শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

রুপালি বিপ্লবের নুরুল হক

শাইখ সিরাজ

রুপালি বিপ্লবের নুরুল হক

মাছ চাষে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য এ বছর জাতীয় পর্যায়ে স্বর্ণপদক পেয়েছেন নুরুল হক। কদিন আগেই প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ঢাকায় এ পুরস্কার তাঁর হাতে তুলে দিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক। প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগ্রহ করে হ্যাচারিতে এনে মলা মাছের রেণু উৎপাদনে সফল হওয়ায় এ পুরস্কার পেলেন তিনি। এবারই প্রথম নয়, রাষ্ট্রের কাছ থেকে পাওয়া নুরুল হকের এটি পঞ্চম পুরস্কার। নুরুল হকের মাছ চাষের দীর্ঘ ৩০ বছরের অভিযাত্রার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছি আমি। খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে নুরুল হকের মাছ চাষের এ বিপ্লব।

নুরুল হকের বাড়ি ময়মনসিংহে। আগস্টে তাঁর মাছের খামার ও হ্যাচারি থেকে ঘুরে এসেছি। আমি বহুবার গিয়েছি তাঁর মাছের খামারে। নুরুল হক মাছ চাষ শুরু করেন আশির দশকের শেষ দিকে। তখন তিনি আনন্দ মোহন কলেজে গণিতে স্নাতক পড়ছেন। টেলিভিশনে আমার উপস্থাপিত প্রামাণ্যচিত্র ‘হাকিম আলীর মৎস্য খামার’ দেখে অনুপ্রাণিত হন নুরুল হক। টেলিভিশনে প্রচার প্রসারণে তখন সারা দেশেই তরুণদের মধ্যে মাছ চাষ, পোলট্রি খামার গড়া, গরু মোটাতাজাকরণ প্রভৃতি কৃষিমুখী কর্মকান্ড জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। নুরুল হক মাছ চাষ শুরুও করলেন কিন্তু তাঁর মাছ চাষের সিদ্ধান্ত পরিবার মেনে নেয়নি। নুরুল হকের কথায়, ‘আব্বা বললেন লেখাপড়া শিখাইছি চাকরি করার জন্য জাল্যোয়া হইবা কেন?’ নুরুল হককে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হলো স্নাতকোত্তরে। কিন্তু তাঁর ঝোঁক মাছ চাষে। সব কিছু ফেলে মহাজনি সুদে ৩০ হাজার টাকা ধার নিয়ে কয়েকটি পুকুর ভাড়া করে শুরু করলেন পুরোদমে মাছ চাষ। ফলে তাঁর বাবা তাঁকে ঘর থেকে বের করে দিলেন। ‘বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিলেন, বাড়ির পাশে একটা মাদরাসা ছিল সেখানে রাতে থাকতাম। আর আব্বা যখন নামাজ পড়তে মসজিদে যেতেন, তখন চুপচাপ মায়ের কাছে গিয়ে খেয়ে আসতাম।’ বলছিলেন নুরুল হক।

মাছ চাষের শুরুটা সত্যিই ছিল খুব কঠিন। কৃষি ও কৃষি সংক্রান্ত কাজগুলো ছোট কাজ হিসেবেই সমাজ ধরে নিয়েছিল। শিক্ষিত মানুষ কৃষির সঙ্গে যুক্ত হবে তা অনেকেই মেনে নিতে পারতেন না। সামাজিক অবস্থাটাই ছিল এমন। নুরুল হক বলছিলেন, তিনি যখন মাছ বিক্রি করতে যেতেন বাজারে, তখন বাজার থেকে দূরে কোনো একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে থাকতেন, আর তাঁর লোক মাছ বিক্রি করত। যাতে লোকের বাঁকা কথা শুনতে না হয়। নানা ঘাত-প্রতিঘাত আর প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে যখন নুরুল হক একটু একটু করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে হাঁটছিলেন, তখন দেখলেন ধীরে ধীরে বাড়ছে তাঁর সামাজিক মর্যাদা এবং পারিবারিক সম্পর্কগুলোও হচ্ছে দৃঢ়। আমার সঙ্গে সরাসরি পরিচয়ের সূত্র ধরতে গিয়ে নুরুল হক বললেন, ‘বাড়িতে বায়োগ্যাস প্লান্ট কীভাবে স্থাপন করতে হয় সে সম্পর্কে একটা প্রতিবেদন দেখিয়েছিলেন টেলিভিশনে। অনুষ্ঠানের শেষে আপনি ঘোষণা দিয়েছিলেন ৬ টাকার ডাকটিকিট লাগানো ফিরতি খামে নাম-ঠিকানা লিখে পাঠালে বায়োগ্যাস প্লান্ট সম্পর্কিত তথ্যসহায়ক বই পাঠাবেন। আমি খামে নাম-ঠিকানা লিখেছিলাম ঠিকই, কিন্তু ৬ টাকার ডাকটিকিট লাগাতে ভুলে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম উত্তর আসবে না। কিন্তু ঠিকই উত্তর এলো। সঙ্গে এলো বায়োগ্যাস প্লান্টের তথ্যপুস্তিকা। ওটা অনুসরণ করে আমি বায়োগ্যাস প্লান্ট করেছিলাম। সেটা এখনো আছে। স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি। সেই থেকে আপনার সঙ্গে আমার চিঠির যোগাযোগ।’ নুরুল হকের কথায় মনে পড়ল প্রচুর চিঠি আসত সে সময়। প্রতি সপ্তাহে বস্তা ভরে চিঠি আসত। তখন সবে বিয়ে করেছি। আমার স্ত্রী আর আমি মিলে চিঠি পড়তাম আর উত্তর লিখতাম। এখনো অনেক চিঠির বস্তা আমার কাছে সংরক্ষিত আছে।

যা-ই হোক, মাছ চাষ করতে গিয়ে নুরুল হক লক্ষ্য করলেন ভালো পোনার সংকট। ভালো পোনা না হলে ভালো মাছ হয় না। এ সংকট উত্তরণের জন্য ১৯৯৩ সালে ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জের চরপুলিয়ামারী গ্রামে নুরুল হক হ্যাচারি গড়ে তোলেন। প্রথমে রুইজাতীয় মাছের রেণু পোনা উৎপাদন করলেও মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে শুরু করেন দেশি বিলুপ্ত প্রজাতির মাগুর ও শিং মাছের পোনা উৎপাদন। এরপর ২০০১ সালে পাবদা, ২০০২ সালে কই, খলিশা ও বোয়ালের পোনার বাণিজ্যিক উৎপাদনে সাফল্য পান। দেশি প্রজাতির মাছগুলো তিনি নেত্রকোনার হাওরাঞ্চল, ব্রহ্মপুত্র নদ আর জামালপুরের যমুনা নদী থেকে সংগ্রহ করেন। ২০১০ সাল থেকে তেলাপিয়ার সুপার পুরুষ থেকে শুধু পুরুষ পোনা উৎপাদন, ২০১৫ সালে গাংমাগুর ও ২০১৮ সালে মলা মাছের কৃত্রিম প্রজনন শুরু করেন। ২০২০ সাল থেকে রানি মাছ নিয়ে কাজ করছেন নুরুল হক। বই কিনে পড়ে নিজে নিজে কৃত্রিম প্রজনন সম্পর্কে জানার চেষ্টা আর হ্যাচারিতে নতুন জাতের মাছ চাষের আওতায় আনার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলেন প্রতিনিয়ত। কাজটি তিনি নিয়ে গেছেন সাধনার পর্যায়ে। সাফল্যও এসেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষক-শিক্ষার্থী আর বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকদের অনেকের সঙ্গেই তাঁর সখ্য গড়ে উঠল। যে মাছগুলোর কৃত্রিম প্রজননে ব্যর্থ হয়েছেন গবেষকরা সেসবের মধ্যে অনেক মাছের কৃত্রিম প্রজননে সফলতা অর্জন করেছেন নুরুল হক।

মাছ চাষে সফল উদ্যোক্তার উদাহরণ হিসেবে নুরুল হক আজ অনুসরণীয়। সাফল্য তাঁর হাতে ধরা দিয়েছে নানাভাবেই। তার স্বীকৃতিও পেয়েছেন বহুবার। পরিশ্রম, অদম্য ইচ্ছা আর দৃঢ় মনোবলই এ অবস্থানে নিয়ে এসেছে মাছ চাষি নুরুল হককে। মাছ চাষে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৭ সালে জাতীয় যুব পুরস্কার, ১৯৯৮ সালে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ পদক (রৌপ্য), ২০০৯ সালে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ পদক (স্বর্ণ) ও ২০১২ সালে বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক (ব্রোঞ্জ) পান। সর্বশেষ ২০২২ সালে পেয়েছেন মলা মাছের রেণু উৎপাদনে সফল হওয়ায়।

মাছ চাষ শুরু করায় পরিবার থেকে বিতাড়িত হওয়া নুরুল হক এখন শুধু পরিবারের গর্ব নয়, দেশের গর্ব। আর্থিক সফলতাও কম নয় তাঁর। ৩০ হাজার টাকা ধার নিয়ে মাছ চাষ শুরু করা নুরুল হকের এখন কোটি টাকার সম্পত্তি। ময়মনসিংহ শহরের প্রাণকেন্দ্রে দুটি বহুতল বাড়ি। শহরতলি শম্ভুগঞ্জের চরপুলিয়ামারীতে গড়ে তুলেছেন ব্রহ্মপুত্র ফিশ ফিড কমপ্লেক্স। কিনেছেন ২০ একর জমিও। শুধু নিজেই সফলতা অর্জন করেননি। তাঁর অনুসারী অসংখ্য মাছ চাষি আজ সফল। হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে চলেছেন তাঁরা।

নুরুল হক এখানেই থামতে চান না। আরও পথ হাঁটতে চান। সে লক্ষ্যেই কাজ করে চলেছেন। প্রযুক্তির মাছ চাষে দারুণ আগ্রহী তিনি। তার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন।

কয়েক দশক ধরে সারা দেশে ঘটে গেছে রুপালি বিপ্লব। মাছ চাষের বিকাশ একদিকে যেমন দূর করেছে অসংখ্য তরুণের বেকারত্ব, অন্যদিকে আমাদের আমিষের চাহিদার বড় অংশই পূরণ হচ্ছে এ খাত থেকে। আবার মোট রপ্তানি আয়ের ৬ শতাংশ আসছে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে। এ অর্জনে নুরুল হকের মতো এ মানুষগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। মাছ চাষের পাশাপাশি তাঁদের নিজস্ব গবেষণায়ও সমৃদ্ধ হচ্ছে মৎস্য খাত। আমার বিশ্বাস, এ সাফল্যের ধারা অব্যাহত থাকলে তাঁদের উদ্ভাবিত রুপালি আলোয় আলোকিত হবে আগামীর বাংলাদেশ।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর