বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

বিষয় পোশাক

তসলিমা নাসরিন

বিষয় পোশাক

১. আমি সত্তরের দশকেই প্যান্ট-শার্ট পরতাম। স্কার্ট টপ পরতাম। লোকে মুগ্ধ চোখে দেখতো আর বলতো, কী স্মার্ট রে বাবা। আশির দশকে জিন্স পরতাম, টি শার্ট পরতাম। বড় সানগ্লাস পরতাম। কাঁধে ইয়াশিকা ক্যামেরা নিয়ে রাস্তায় হাঁটতাম। ফটো তুলতাম। সালোয়ার কামিজ পরলে ওড়না পরতাম না। চুল বয়কাট রাখতাম। লোকে দেখতো আর বলতো, বাঃ বিরাট স্মার্ট তো। নব্বইর দশকের শুরুতে যখন ইচ্ছে শাড়ি, যখন ইচ্ছে স্কার্ট, জিন্স, প্যান্ট, টপ, শার্ট, টি-শার্ট। লোকে বলতো, বেশ স্মার্ট তো। আর এখন ২০২২ সাল। জিন্স আর টি-শার্ট পরলে লোকের মার খেতে হয়। মারের আসল কারণটা হলো ‘জিন্স টি-শার্ট ছেলেদের পোশাক, তুই ছেলেদের পোশাক পরলি কেন, তোর ওড়না কোথায়? তুই হিজাব পরলি না কেন? বোরখাই বা কেন পরলি না? মুসলমানের মেয়ে মুসলমানের পোশাক পরবি।’

আসলে একটা বদ হাওয়া বয়ে গেছে গত দুই দশকে। এই বদ হাওয়া ধর্মান্ধ নারীবিদ্বেষী দেশের সংস্কৃতি হিজাব আর বোরখাকে নিয়ে এসেছে বাংলাদেশে। বদ হাওয়াটা মানুষের মস্তিষ্ককেও বদ করে দিয়েছে। শুধু জিন্স টি-শার্ট পরে প্রতিবাদ করলে খুব বেশি লাভ হবে না। বদ হাওয়াটাকে দূর করতে হবে।

২. একবার আমি বলেছিলাম, ‘পুরুষের লুঙ্গিটাকে আমার খুব অশ্লীল পোশাক বলে মনে হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে যে পুরুষেরা লুঙ্গি পরে, তাদের বেশির ভাগই কোনও আন্ডারওয়্যার পরে না, লুঙ্গিটাকে অহেতুক খোলে আবার গিঁট দিয়ে বাঁধে। কখনও আবার গিঁট ঢিলে হয়ে হাঁটুর কাছে বা গোড়ালির কাছে চলে যায় লুঙ্গি। তা ছাড়া লুঙ্গি পরার পরই শুরু হয় তাদের অঙ্গ চুলকোনো। ডানে বামে পেছনে সামনে এত কেন চুলকোয় কে জানে। সামনে মানুষ থাকলেও তারা অঙ্গ চুলকোনো বন্ধ করে না, না চুলকোলেও ওগুলো ধরে রাখার, বা ক্ষণে ক্ষণে ওগুলো আছে কি না পরখ করে দেখার অভ্যেস কিছুতেই ত্যাগ করতে পারে না। পরখ করার ফ্রিকোয়েন্সিটা অবশ্য মেয়েদের দেখলে বেশ বেড়ে যায়।’

আমার মন্তব্য শুনে পুরুষেরা রীতিমত রেগে আগুন। হেন কুকথা নেই যে আমাকে বলতে বাকি রেখেছেন তাঁরা। কেউ কেউ বলেছেন, ‘প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি পুরুষের পোশাক লুঙ্গি’। তাদের কোনও ধারণা নেই যে, বাঙালি পুরুষের নির্দিষ্ট কোনও পোশাক নেই। পোশাকের বিবর্তন প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। প্রাচীনকালে বাংলার পুরুষেরা গাছের বাঁকল পরতো। পরে কার্পাস তুলোর সুতোয় বানানো সেলাইবিহীন ল্যাংগোট পরতো। আরও পরে এসেছে ধুতি, তখন খাটো ধুতি পরতো। লুঙ্গি তো এই সেদিনকার।

কোনও কোনও বিজ্ঞ বলছেন, ‘পোশাক ব্যাপার নয়, প্যান্ট পাজামা পরেও পুরুষেরা অশ্লীল আচরণ করতে পারে, সমস্যা মানসিকতায়, পোশাকে নয়।’ আমার যেন জানতে বাকি রয়েছে প্যান্ট-পরা পুরুষদের অশ্লীলতা সম্পর্কে, তাঁদের নারীবিদ্বেষী মানসিকতার ব্যাপারে! খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, এক ভিড়ের বাসে এক ভদ্রলোক প্যান্টের জিপার খুলে তাঁর সবেধন নীলমণিটি বের করে এক মেয়ের দিকে তাকিয়ে মাস্টারবেট করলেন, বীর্যবান পুরুষটির রসকষ ছিটকে পড়েছিল বাসে-বসা অনেকের গায়ে। পুরুষের ‘মানসিকতা’ নিয়ে মেয়েদের জ্ঞান দেওয়ার জন্য অন্তত পুরুষের দরকার নেই-তা সেই পুরুষেরা জানেন না, যাঁরা আগ বাড়িয়ে জ্ঞান দান করেন।

ছোটবেলা থেকেই মেয়েরা, বিশেষ করে বাংলায় যাদের জন্ম, দেখেছে হাটে মাঠে ঘাটে কীভাবে অচেনা ছেলেরা লুঙ্গি উঠিয়ে তাদের মূল্যবান ধনসম্পদ দেখিয়ে ফ্যাক ফ্যাক করে সশব্দে হাসে, এবং এই ভেবে তৃপ্তি পায় যে মেয়েদের বেশ অপমান করা গেল। মেয়েরা বড় হয়েও দেখে, লুঙ্গি পরা অনেক লোকই তাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বার বার যৌনাঙ্গ স্পর্শ করেন। এটি দেখে মেয়েরা যে অস্বস্তিতে ভোগে, তা তাঁরা একেবারেই জানেন না, মনে হয় না। লুঙ্গি পরলেও আন্ডারওয়্যার পরা উচিত বলে আমি মনে করি। তা না হলে পুরুষের ধনসম্পদগুলো বড় অরক্ষিত অবস্থায় থাকে। লুঙ্গিকে আমি পোশাক হিসেবে পছন্দ না করলেও আমি কিন্তু বলিনি লুঙ্গিকে আইন করে নিষিদ্ধ করা হোক। এমনিতে এটি একদিন বিলুপ্ত হবে, শাড়ি যেমন ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হচ্ছে।

৩. মেয়েদের বোরখা পরার অর্থ হলো, মেয়েরা লোভের জিনিস, ভোগের বস্তু, মেয়েদের শরীরের কোনও অংশ পুরুষের চোখে পড়লে পুরুষের যৌনকামনা আগুনের মতো দাউ দাউ করে জ্বলে, লোভ লালসার বন্যা নামে, ধর্ষণ না করে ঠিক শান্তি হয় না। পুরুষদের এই যৌন সমস্যার কারণে মেয়েদের আপাদমস্তক ঢেকে রাখতে হবে।

যদি ঢেকে রাখতেই হয়, তবে বুঝতে হবে পুরুষেরা সব অসভ্য, সব বদ, সব যৌন হেনস্থাকারী, ধর্ষক; তারা নিজেদের যৌন ইচ্ছেকে দমন করতে জানে না, জানে না বলেই আপাদমস্তক ঢেকে রাখার দায়িত্ব মেয়েদের নিতে হয়।

আর কিছু মেয়ে যে কিছুদিন আগে ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ লেখা টি-শার্ট পরে রাস্তায় ঘুরে বেড়ালো, ট্রেনে বাসে চড়লো, এর মানে কী? এর মানে হলো, ওই মেয়েদের এলাকার পুরুষেরা গা ঘেঁষে দাঁড়ায়, যৌন হেনস্থা করে, তারা ধর্ষক বা হবু-ধর্ষক। চলাফেরার সময় সেই যৌন-নির্যাতক পুরুষ থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য অমন টি-শার্ট পরে বেরোতে বাধ্য হয় মেয়েরা।

মেয়েদের বোরখা পরা আর ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ লেখা টি-শার্ট পরা-দুটোই পুরুষের জন্য চরম লজ্জাজনক আর অপমানজনক। পুরুষেরা ভালো হয়ে যাওয়ার শপথ করুক, সত্যি সত্যি ভালো হয়ে যাক, তাহলেই মেয়েদের শরীরে বাড়তি পোশাক বা হিজাব-বোরখা চাপানোর প্রয়োজন পড়বে না, টি-শার্টে লিখতে হবে না ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’!

এতে পুরুষেরাও লজ্জার হাত থেকে বাঁচবে, মেয়েরাও নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচবে।

৪. মনে আছে ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘অল্প কাপড় যে মেয়েরা পরে, তাদের দেখে পুরুষলোক, যদি তারা রোবট না হয়, উত্তেজিত

হবেই।’

কিন্তু ইমরান খান তো বেশি কাপড় যে মেয়ে পরে, নিকাবসহ বোরখা যে মেয়ে পরে, সেই বুশরা বিবিকে দেখে এমন উত্তেজিত হয়েছিলেন যে, বিয়ে পর্যন্ত করে ফেলেছেন।

মেয়েরা ছোট পোশাক পরলে যারা উত্তেজিত হয়, ইমরান খান বলছেন, ‘তারা পুরুষ, তারা রোবট নয়।’ তাহলে তো মেয়েরা বড় পোশাক পরলে যারা উত্তেজিত হয়, তারা রোবট, তারা পুরুষ নয়!

ইমরান খান কি তবে রোবট?

এই প্রশ্নটি মজার।

কিন্তু পুরো ব্যাপারটা মজার নয়। ইমরান খান, একদার প্লেবয়, ধর্ষণ আর যৌন হেনস্থার জন্য ধর্ষক বা হেনস্থাকারী পুরুষদের দোষ না দিয়ে আবারও মেয়েদের পোশাককে দোষ দিচ্ছেন।

এই ভুল কি তিনি জেনেবুঝে করেছেন? নাকি তিনি মানুষটাই শুরু থেকে নারীবিদ্বেষীই ছিলেন!

৫. মেয়েরা যেন ছোট পোশাক না পরে, এই উপদেশ দিতে কিছু অশিক্ষিত অসভ্য লোক তাদের অশ্লীল ব্যানার নিয়ে ঢাকার পথে নেমেছিল। তার প্রতিবাদে একটি মেয়ে ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরে প্রতিবাদ করেছে, বলেছে তার নানি দাদিকে সে ব্লাউজ ছাড়াই শাড়ি পরতে দেখেছে, কেউ কেউ মেয়েটির পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের এক টাকার নোট দেখিয়েছে, যে নোটে ব্লাউজবিহীন একটি গ্রামের মেয়ের ছবি ছাপানো। অথচ শহরের একটি মেয়েকে ব্লাউজ ছাড়া হাঁটতে দেখে অভুক্ত পুরুষের চোখ দিয়ে লালা ঝরেছে, অভুক্ত মেয়েদের চোখ দিয়ে হিংসে ঝরেছে।

আমি ওই ব্লাউজবিহীন শাড়ি পরা সাহসী মেয়েটিকে স্যালুট দিচ্ছি। নষ্ট সমাজকে বদলানোর জন্য সাহসী মানুষের প্রয়োজন। অশিক্ষিত অসভ্য নিকৃষ্ট নরাধমদের চোখে জ্বালা ধরানোর জন্য, কানে তালা লাগানোর জন্য, নাকে ঝাঁঝালো গন্ধ দেওয়ার জন্য, মুখের রা বন্ধ হওয়ার জন্য, উত্থানরহিত করার জন্য কিছু করা দরকার সব সময়। না হলে ওদের নিঃশ্বাসে কলুষিত হবে আকাশ বাতাস। সমাজ পচে যাবে, মানুষের মৃত্যু হবে।

বাঙালির পোশাক আদিকাল থেকেই স্বল্প। ব্লাউজ জিনিসটা একেবারেই নতুন, ব্রিটিশ-আমলে শুরু। যত কম পোশাক পরবে নারী-পুরুষ, ততই বাঙালিত্ব বাঁচবে। যখন নোংরা ধর্মযুদ্ধ চলছে, ধনীরা ঠকাচ্ছে গরিবদের, যখন লোভ লালসা হিংসে দ্বেষে অন্যায় অবিচারে পৃথিবী দুর্গন্ধময় হয়ে উঠছে, ক্রমশ মেকি হয়ে পড়ছে, তখন কিছু অশিক্ষিত লোক মেতে আছে মেয়েদের কাপড় চোপড় নিয়ে, আসলে মরিয়া হয়ে উঠছে মেয়েদের বোরখা পরিয়ে নিজেদের ধর্মীয় রাজনীতির স্বার্থ উদ্ধার করতে। এদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস আজ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। এই অসভ্যদের নিশ্চিহ্ন করতে হলে ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরা ওই ঢাকার মেয়েটির মতো লক্ষ কোটি সাহসী মেয়ে দরকার, লক্ষ কোটি শিক্ষিত সভ্য ছেলে দরকার।

 

                লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর