শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

কারাদন্ডের প্রশ্নে বেআইনি আদেশ

শহীদুল্লাহ ফরায়জী

কারাদন্ডের প্রশ্নে বেআইনি আদেশ

গণমাধ্যমে প্রকাশ, ২৯ আগস্ট চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট গাঁজা উদ্ধারের মামলায় দুই আসামি দোষ স্বীকার করায় সাজার পরিবর্তে এক বছর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার আদেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি দুটি এতিমখানায় দুজন এতিমকে বাংলা অনুবাদসহ দুটি কোরআন শরিফ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। দুই আসামি হলেন মোহাম্মদ হোসেন ও আবদুর রহিম। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরীফুল ইসলাম এ রায় দেন। প্রথমত এ রায়ে আইন দ্বারা নির্ধারিত ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়নি। কথিত অপরাধের আইনে যা সংজ্ঞায়িত করা আছে বা যে শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে তার পরিবর্তন বা পরিবর্ধন বা সংশোধনের কোনো এখতিয়ার আদালতের নেই। এমনকি নিম্নতম আদালতে সংবিধান বা আইন নিয়ে পর্যবেক্ষণ দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। নিম্ন আদালত আইনের কোন ধারায় এ শাস্তি নির্ধারণ করেছেন? কোনো আদালত বিদ্যমান বা কথিত আইনের বাইরে কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারেন কি?

গাঁজা উদ্ধারের মামলায় বিচারক তাঁর বিবেচনায় গুরুদন্ড দিতে পারেন, লঘুদন্ড দিতে পারেন বা সাক্ষ্য-প্রমাণে নির্দোষ ঘোষিত হওয়ায় বেকসুর খালাস দিতে পারেন কিংবা আইনে নির্ধারিত অন্য কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারেন। কিন্তু কোনোক্রমেই ধর্মবিশ্বাসকে বাধ্যতামূলক বা শর্ত সাপেক্ষে ধর্মকে আদালতের আওতাধীন করতে পারেন না। ইসলাম ধর্ম নিজেই যেখানে জবরদস্তিকে অস্বীকার করেছে। ‘আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা’ বইয়ে সাবেক বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেছেন, ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই- সুরা বাকারা, তোমাকে ওদের ওপর জবরদস্তি করার জন্য পাঠানো হয়নি- সুরা কাফ, বল হে কিতাবিগণ, তোমরা তোমাদের ধর্ম সম্বন্ধে বাড়াবাড়ি কোরো না-সুরা মায়িদা। কে ধর্ম পালন করল বা পালন করল না তাদের বিষয়ে আল্লাহর এখতিয়ার। পরকালের বিচারের ভার আদালতের নয়। আর আইন হচ্ছে বর্ণধর্মনির্বিশেষে সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিক সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী, যা সবার জন্য অবিচ্ছেদ্য অধিকার। একজন অভিযুক্তকে নামাজ পড়তে বাধ্য করা, সে নির্দেশ পালন করছে কি না তা তদারকির জন্য প্রবেশন অফিসার নিয়োগ করা এ ধরনের নির্দেশ বিদ্যমান সংবিধান, নৈতিকতা এবং বাস্তবতার সঙ্গে কতটুকু সংগতিপূর্ণ? আইন ভঙ্গ করলে বিচারিক প্রক্রিয়ায় বিচারের মুখোমুখি হবেন, একে উপেক্ষার কোনো সুযোগ নেই। আদালতের রায় অবশ্যই সংবিধানের অধীন। মামলা নিষ্পত্তিতে আইনের শুধু সেই অংশটুকু প্রয়োগ করা উচিত যেটুকু বিচারকরা আইন অনুযায়ী প্রয়োগ করতে পারেন। নামাজ পড়া, বই কিনে উপহার দেওয়া এ ধরনের নতুন কোনো আইন বিচারক প্রণয়ন করতে পারেন না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটা বিচার বিভাগের ভূমিকার সঙ্গে চরমভাবে সাংঘর্ষিক। এ ধরনের বাধ্যবাধকতা আইনের পরিপন্থী, আইনের শাসনের পরিপন্থী এবং মানবাধিকারের পরিপন্থী। আইন সব নাগরিকের জন্য সমানভাবে প্রয়োগ হবে, কোনো প্রকার পার্থক্যকে আইন ন্যায্যতা দিতে পারে না। আদালতকে নাগরিকের ব্যক্তিস্বাধীনতা পর্যাপ্ত সুরক্ষা প্রদান করতে হয়। রাষ্ট্র ধর্ম ও বর্ণ ভেদে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করতে পারে না। বিচারিক দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের আইনে দক্ষতা, নৈতিকতা এবং যোগ্যতা না থাকলে আইনের শাসন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এর আগে ১৪ জুন একই আদালত এক শিল্পীর করা মানহানি মামলায় চট্টগ্রামের সংগীতশিল্পী ফাহমিদা রহমানকে ছয় মাসের কারাদন্ডের বদলে ছয় মাস পর্যন্ত বিনা বেতনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের গান শেখানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী।

রায়ে আদালত বলেন, আসামি একজন নারী ও সংগীতশিল্পী। তাই তাঁকে ছয় মাসের কারাদন্ডের বদলে ছয় মাস পর্যন্ত বিনা বেতনে সংগীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের গান শেখাতে হবে। এ ছাড়া আসামিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে দুটি গান ফ্রি গাইতে হবে কিংবা দুটি গানের সম্মানি নিয়ে সেই টাকায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বা তাঁকে নিয়ে লেখা বই কিনে তা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে দিতে হবে। এসব কর্ম সম্পাদিত হয়েছে কি না, তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আদালতকে জানাতে হবে।

প্রশ্ন হচ্ছে- শিল্পী, কবি বা সাহিত্যিক কোথায় তাঁর জ্ঞান বা মেধা বিতরণ করবেন তা আদালতের নিয়ন্ত্রণাধীন কি না? একজন বিচারক তাঁর নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী মনগড়া আদেশ দিয়ে বিচার কাজকে প্রহসনে পরিণত করতে পারেন কি না? বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নামে কোনো বিচারক তাঁর ওপর অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার করতে পারেন কি না? এ ছাড়া বাংলাদেশ টেলিভিশনে তালিকাভুক্ত কোনো শিল্পীর ফ্রিতে গান গাওয়ার কোনো বিধান নেই। শিল্পী কোন টেলিভিশনে গান গাইবেন, কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গান শেখাবেন আর শিল্পকলায় বই জমা দেওয়া হয়েছে কি না তা দেখার জন্য সরকার কোনো কর্তৃপক্ষ গঠন করেনি। তাহলে কোন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আদালতকে অবহিত করা হবে?

এ ধরনের আদেশ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিপর্যস্ত বা প্রশ্নবিদ্ধ করবে। এ ধরনের আদেশ চলতে থাকলে বিচার বিভাগ বিচার বিভাগকেই ধ্বংস করে ফেলবে। বিচার বিভাগকে রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই সুরক্ষা দিতে হবে। উচ্চতর আদালতের উচিত হবে এ লক্ষ্যে রায়সংশ্লিষ্ট বিচারকার্য তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণ সাপেক্ষে রায় প্রদানকারী ম্যাজিস্ট্রেটদের বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়াসহ সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ মোতাবেক অধস্তন আদালতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং নিম্ন আদালতের এসব আইনবহির্ভূত রায় যথাযথ প্রক্রিয়ায় বাতিল করা। জনস্বার্থে মোকদ্দমা করে এসব বিষয় সুপ্রিম কোর্টের নজরে আনা যেতে পারে। অথবা সুপ্রিম কোর্ট তাঁর স্বীয় এখতিয়ার প্রয়োগ করে ন্যায্য প্রতিকার করবেন এটাই ন্যায়সংগত প্রত্যাশা। রাষ্ট্রের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আদালত নির্দেশ প্রদান করতে পারেন। নাগরিকের মৌলিক ও মানবাধিকার সুরক্ষা রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যকর। কোনো প্রকার বৈষম্য ছাড়া জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে এসব অধিকার ভোগ করার অধিকারী। এগুলো প্রত্যেক ব্যক্তির সহজাত অধিকার এবং তা হস্তান্তরযোগ্য নয়, এসব অধিকার বিভাজনযোগ্য নয়। রাষ্ট্রের দায় হচ্ছে জনগণের সব ধরনের মৌলিক ও মানবাধিকার রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। বিচার বিভাগ ধ্বংস হয়ে গেলে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা শেষ হতে বেশি দেরি লাগবে না।

                লেখক : গীতিকার

[email protected]

সর্বশেষ খবর