রো কোম্পানি গেজুবাকে মেট্রোলাইন নির্মাণের কাজ দিলে তারা সেই কাজের সাবকন্ট্রাক্ট দেয় কিংডাওর সুনইয়নডা কোম্পানিকে। এ কোম্পানি আবার সাবকন্ট্রাক্ট দেয় লিও’স কনস্ট্রাকশন কোম্পানিকে, যা আইনসিদ্ধ ছিল না। বাস্তবে দেখা যায়, এ ক্ষেত্রে অসমতল স্টিল বার এবং অসম পুরুত্বের কংক্রিটের স্লাব বা কুশন ব্যবহার করে। এজন্য গেজুবাকে জরিমানা গুনতে হয় ১ মিলিয়ন ইয়ান বা ১ লাখ ৪৬ হাজার ডলার। তদুপরি নতুন করে মেট্রোলাইন বানাতে হয়। (সূত্র : এশিয়া টাইমস্ ১ জুলাই ২০১৯)। ২০১৩ সালের জুনে নেপালের বিদ্যুৎকর্মীরা সে দেশের মন্ত্রীদের আবাসিক এলাকায় দুই দিন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রেখেছিলেন। চায়নার গেজুবা কোম্পানি নির্দিষ্ট তিন বছর মেয়াদ শেষে ত্রিশূলী নদীর ওপর নির্মাণাধীন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র হস্তান্তরের কথা ছিল। বাস্তবে তা করতে পারেনি গেজুবা। চুক্তি মোতাবেক এজন্য কোম্পানিটির জরিমানা হওয়ার কথা ১০ মিলিয়ন ডলারের বেশি। কিন্তু নেপালের মন্ত্রীরা এ জরিমানা না করে প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর এবং প্রকল্প ব্যয় ৪৩ মিলিয়ন ডলার বাড়িয়ে দেন। এতে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে এবং বিদ্যুৎকর্মীরা প্রতিবাদস্বরূপ মন্ত্রিপাড়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেন। (সূত্র : দি হিন্দু : ১২ জুন ২০১৩)। অ্যাঙ্গোলার কাওনজা নদীতে ২ হাজার ১৭২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দি কাকুলো কাবাকা হাইড্রোলিক প্রজেক্ট নির্মাণের কাজ দেওয়া হয় চায়নার এই গেজুবাকে। স্থানীয় শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা ও সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে ব্যর্থ হওয়ায় এ প্রকল্পে প্রতিবাদ শুরু হয়। এ বছর ২৫ মে এ প্রতিবাদ থামাতে পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। পুলিশের গুলিতে আটজন আহত হন এবং তাদের মধ্যে দুজন মৃত্যুবরণ করেন। (সূত্র : অ্যাঙ্গোলা টেলিগ্রাফ : ২৯ মে ২০২২)। ২০১৫ সালের মে-তে চীনে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পে পানি সংরক্ষণ, ভূমিকম্প থেকে উদ্ধার এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণে অব্যবস্থাপনার দায় স্বীকার করে চায়নার গেজুবা গ্রুপ এবং এর চারটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। এজন্য বিশ্বব্যাংক তাদের ওপর আরোপিত ১৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় এবং এর বিপরীতে অসন্তোষ বা রেপ্রিমান্ড আরোপ করে। (সূত্র : বিশ্বব্যাংক প্রেস রিলিজ : ২৯ মে ২০১৫)। ২০১৭ সালের মে-তে নেপালের মন্ত্রিসভা টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ এনে কাঠমান্ডুর ৫০ কিলোমিটার বুধি গ-কী নদীর ওপর পশ্চিমে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের দায়িত্ব থেকে চায়নার গেজুবা গ্রুপকে অব্যাহতি দেয়। গেজুবা ২৫ বিলিয়ন ডলার বাজেটের এ প্রকল্প নির্মাণের জন্য তৎকালীন নেপাল সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। (সূত্র : বয়টার্স ও দ্য ফার্স্ট পোস্ট : ১৩ নভেম্বর ২০১৭)

সব কিছুরই শেষ হয়। ২২ বছর লাগলেও তাজমহল নির্মাণ একদা শেষ হয়েছিল। বিআরটি প্রকল্পও একদিন শেষ হবে। তোষামোদকারীরা দেশের প্রথম বিআরটির নামকরণ নিয়ে নগ্ন প্রতিযোগিতায় নামবেন। তবে আমার দাবি ভিয়েতনামের ‘স্ট্রিট উইদাউট জয়’-এর মতো এ প্রকল্পের নাম হোক ‘বেহায়া সড়ক’। তাহলেই হয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে একদল বেহায়া একদা বিদেশিদের সঙ্গে নিয়ে প্রকল্প ব্যয় দ্বিগুণ করে বিশ্বরেকর্ড করেছিল আর সাড়ে ২০ কিলোমিটার রাস্তা ১০ বছরের বেশি সময়ে নির্মাণ করেছিল জনগণকে রাগিয়ে, টিটকারী মেরে এবং নিরীহ কিছু প্রাণ কেড়ে নিয়ে। তবেই বিআরটির অর্থ দাঁড়াবে ‘বেহায়াপনা-রাগানো-টিটকারী’। বি: দ্র: বাংলা-বিহার-ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে বেইমানি করা প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের প্রাসাদের একটি ফটকের পরিচিতি ঘটেছে ‘নিমক হারাম দেউড়ি’ নামে। একদা মানুষ সেখানে থুথু ফেলত।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক, কলামিস্ট ও গবেষক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর