সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

জাতীয় কর্মকান্ডে সবাইকে সম্পৃক্ত করতে হবে

নূরে আলম সিদ্দিকী

জাতীয় কর্মকান্ডে সবাইকে সম্পৃক্ত করতে হবে

মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করে আল্লাহর অশেষ রহমতে আপাত সুস্থ হয়ে দেশে ফিরেছি। ব্যাংককে মেডপার্ক হসপিটালে আমি চিকিৎসা গ্রহণ করেছি। বিমুগ্ধ চিত্তে আমি অবলোকন করেছি শুধু মেডপার্ক হসপিটালের চিকিৎসা প্রদানকারী ডাক্তার নার্স ওয়ার্ডবয়রাই নয়, সেখানকার সব মানুষই ভীষণভাবে সুশৃঙ্খল। নিয়ম-নীতির বাইরে তারা এক পা-ও ফেলে না। তাদের কর্তব্যনিষ্ঠা বিস্ময়কর। বিশ্বখ্যাত লাঙ বিশেষজ্ঞ ড. আরাকান এবং হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ড. চাঁদ আমাকে চিকিৎসা প্রদান করেছেন। জগৎজোড়া তাদের সুখ্যাতি, সুনাম ও যশ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা এতটাই নিরহংকার এবং খোলামেলা ও অমায়িক যে, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সেটি কল্পনারও বাইরে। চিকিৎসা চলাকালীন প্রতিটি মুহূর্তে তারা হাস্যোজ্জ্বল এবং আন্তরিকভাবে আমার সঙ্গে আলাপ করতেন এবং এমনভাবে আচরণ করতেন যেন আমার কিছুই হয়নি। অথচ আমার হার্টে চারটা রিং পরানো হয়েছে। এবার আমি ব্যাংকক গিয়েছিলাম সাধারণ চেক-আপের জন্য। আমার হৃদযন্ত্রে যে এত বিরাট সমস্যা বাসা বেঁধেছে, তা আমার কল্পনার আবর্তেও ছিল না। আমার শরীরে হৃদরোগের আনুষঙ্গিক কোনো লক্ষণও পরিদৃষ্ট হয়নি। অথচ দৈবক্রমে আমি যথাসময়ে মেডপার্ক হসপিটালে যেতে না পারলে আমার ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত, যেটা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। আমাদের সবার অজান্তেই আমরা যথাসময়ে যথাস্থানে পৌঁছাতে পেরেছি। আমি দৃঢ় প্রত্যয়ে নিষ্ঠাবান চিত্তে নিষ্কলুষ মানসিকতায় বিশ্বাস করি, কেবল আল্লাহর রহমত থাকলেই যথাসময়ে যথাস্থানে পৌঁছানো যায়। একেই বলে নিয়তির টান- আল্লাহতায়ালার সীমাহীন মেহেরবাণী।

মেডপার্ক হসপিটালে অত্যাধুনিক চিকিৎসার যন্ত্রসামগ্রী রয়েছে এবং সব যন্ত্রসামগ্রীই জার্মানির তৈরি। এ মহামূল্যবান যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও প্রয়োগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থেকে শুরু করে ওয়ার্ডবয় ও ক্লিনার পর্যন্ত সবার আন্তরিকতা, সততা ও একনিষ্ঠতা আমি গভীরভাবে পরিলক্ষণ করেছি। আমি প্রতিনিয়তই ভেবেছি এরকম একটি চিকিৎসা কেন্দ্র আমাদের দেশে গড়ে ওঠে না কেন? পুঁজি বিনিয়োগ করার মতো যথেষ্ট পুঁজি বাংলাদেশিদের রয়েছে। সত্যি বলতে কী, বিপুল বিনিয়োগের মাধ্যমে আমাদের দেশেও বেশ কয়েকটি অভিজাত ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা থাইদের পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি। তার কারণ, আমাদের কর্তব্যনিষ্ঠা, শৃঙ্খলাবোধ ও নিয়মানুবর্তিতার প্রচন্ড অভাব। শুধু বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসার যন্ত্রপাতি দিয়ে ওই পর্যায়ের চিকিৎসা হয় না। মানসিকতার মানদন্ডের ওপরে সবকিছু নির্ভরশীল। রাস্তাঘাটে, বাজারে, প্রান্তরে সর্বত্রই একটা পরিপাট্যের চূড়ান্ত নিদর্শন ও দৃষ্টান্ত সেখানে বিরাজমান। আমাদের দেশের কয়েকটি উচ্চমূল্যের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ আনা হয়েছিল। কিন্তু আন্দোলন করে সেøাগান দিয়ে তাদের অনেককে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। তবুও কি আমাদের দেশের চিকিৎসাসেবা চলছে না? অবশ্যই চলছে, তবে ঢিমেতালে। আমাদের সমাজজীবনকে দুর্নীতি রাহুর মতো গ্রাস করেছে। চিকিৎসার মতো স্পর্শকাতর ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। আমার হার্টের রিং পরানোর সময় ডাক্তাররা চরম সতর্কতা ও অসীম দায়িত্ববোধের সঙ্গে আমার কিডনি ও লিভার যেন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে তাদের সতর্কতা চিত্তকে বিস্ময়াভিভূত করেছে, বিবেককে বিমুগ্ধ করেছে। ওদের সঙ্গে আমাদের তুলনা করলে নিদারুণ হতাশার কালো মেঘ হৃদয়ের বিস্তীর্ণ আকাশকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।

জাতি হিসেবে আমরা একবারই ঐক্যবদ্ধভাবে সমুন্নত বিবেক নিয়ে মাথা উঁচু করে মেরুদন্ড খাড়া করে দাঁড়াতে পেরেছিলাম। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের প্রাক্কালে লোভ-লালসা প্রাপ্তি-প্রত্যাশার অনেক ঊর্ধ্বে উঠেছিলাম আমরা। তখনকার প্রদীপ্ত ও প্রোজ্জ্বল আকাক্সক্ষা ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খলকে ভেঙেচুরে চুরমার করে সূর্যস্নাত মুক্তির আস্বাদন করা। কী পাব, কী পাব না এ ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক চিন্তা ও চেতনা আমাদের হৃদয়কে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। পৃথিবীর মধ্যে আমরা একটা নতুন ও প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত প্রতিস্থাপন করেছিলাম। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা এরই মধ্যে পেরিয়ে এসেছি। করোনার আতঙ্কে বিপর্যস্ত জাতি আড়ম্বরের সঙ্গে সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে না পারলেও আমাদের হৃদয়ের সব আঙ্গিকজুড়ে আমরা পরিতৃপ্তি ও গৌরবের আবীর মেখেছি। পদ্মা সেতু নিয়ে উত্তেজনা আবেগ প্রচার-প্রচারণা অনেকটাই কমে এসেছে। পদ্মা সেতু যে আমাদের একটি বিশেষ অর্জন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এরকম একটি অর্জন নিতান্তই প্রত্যাশিত। তদুপরি পদ্মা সেতু নিয়ে প্রচার-প্রচারণার আড়ম্বরতা অনেক বেশি ছিল। একটি স্বাধীন জাতির সুবর্ণজয়ন্তীর পর এরকম একটি স্থাপনা অর্জন হবে না, এটা তো চিন্তার বাইরে। তবুও পদ্মা সেতু আমাদের একটি বিশেষ অর্জন ধরে নিয়েও একে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। একটি জাতি একবারই স্বাধীন হয় এবং সেই স্বাধীনতার গৌরব তার প্রজন্মের পর প্রজন্ম শতাব্দীর পর শতাব্দী লালন করে। এ চলমান শতাব্দীর মধ্যেই অসংখ্য স্থাপনা গড়ে ওঠে, অসংখ্য সাফল্য অর্জিত হয়। সে সবই জাতীয় চেতনাকে আন্দোলিত করতে পারে। সব নাগরিকের নাড়ির বন্দরে একটি শিহরণও জাগাতে পারে। তাই বলে এসব অর্জনকে স্বাধীনতা অর্জনের সঙ্গে তুলনা করা যায় না।

আবারও বলি, আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে অর্জন যেমন উল্লেখযোগ্য, তেমনি ব্যর্থতাও প্রকট। দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চা তো নেই-ই, মৌলিক অধিকারের প্রয়োগ বাস্তবে প্রায় শূন্যই বলা চলে। দেশে কার্যকর বিরোধী দল আজ আর নেই। নামেমাত্র বা সংবাদপত্রে বা বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিরোধী দলের যে অস্তিত্ব আমরা অবলোকন করি, তা একান্তই নিঃসার, নিস্তেজ এবং প্রাণশক্তিহীন। তাদের মধ্যে দোদুল্যমান অনুভূতির প্রভাব প্রকট। নিরবচ্ছিন্নভাবে তারা নিজেদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছেন। কোন আক্কেলে তারা একটার পর একটা নির্বাচন বর্জন করে চলেছেন, তা সত্যিই বোধগম্য নয়। নির্বাচনে না এলে বিপ্লব ছাড়া সরকার পরিবর্তন তারা করবেন কীভাবে? দেশজুড়ে একটা বিপ্লব ঘটানোর ক্ষমতা তাদের যে নেই সেটা অতি সুস্পষ্ট। ১৯৭০ সালে সামরিক শাসকের অধীনে আমরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। সামরিক শাসনের রুদ্ধদ্বার জনগণের প্রবল সমর্থনের আঘাতে আমরা চূর্ণবিচূর্ণ করতে পেরেছিলাম। সেটি শুধু নির্বাচনই ছিল না, ছিল শোষণ, বঞ্চনা এবং প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কুটিল প্রয়াসকে চূর্ণবিচূর্ণ করে বাঙালি জাতীয় চেতনার পূর্ণ বিকাশের এবং স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উত্তীর্ণ হওয়ার অগ্নি পরীক্ষা বা মাহেন্দ্রক্ষণ। সমগ্র বিশ্বকে সত্তরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা জানান দিতে পেরেছিলাম যে, বাঙালি একটি সুশৃঙ্খল ও ঐক্যবদ্ধ জাতি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার যে চেতনার মহিরুহটি অঙ্কুরিত হয়েছিল সেটি প্রচন্ড বিস্ফোরণে সত্তরের নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয়ের মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়। এ বিস্ফোরণ ঘটাতে আন্দোলনের অনেকখানি পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার দীর্ঘ পথে পরিক্রমণে ৫২ থেকে ৬২, ৬২ থেকে ৬৬ এবং ৬৬ থেকে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, সবকিছু মিলিয়ে বাঙালির যে মনন ও মননশীলতা- আগ্নেয়গিরির যে গলিত লাভা তিলে তিলে সঞ্চিত হয়েছিল তারই বিস্ফোরণ ঘটে ৭০-এর নির্বাচনের অভূতপূর্ব বিজয়ের মধ্য দিয়ে। আমি বিশ্বাস করি, ৭০-এর নির্বাচন বিশ্বকে বিস্ময়াভিভূত করলেও এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এর জন্য অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, অনেক নির্যাতন-নিগ্রহ ও নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে। অনেকটা পথ রঞ্জিত হয়েছে মিছিলের উদ্ধত মানুষের বুক-নিঃসৃত রক্তে।

এখানে আমি বিরোধী দলকে বিনম্র চিত্তে পরামর্শ দিতে চাই- আপনারা রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞে আরও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করুন। নির্বাচনকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে এটাও তো কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছার একটা শক্ত ও সুদৃঢ় সোপান হতে পারে। দাম্ভিকতার নেশায় বুঁদ হয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে একটি বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর হয়ে যারা রাজনীতিতে স্বকল্পকল্পিত সাফল্য অর্জন করতে চান- তাদের উদ্দেশ্যে বলি, জনগণের সক্রিয় অংশীদারিত্ব ছাড়া কোনো সাফল্য অর্জিত হওয়া সম্ভব নয়। জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারলে আন্দোলনের সফলতা যেমন নিশ্চিত, তেমনি সরকার পরিবর্তনের বাস্তবতাও অর্জিত হয়। বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করেছিল বলেই যেনতেন প্রকারের একটি নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালের নির্বাচনে এ অস্বাভাবিক বিজয়টি পেয়ে যায়। বিগত নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ নিলে অবশ্যই তারা একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সংসদ সদস্য পেয়ে যেতেন এবং সংসদেও তারা অর্থবহ ও কার্যকর বিরোধিতার প্রচন্ড ঝড় তুলতে পারতেন। ওই নির্বাচনে বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপি সরাসরি কোনো মনোনয়ন দেয়নি, অথচ বিএনপির অসংখ্য সদস্য প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। একেকটি আসনে বিএনপি-সমর্থক একাধিক প্রার্থী নির্বাচনে লড়াই করলে ভোট ভাগাভাগি হয়েছে। সেসব ভোট একত্রে যোগ করলে দেখা যাবে ২০১৮ সালের নির্বাচনেও উল্লেখযোগ্য সংসদ সদস্য বিএনপি পেতে পারত। তাহলে বিএনপির পক্ষে সংসদে এবং রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলা অনেক সহজ হতো এবং কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হতো।

দেশবাসী জানে, আওয়ামী লীগ সরকারের শুধু পদ্মা সেতুই নয়, রাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ অঙ্গনে তাদের ছোট-বড় আরও অনেক সাফল্য রয়েছে। তার পাশাপাশি রয়েছে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অসহ্য দুর্নীতি। সরকারের অনেক কাজের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, সুষ্ঠু পরিকল্পনা বিবর্জিত অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রয়াস, জাতিকে তার কাক্সিক্ষত অর্জন থেকে বঞ্চিত করেছে। এটি জাতির জন্য শুধু অনাকাক্সিক্ষতই নয়, সরকারের একটা নিদারুণ ব্যর্থতাও বটে। বিভিন্ন অধিদফতরকে সমন্বিত করা সরকারের কাজ। সমন্বয় বিবর্জিত কোনো প্রচেষ্টা বা কর্মকান্ড কাক্সিক্ষত ফলাফল আনতে পারে না। অন্যদিকে দুর্নীতি যক্ষ্মা বা ক্যান্সারের মতো জাতির বক্ষকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তাই সরকারপ্রধানের প্রয়াসকে খাটো না করে বলা যেতে পারে, যে কোনো মূল্যে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে সম্ভাব্য দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে এবং উন্নয়নের সব কর্মকান্ডে একটা নিবিড় যোগসূত্র আনতে হবে। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, একটা জাতীয় জীবনে অতিক্রান্ত ৫০ বছর কম সময় নয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি এবং জাপান পর্যুদস্ত ও ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এ দুটি দেশকে আঘাতে আঘাতে গুঁড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। চূর্ণবিচূর্ণ করা হয় তাদের কলকারখানাসহ অসংখ্য স্থাপনা। কিন্তু কী বিস্ময়কর তাদের অভ্যুদয়। আশ্চর্যজনক আত্মপ্রত্যয় নিয়ে তাদের ঘুরে দাঁড়ানো, ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনার ছাই সরিয়ে সেখানে তারা আগের চেয়েও অতুলনীয় সুন্দর শুধু স্থাপনাই গড়ে তোলেনি, শিল্পের বিভিন্ন অঙ্গনে তারা বিশ্ববাজারে নেতৃত্বের আসনে নিজেদের প্রতিস্থাপিত করতে পেরেছে। বিভিন্ন যন্ত্রপাতি উৎপাদনে তাদের দক্ষতা, আশ্চর্যজনক সব উদ্ভাবন বিশ্ববাজারে প্রচন্ডভাবে সমাদৃত এবং অনেক ক্ষেত্রে একচেটিয়া বাজার সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে।

আমি আগেই বলেছি, আবারও বলতে চাই, চিকিৎসার বিভিন্ন অঙ্গনে, সেটা কি ওষুধপত্রে বা চিকিৎসাযন্ত্রে তাদের উদ্ভাবন ও অর্জন জগৎসেরা বললেও অত্যুক্তি হবে না। তাদের এ অর্জন ও সফলতার পেছনে হার না মানা জাতীয় চেতনাবোধ, ভস্মীভূত পাদপীঠ থেকে সফলতার হিমাচল গড়ে তোলার সুতীব্র আকাক্সক্ষা, জাতীয় ঐক্য, সততা ও শৃঙ্খলা তাদের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ক্রমাগত অগ্রসর হতে সক্ষম করে তুলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতীয় চেতনাবোধ, ঐক্য ও শৃঙ্খলা ছাড়া আর কিছুই তাদের অবশিষ্ট ছিল না এবং সমগ্র বিশ্বকে তাক লাগিয়ে তারা দেখিয়ে দিল, একটি পরাজিত জাতির সততা, শৃঙ্খলা, উদ্যম ও ঐক্য, কাজের প্রতি অসীম আগ্রহ দিয়ে সেই জাতি আকাশছোঁয়া সাফল্যের স্বর্ণশিখরে নিজের আসন পাততে পারে। আমরা যে স্বাধীনতাযুদ্ধে অমিত বিক্রমে লড়াই করেছি, এখানেও জাতীয় চেতনা, ঐক্য ও সততাই ছিল আমাদের প্রধান হাতিয়ার। একটা দুর্ধর্ষ সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে আমরা চরম সাহসিকতার সঙ্গে বুক চিতিয়ে লড়েছিলাম দেশাত্মবোধের প্রচন্ড শক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে। আমেরিকার ডেমোক্র্যাট দলীয় নির্বাচিত জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত একটি ভাষণে বলেছিলেন- “Ask not what your country can do for you- ask what you can do for your country.” এ ঐতিহাসিক উক্তিটির প্রেক্ষাপটেই আমরা ভাবী না কেন, আমরা দেশের জন্য নিজ নিজ আঙ্গিক থেকে কে কতটুকু দিতে পেরেছি? পাওয়ার হিসাব কড়ায়-গন্ডায় অনেক করেছি। এখন দেশকে কী দিয়েছি সেটাই হিসাব করার পালা। আমি বলতে চাই, ব্যক্তিগতভাবে দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা দেশের জন্য কে কতটুকু করেছি তা ভাবার সময় এসেছে। দেশ এককভাবে সরকারের নয়, আমাদের সবার। যার যার আঙ্গিক থেকে স্ব স্ব কর্মকান্ড ও আন্তরিকতার মাধ্যমে দেশকে কিছু দিতে পারলেই দেশ এগিয়ে যাবে। এ প্রবহমান অগ্রযাত্রার শুভ সূচনা আজ আমাদের কাম্য। সরকারের সমালোচনা করব না তা নয়, তবে দেশের সৃজনশীল অগ্রযাত্রায় আমরা কে কতটুকু অবদান রাখতে পারলাম তা ভেবে দেখা আজ অত্যন্ত প্রয়োজন।

লেখক : স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি।

সর্বশেষ খবর