শনিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

সব জানে, সব পারে আমলারা

সৈয়দ বোরহান কবীর

সব জানে, সব পারে আমলারা

এশিয়া কাপে বাংলাদেশ-আফগানিস্তান খেলা দেখছি। আমাদের ব্যাটার যেন আসা-যাওয়ার খেলায় মেতে উঠেছিলেন। মন খারাপ। এ সময় এক বন্ধুর ফোন এলো। কী কর? আমি নিস্পৃহভাবে বললাম ‘খেলা দেখছি’। আমার বন্ধুটি নানা অভিনব আইডিয়ার জন্য আলোচিত। বলল, বল তো বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের আসল সমস্যা কী? আমি একটু উৎসাহী হলাম। জানতে চাইলাম কী? উত্তরে বন্ধুটি জানাল, আসল সমস্যা হলো আমাদের ক্রিকেটে কোনো আমলার উপস্থিতি নেই। আমলারা পন্ডিত বিচক্ষণ, সব জানে সব পারে। সব জায়গায় তারা আছে শুধু খেলাধুলায় নেই। সরকার কেন এত টাকা খরচ করে শ্রীরাম, জিমি সিডন্সকে আনছে। তার চেয়ে কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত আমলাকে দায়িত্ব দিলে তাদের পুনর্বাসন হতো। বৈদেশিক মুদ্রারও সাশ্রয় হতো। তোদের মতো ক্রীড়াভক্তদের হতাশাও দূর হতো। তার প্রচ্ছন্ন কৌতুকে কিছুটা মজা পেলাম। ফোন রাখার পর একা একা ভাবলাম। তাই তো আমলারা এখন সর্বত্র বিচরণকারী এক বিরল প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। একা একা নিজের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর খেলা শুরু করলাম।

প্রশ্ন : বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত লেখক কে?

একজন আমলা। তার নাম মো. নবীরুল ইসলাম। তিনি একজন অতিরিক্ত সচিব। সচিব হওয়ার আগেই তিনি ২৯টি বই লিখে ফেলেছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের জ্ঞানচর্চা ও পাঠাভ্যাস বাড়ানোর জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রায় ১০ কোটি টাকার বই কেনার উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য একটি তালিকাও তৈরি করা হয়েছিল। তালিকায় এ প্রখ্যাত আত্মগোপনে থাকা লেখকের ২৯টি বই নির্বাচন করা হয়েছিল। দুষ্ট সাংবাদিকরা লেখাপড়া করে না। বইপত্র ছুঁয়েও দেখে না। এটা নিয়ে তারা হইচই করল। খামোখা। এর ফলে বই কেনার পুরো তালিকা বাতিল করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কিন্তু তাতে কী? লেখক নবীরুলের নাম ছড়িয়ে পড়েছে দিগ্বিদিক। তিনি এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত লেখক।

প্রশ্ন : বাংলাদেশে এ মুহূর্তে কার এক কথায় হইচই পড়ে যায়?

একজন সাবেক আমলা। নির্বাচনের বাকি আছে এখনো দেড় বছর। হঠাৎ তিনি ঘোষণা করলেন দেড় শ-দেড় শ ফরমুলা। ব্যস! আর যায় কই। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হয়ে গেল কথার যুদ্ধ। রাজনীতির যুদ্ধ কি আর কথায় থাকে? যুদ্ধ এখন ছড়িয়ে পড়েছে রাস্তায়। প্রতিদিন আওয়ামী লীগ-বিএনপি সংঘর্ষের খবর পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কথাই বলছি। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে মনে হচ্ছে নির্বাচন নয়, জাতিকে উত্তেজিত করার মহান দায়িত্ব যেন তিনি নিজ হাতে তুলে দিয়েছেন। একের পর এক কথা বলে ঝিমিয়ে পড়া জাতিকে তিনি জীবন্ত, উত্তেজিত করছেন। বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে কখনো নির্বাচনের দেড় বছর আগে থেকে এমন টানটান মুখোমুখি যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়নি। এ জন্য সাবেক আমলা থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হওয়া মানুষটিকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। দেশে রাজনৈতিক উত্তাপ না থাকলে কী করে চলে। জনগণকে স্বতঃস্ফূর্ত সতেজ চনমনে রাখার জন্য সাবেক আমলা কাজী হাবিবুল আউয়াল নিরন্তর কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।

প্রশ্ন : বাংলাদেশে মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় রক্ষক কে?

অবশ্যই সাবেক আমলা। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপারসন একজন সাবেক আমলা। এ প্রতিষ্ঠানটি পুরোপুরি আমলারা দখল করে ফেলেছেন। প্রতিষ্ঠানটি এত সফল যে ‘মানবাধিকার’ এখন জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। শুধু জাতীয় ইস্যু নয়, ‘মানবাধিকার’ এখন বাংলাদেশে সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্য হিসেবেও বিবেচিত হয়েছে। জাতিসংঘের সার্টিফিকেট জালিয়াতির খবরও প্রকাশিত হয়েছে। মানবাধিকার নিয়ে সবাই কথা বলছে, একমাত্র আমলা নিয়ন্ত্রিত কমিশন ছাড়া। এভাবে মানবাধিকারকে আর কেউ কি পাদপ্রদীপে আনতে পেরেছিল?

প্রশ্ন : দেশে সবচেয়ে বেশি অর্থের মালিক কে?

অবশ্যই বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। আর বিপিসির চেয়ারম্যান হলেন একজন চলমান আমলা। তিনি সচিবও বটে। আমলারা কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধান হলে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো চালান। তাই বিপিসির মালিক তো আমলাই। বিভিন্ন ব্যাংকে ৪০ হাজার কোটির বেশি টাকার স্থায়ী আমানত রেখে বিপিসি চেয়ারম্যান ইদানীং প্রায়ই অর্থকষ্টের কথা বলে কান্নাকাটি করেন। এভাবে প্রশ্ন-উত্তর খেলায় দেখলাম সবকিছু এখন আমলাদের দখলে। এমনকি ইমাম এবং মাওলানা সাহেবদের মোনাজাত করার নিরঙ্কুশ রাজত্বেও ভাগ বসিয়েছেন সম্মানিত আমলারা। পদ্মা সেতু উদ্বোধনী দিনের বিশেষ মোনাজাত বায়তুল মোকাররমের খতিব কিংবা বঙ্গভবনের পেশ ইমাম পড়াননি। পড়িয়েছেন আমলার শিরোমণি। সরকারের প্রেস উইং বলে এখন কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রীর বার্তা তার প্রেস সচিব দেন না। দেন আমলারা। এই তো সেদিন চা শ্রমিকদের বেতন-মজুরি নিয়ে মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করলেন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠক শেষে বক্তব্য পেশ করলেন মুখ্য সচিব। একাধিক মন্ত্রী ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তারা গণমাধ্যমে কথা বলেননি।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের পুরোটা দখল করে নিয়েছেন আমলারা। জেলার রাজত্বে আমলারা। উপজেলায়ও আমলাদের হাতেই ছড়ি। প্রায় সব সরকারি প্রতিষ্ঠান এখন আমলাদের অবসরোত্তর ক্লাবে পরিণত হয়েছে। কিছু আমলা এখন অবসরের পর নবযৌবন লাভ করেন। নব উদ্যোগে সরকারের কোথাও না কোথাও ঢুকে পড়েন। কোথাও জায়গা না হলে অন্তত ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদটা যেন পাওয়া যায়, এ জন্য অবসরের পর তাদের রীতিমতো বিস্কুট দৌড়ে অংশ নিতে হয়। আমলাদের এ বাড়বাড়ন্ত এক যুগ ধরে। আমলাদের বেতন এখন ঈর্ষণীয় এবং লোভনীয়। বেতন বৃদ্ধির পর দুর্নীতি কমেছে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। দেশ ছেড়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে আমলাদের বিজয়গাথা। কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘সৎ আমলাদের’ সম্পদের পাহাড় দেখলে ভিরমি খেতে হয়। বুদ্ধিমান একশ্রেণির আমলা অবসরের পর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দেশে চলে যান। দেশে আসেন মাঝেমধ্যে। আমলাদের বিকাশের পথরেখা খুব সুস্পষ্ট এবং সোজাসাপটা। চাকরিতে ঢোকার পর থেকেই বৈধ এবং অবৈধ নানা সুযোগ-সুবিধা জালের মতো বিছানো। সুযোগ-সুবিধার মাত্রা এখন এতই টুসটুসে পেয়ারার মতো যে, আমলা হওয়ার এক ভয়ংকর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে দেশে। ইদানীং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার ধরন, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা দেখে মনে হয় শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য হলো পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। বিসিএস পরীক্ষা এখন দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য এক ভয়ংকর ব্যাধি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, পাবলিক লাইব্রেরি ছিল জ্ঞান অর্জনের জায়গা। আমি সপ্তাহে দুই দিন প্রায় সারা দিন লাইব্রেরিতে কাটাতাম। আইনের বই নয়, নানা বিচিত্র আকর্ষণীয় বইয়ে ঠাসা আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি। কদিন আগে একটা সেমিনারে যোগ দিতে গিয়ে প্রাণের লাইব্রেরিতে ঢুঁ মেরে হতবাক হলাম। এটা এখন বিসিএস পরীক্ষার্থীদের পাঠকক্ষে পরিণত হয়েছে। এখন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর প্রধান স্বপ্ন হলো আমলা হওয়া। শুধু সাধারণ শিক্ষার্থী নয়, চিকিৎসক এবং প্রকৌশলীরাও এখন আর তাদের পেশায় থাকতে আগ্রহী নন। তারাও এখন আমলা হতে চান। একজন মেডিকেল শিক্ষার্থী যিনি সরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ছেন, তাকে চিকিৎসক বানাতে রাষ্ট্রের খরচ দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা। তিনি মাসে টিউশন ফি দিচ্ছেন মাত্র ৯ টাকা। হলে থাকার জন্য সিট ভাড়া দিচ্ছেন মাত্র ১০ টাকা। ভর্তি হওয়ার জন্য তাকে এককালীন দিতে হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা মাত্র। অথচ বেসরকারি মেডিকেল কলেজে এককালীন ভর্তি হতে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা লাগে। অন্যান্য খরচ সরকারি মেডিকেল কলেজের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। সাধারণ মানুষের টাকায় সরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করছেন। রাষ্ট্র এই বিপুল ভর্তুকি দিচ্ছে একটি প্রত্যাশা থেকে। শিক্ষা শেষে তারা জনগণকে চিকিৎসা দেবেন। মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবে না। তারা একেকজন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ কিংবা দীন মোহাম্মদ হবেন। কিন্তু তারা এখন পেশা বদল করছেন। একই অবস্থা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও। এদের বেশির ভাগই এখন জামিলুর রেজা চৌধুরী কিংবা আইনুন নিশাত হতে চান না। আমলা হতে চান। সর্বশেষ পাঁচটি পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রশাসন, পররাষ্ট্র এবং পুলিশ ক্যাডারে ১ হাজার ৯৮০ জন কর্মকর্তার মধ্যে ৩৮৭ জনই প্রকৌশলী ও চিকিৎসক। প্রশ্ন হলো, প্রকৌশল এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা কেন আমলা হতে চাইছেন? সরকারি চাকরিতে সুবিধা সব ক্যাডারে একই। প্রকৌশলী কিংবা চিকিৎসকরা তাদের পেশায় বৈধ পন্থায় সম্মানজনকভাবে অনেক অর্থবিত্তের মালিক হতে পারেন। তবু কেন তারা আমলা হতে চান? এর কারণ ‘ক্ষমতা’। অন্য যে-কোনো পেশার চেয়ে আমলারা এখন ক্ষমতাবান। এরাই এখন দন্ডমুন্ডের কর্তা। এ কারণেই সবাই এখন আমলা হতে চায়। চিকিৎসক কিংবা প্রকৌশলীরা কম দুঃখে প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিতে আগ্রহী হননি। চিকিৎসকের পদোন্নতি, পদায়ন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সাগর পাড়ি দেওয়ার মতো। সেরা মেধাবী শিক্ষার্থী যখন বুয়েট বা কোনো প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার জন্য বরাদ্দ ক্যাডারে ঢোকে তখন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হতে পারা ইতিহাস, কিংবা বাংলায় পাস করা আমলা তার পেছনে চাবুক নিয়ে ঘোরে। অন্যদিকে প্রশাসন ক্যাডারে পদোন্নতি সময়ের ব্যাপার মাত্র। তরতর করে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত আপনি উতরে যাবেন। যদি না আপনার প্রিয় বন্ধু অথবা অগ্রজরা আপনাকে বিএনপি-জামায়াত না বানিয়ে দেয়। প্রশাসন ক্যাডারে একবার ঢুকতে পারলে আপনি আইন এবং বিচারের ঊর্ধ্বে উঠে যাবেন। প্রশাসন ক্যাডারের একজন ছোট কর্মকর্তা যদি আশ্রয়ণ প্রকল্পে দুর্নীতি করে তাহলে তার শাস্তি হবে বদলি। জেলা প্রশাসক যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন। তার আপত্তিকর ভিডিও যদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি হলো পদাবনতি। একজন আমলা যদি মধ্যরাতে আদালত বসিয়ে সাংবাদিককে বেধড়ক পেটান। বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে এসে মাদক মামলা দেন, তাহলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে দুই বছরের বেতন বৃদ্ধি বন্ধ। কিন্তু এসবে ভয় পাওয়ার কারণ নেই। এ শাস্তি থেকেও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবলে তিনি অব্যাহতি পাবেন। পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্তা যদি বিদেশে মারিজুয়ানার ব্যবসা করেন, তখন প্রচলিত আইনে তার বিচার করা যাবে না। তাকে বিভাগীয় তদন্তের মুখোমুখি হতে হবে। ব্যস! পরে বিষয়টি লোকচক্ষুর আড়ালে গেলেই আবার তাকে পদায়ন করা হবে। এত গেল ছোট এবং মাঝারি আমলাদের অপরাধ প্রসঙ্গ। বড় আমলাদের ক্ষেত্রে এসব শাস্তিরও বালাই নেই। করোনাকালে শাহেদ কেলেঙ্কারির কথা সবাই জানে। প্রতারক শাহেদ জেলে। কিন্তু যারা পৃষ্ঠপোষকতায় শাহেদ প্রশাসনের প্রিয়ভাজন এবং দাপুটে হয়ে উঠেছিলেন তার টিকিটাও কেউ ধরতে পারেনি। শাহেদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের রুমে পায়ের ওপর পা তুলে নানা নির্দেশ দিতেন। শাহেদের মামলায় আসামি হয়েছেন বেচারা স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক। আর সচিব নিরাপদ প্রস্থান করে এখন নিবিড় অবসরে সময় কাটাচ্ছেন। দুজনের অপরাধের পার্থক্য কী? একজন স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা এজন্য তিনি এখনো কোর্টের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে তার জুতো ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। অন্যজন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা, এজন্য তিনি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। আর ‘শাহেদ’কে যিনি অপত্য¯েœহ দিয়ে প্রতারক বানিয়েছেন, তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমলারা এখন এতটাই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশও তারা মানছেন না। এক বছর আগে প্রধানমন্ত্রী আমলাদের সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই নির্দেশ আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। বাংলাদেশ একটি ভয়ংকর আমলাতন্ত্রের দুষ্টচক্রে ঢুকে পড়েছে। এখন আমলারা রাজনীতিবিদদের চেয়ে বড় রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন সম্প্রতি। আমলারা সুকৌশলে নিজেদের দায়মুক্তির জন্য একটি অসাংবিধানিক আইন সরকারকে দিয়ে সংশোধন করিয়েছিল। ওই আইন অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেফতারে কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতির বিধান করা হয়েছিল। ২৫ আগস্ট বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগ এক ঐতিহাসিক রায় দেন। ওই রায়ে সরকারি চাকরি আইনের ৪১(১) ধারা সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল ঘোষণা করে। বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ওই রায় ঘোষণা করে। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এ রায় একটি মাইলফলক। এর ফলে আমলাদের জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হবে। এ রায় সর্বব্যাপী আমলা আগ্রাসন ঠেকানোর ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে। কিন্তু আমি হতাশ হয়েছি জাতীয় সংসদে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে সরকার। অন্য ক্ষেত্রে মন্ত্রীরা কথা বলেন কিন্তু কাজ করেন না। এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিমন্ত্রী বাহাদুরের ত্বরিত তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। হাই কোর্টের রায়ের সাত দিনের মধ্যে ১ সেপ্টেম্বর আমলাদের বাঁচাতে আপিল বিভাগের দ্বারস্থ হয়েছে সরকার। চেম্বার কোর্ট হাই কোর্টের রায় স্থগিত করেছেন ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত। সরকার কেন কিছু আমলার অপকর্মের দায়ভার নিচ্ছে। দুর্বৃত্তদের ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না কেন? আমলারা কি সংবিধানের ঊর্ধ্বে? সব সরকারের আমলেই একটি ক্ষুদ্র আমলা গোষ্ঠী তৈরি হয়। এরা চাটুকারিতা দিয়ে সরকারকে খুশি করে। সরকারের ভালো উদ্যোগগুলোকে অসফল করে। ভুল তথ্য দিয়ে সরকারকে বিভ্রান্ত করে। পট পরিবর্তনের পর এদের ভোল পাল্টাতে সময় লাগে না। ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু বলে যে আমলারা জিকির করতেন, খুনি মোশতাক কিংবা জিয়ার আজ্ঞাবহ ক্রীতদাস হতে তারা সময় নেননি। জিয়া খাল কাটা বিপ্লবের ভূয়সী প্রশংসা করে পিএইচডি থিসিস করা আমলা সময় বদলাতেই আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক হয়ে যান। এরশাদের রাজসভার আলোকিত করা আমলারা এরশাদের পতনের পরপরই বিএনপির টিকিট নিয়ে মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন। আওয়ামী লীগ আমলে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকাতর আমলারা বিএনপি ক্ষমতায় আসতেই জিয়া সৈনিকে পরিণত হয়েছে। আমলারা হলেন গিরগিটির মতো। সময় বদলালেই রং বদলায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসল শক্তি এ দেশের প্রান্তিক জনগণ। শেখ হাসিনা ১৮ বছর বেশি সময়ে দেশ পরিচালনায় বারবার প্রমাণ করেছেন তিনি কারও ওপর নির্ভরশীল নন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কোনো আমলার স্থায়ী ঠিকানা হয়নি। ২০১৮-এর নির্বাচনের আগেও যে আমলা নিজেকে উপপ্রধানমন্ত্রী মনে করতেন, এখন তিনি ‘নো বডি’। শেখ হাসিনার কাছে কেউ অপরিহার্য নন।

কিছু আমলা ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ের জন্য দেশের অনেক ক্ষতি করছেন। অবসরের পর বেতন, বাড়ি-গাড়ির লোভে অনেক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করছেন। এদের ব্যাপারে নির্মোহ হওয়ার এখনই সময়। হাই কোর্টের রায় সরকারের সামনে সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।

আমার বন্ধুর ক্রিকেট গল্প দিয়ে এ লেখাটা শুরু করেছিলাম। তার গল্পের শেষটা হলো এ রকম : আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম আমলাদের হাতে ক্রিকেটের দায়িত্ব দিলে কী লাভ হতো? উত্তরে বন্ধুটি বলল, বাংলাদেশ আফগানিস্তানের সঙ্গে খেলতই না। আমলারা ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রণ নিলে বাংলাদেশ খেলত নেপাল, হংকং, কেনিয়া, জিম্বাবুয়ের মতো দলগুলোর সঙ্গে। হারত কম, জিতত বেশি। ব্যস! পরিসংখ্যান দিয়ে আমলারা বুঝিয়ে দিত আমাদের ক্রিকেটের সাফল্য। এরপর ক্রিকেট উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য জনপ্রশাসন পদকও পেতেন আমলারা। আমরাও ডুগডুগি বাজিয়ে বলতাম ‘আহা কি আনন্দ’।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর