সোমবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

সময়ের সাহসী সন্তান

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

সময়ের সাহসী সন্তান

যখন দেশে ও সমাজে সত্য বলার মানুষের বড় অভাব, তখন যিনি সাহস করে সত্য বলতেন, কে কী ভাবলেন, পরোয়া করতেন না, সীমাবদ্ধ ও সংকীর্ণ বৃত্তের বাইরের এই মুক্তবুদ্ধি মানুষটি ছিলেন আকবর আলি খান (১৯৪৪-২০২২)। ইতিহাসের ছাত্র এবং শিক্ষক, ফলিত অর্থনীতিবিদ, মেধাবী আমলা এবং সবার ওপরে একজন গবেষক-লেখক ছিলেন তিনি। তার স্বগোতুক্তি ‘যদি কোনো বিষয়ে আমার নিজের কোনো বক্তব্য না থাকে, তাহলে সেটি নিয়ে আমি লিখি না। আমার প্রতিটা বই-ই আমার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা। আমার নিজস্ব বক্তব্যটি কারও কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, না-ও হতে পারে।’ অধিত বিদ্যা, প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা এবং গবেষণাধর্মী চিন্তা চেতনার আলোকে তিনি দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার সৎসাহস রাখতেন। ‘কীভাবে সৎভাবে জীবনযাপন করতে হয়, দুঃসময়েও সাহস নিয়ে কথা বলতে হয়, প্রান্তজনবঞ্চিত মানুষের অধিকারের পক্ষে দাঁড়াতে হয় এবং নানাভাবে রাষ্ট্র ও সমাজের দায় শোধ করতে হয়, তার সমুজ্জ্বল উদাহরণ সদা জ্ঞানপিপাসু ড. আকবর আলি খান।’ ২০১৪-এর মার্চ মাসে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রীর হাতে যত ক্ষমতা মুঘল সম্রাটেরও তত ক্ষমতা ছিল না। ‘দশম সংসদীয় নির্বাচন সংবিধান মোতাবেক অনুষ্ঠিত হলেও নৈতিকভাবে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচন হয়নি’ সে সময় সুদৃঢ়ভাবে এ মন্তব্যের সঙ্গে তিনি যোগ করেছিলেন ‘দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে নির্বাচন পদ্ধতি’। জনপ্রশাসন বিষয়ের ওপর ইংরেজি ভাষায় তিনি “গ্রেশাম’স ল সিনড্রোম অ্যান্ড বিয়ন্ড : অ্যান অ্যানালাইসিস অব দ্য বাংলাদেশ ব্যুরোক্রেসি” নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এটি ২০১৫ সালে ইউনিভার্সিটি প্রেস লি. কর্তৃক প্রকাশিত হয়। তিনি মন্তব্য করেন, ‘দেশে নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা আছে। বাংলাদেশে সিভিল সার্ভিসকে দুর্বল বানানো হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করতে পারছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পাশের দেশ ভারতে নির্বাচন নিয়ে এমন প্রশ্ন নেই। ভারতে যারা নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা হন, তারা প্রশাসনের কর্মকর্তা। বাংলাদেশে সিভিল সার্ভিস এখন এত দুর্বল করা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দল ডিসিকে বিশ্বাস করে না। ...ভারতে দুই-তিন মাস ধরে নির্বাচন চলে। ব্যালট বাক্স থাকে ডিসির কাছে। বাংলাদেশে কি এমন একজন ডিসি পাওয়া যাবে, যার কাছে এক রাতের জন্য ব্যালট বাক্স রাখতে রাজি হবে? তারা পক্ষপাতের বদনাম কিনে নিয়েছেন। তাদের সে সাহসও নেই।’ সুশীল সমাজের ভূমিকা নিয়েও তার বিজ্ঞ অভিমত-, ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সুশীল সমাজের কাজ জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ তুলে ধরা। গণতন্ত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সুশীল সমাজ। সুশীল সমাজ গড়ে না উঠলে গণতন্ত্রের ভিত দুর্বল হয়। সরকার বলছে, সুশীল সমাজ শুধু সরকারের সমালোচনা করে; তারা যদি সরকারের প্রশংসা করে, তাহলে সমালোচনা করবে কে? সমালোচনা যারা করে, তারা বন্ধু, শত্রু নয়।’ বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে স্থানীয় সরকার নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণেই স্থানীয় সরকার চলছে। স্থানীয় সরকারের আর্থিক ক্ষমতা নেই। এখানে জনপ্রতিনিধি ও কর্মচারীদের বেতন কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ থেকে আসে। বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় সরকার এতিম নয়, বরং তা এত বেশি ক্ষমতাশালী, যা পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। আবার স্থানীয় সরকারে এমপিদের উপদেষ্টা হওয়ার নিয়ম একমাত্র বাংলাদেশেই আছে। স্থানীয় সরকারের অনিয়ম ও অভিযোগের তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। অথচ এ ধরনের তদন্তের জন্য স্বাধীন কমিশন থাকা উচিত। অতীতে একটি কমিশন থাকলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।’

সদা ইতিবাচক এবং আশাবাদী আকবর আলি খান সতর্কবার্তা পৌঁছানোতে পিছপা হননি- ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যেখানে বাংলাদেশ ছিল, এখন আর সেখানে নেই। খাদ্য উৎপাদনসহ অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে অসামান্য সফল্য দেখিয়েছে। ১৯৭১ সালে আমরা যে বাংলাদেশ দেখেছি, তার সঙ্গে তুলনা করলে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এত অগ্রগতি হবে, আমি চিন্তাও করতে পারিনি। দ্বিতীয়ত, কারিগরি ও প্রযুক্তির উন্নতির কারণে মানুষের ক্ষমতা অসম্ভব বেড়েছে। বাংলাদেশের নিরক্ষর মানুষটিও যেভাবে একটি মুঠোফোনের মাধ্যমে ব্যবসায়িক লেনদেন করতে পারেন, অনেক দেশে এখনো তা অকল্পনীয়। বিল গেটসের মতো মানুষও বাংলাদেশের উন্নয়নে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তবে এ অগ্রগতি নিয়ে আত্মতুষ্টিতে থাকার সুযোগ নেই; টেকসই উন্নয়নের জন্য সুশাসনের ঘাটতি দূর করতে হবে, বৈষম্য কমাতে হবে এবং সুদৃঢ় করতে হবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে।... যদিও সব ক্ষেত্রে সমানভাবে এগোতে পারিনি; কোনো কোনো ক্ষেত্রে পিছিয়েও গিয়েছি। শাসনের ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে গিয়েছি, গণতন্ত্রের ক্ষেত্রেও। সুশাসনের অভাব আছে। বাংলাদেশে বৈষম্য কমেনি; বরং বেড়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যে গড় বৈষম্য ছিল, সেটি বিশ্বের ৩০ শতাংশ দেশে। আর এখন সেটি ৭০ শতাংশে পৌঁছেছে। এভাবে বৈষম্য বাড়তে থাকলে সামাজিক দুর্যোগ দেখা দিতে পারে। এতে আমি শঙ্কিত।’ বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা সম্বন্ধে তিনি তার ‘আমার অবাক বাংলাদেশ : বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ বইয়ের নাম প্রবন্ধটি শুরু করেছেন বঙ্গবন্ধুর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন যে, ‘বাংলাদেশের ফৌজদারি মামলা মিথ্যা দিয়ে শুরু হয়, মিথ্যা দিয়ে শেষ হয়। এর সবই মিথ্যা।’ আকবর আলি খানের বিবেচনায় ‘বাংলাদেশের বিচার বিভাগের প্রধান দুর্বলতা হলো, এখানে মিথ্যাকে বের করার কোনো উপায় নেই। ... আমার এই প্রবন্ধ পড়ে উচ্চ আদালতের একজন মহামান্য বিচারক আমার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করতে এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি সত্যি লিখেছেন। আমরা লোকজনকে মৃত্যুদন্ডের শাস্তি দিই, কিন্তু কে অপরাধী আর কে অপরাধী নয়, সেটা নির্ণয় করার ক্ষমতা আমাদের নেই। শুধু আইনের ভিত্তিতে এগুলোর আদেশ দেওয়া হয়।’

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআর-এর সাবেক চেয়ারম্যান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর