বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

এগুলো নাটক নাকি ভাঁড়ামি!

সাইফুর রহমান

এগুলো নাটক নাকি ভাঁড়ামি!

এবার ঈদুল আজহার আগে-পরে বেশ কয়েকটা দিন অসুস্থ হয়ে চোরাবালিতে আটকে থাকা কোনো প্রাণীর মতো পড়ে রইলাম বিছানায়। অসুখ তেমন কিছুই না, একটু জ্বরসর্দি। আমার চলাফেরার গন্ডিও বেশ সীমিত। চেম্বার, শাহবাগ আজিজ মার্কেটের গুটিকয় বইয়ের দোকান, বিশেষ করে প্রথমা, তক্ষশীলা ও বিজুদার পাঠক সমাবেশ। অসুস্থতার কারণেই এবার হাতে অখন্ড অবসর। বই, পত্রিকা, ম্যাগাজিন আর কতক্ষণ পড়া যায়। চেতনার নিবীর্যকরণ ঠেকাতেই মাঝেমধ্যে টেলিভিশন দেখার চেষ্টা করছিলাম। বিশেষ করে ঈদের নাটক। নানা ব্যস্ততায় টেলিভিশনের নাটক আজকাল আমার দেখা হয় না বললেই চলে। ব্যতিক্রম শুধু টকশো ও খবর। যে-কোনো একটি নাটকের কিছু অংশ দেখতে গিয়ে মনে হলো, হায় খোদা! নাটক নামে আমরা আসলে এগুলো কী দেখছি? শরীরে রংচঙে জামাকাপড় ও লুঙ্গি-গামছা চড়িয়ে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় ভাঁড়ামিপূর্ণ কিছু বুলি আওড়ানো ও উদ্ভট আচরণের নামই কি নাটক? কেউ হয়তো বলবেন, কেন? আপনি এগুলো আগে কখনো দেখেননি? বেশ কিছুকাল ধরেই তো চলছে এসব। আমি বলব আলবৎ দেখেছি। রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে এক চ্যানেল থেকে অন্য চ্যানেলে ক্যাঙ্গারু জন্তটির মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলার পথে ভাঁড়ামিপূর্ণ নাটকগুলোর গরম ছ্যাঁকা শরীরের চামড়ায় অনুভূত হতো হালকা করে। এবার ঈদের ছুটির অফুরন্ত অবসরে নাটকগুলো সম্পূর্ণভাবে দেখার চেষ্টা করায় সেগুলোর অসামঞ্জস্যপূর্ণ উষ্ণতা ও উত্তাপ কুন্ডলী পাকিয়ে এবার আঘাত করল একেবারে হৃদয়ে। সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে পড়ল বিখ্যাত ও কালজয়ী সুইডিশ চলচ্চিত্র পরিচালক বার্গম্যানের কথা। একালের শিল্পভাবনা অথবা শিল্প আন্দোলনের অন্তঃসারশূন্যতার কথা বলতে গিয়ে তিনি ব্যবহার করেছিলেন একটি সাপের খোলসের উপমা। এটি এমন একটি সাপের খোলস, যাকে ঘিরে আছে হাজার হাজার পিঁপড়া। সাপটি বহুকাল আগে মৃত, ভিতরের সব কিছু নিঃশেষিত। এখন সাপের বদলে হেঁটে চলেছে শুধু তার শুকনো খোলস, ব্যস্ততার জীবন নিয়ে। আমারও মনে হয় বর্তমানে আমাদের নাটক ও চলচ্চিত্রগুলোও মৃত সাপের খোলসের চেয়েও নিকৃষ্ট ও অধঃপতিত।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, দর্শকদের জন্য প্রদর্শিত যে-কোনো একটি নাটকের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য শুধু বিনোদন হতে পারে না। যদি শুধু সেটাই হয় তবে সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, সৃজন ও সৃষ্টিশীলতা একটুও এগোবে না। নাটকের উদ্দেশ্য যদি হয় শুধু বিনোদন তাহলে আর নাটক দেখে লাভ কী! তাহলে তো বানরের নাচ দেখাই ভালো। অথবা আফ্রিকান জংলিনাচ। কিংবা সার্কাসের বাঘ-ভল্লুকের খেলা, তাদের কর্মকান্ডগুলো বোধ করি আরও বেশি আনন্দ দিতে সক্ষম। টেলিভিশনের যে-কোনো চ্যানেলে হাতে গোনা দু-একটি নাটক বাদ দিলে সবই যেন আবর্জনার স্তূপ। আমি প্রায়ই একটা বিষয় চিন্তা করি, যেসব নির্মাতা প্রযোজক ও পরিচালক এসব নাটক তৈরি করেন জীবনে কি তারা ভালো কিছু দেখেননি! বিশেষ করে পৃথিবীর কিছু সাড়া জাগানো পরিচালকের চলচ্চিত্র যেমন স্ট্যানলি কুবরিক, বার্গম্যান, লুই বুনুয়েল, রবার্ট জেমিক্স, স্পিলবার্গ, রোমান পোলানস্কি, উডি অ্যালেন প্রমুখের চলচ্চিত্র? আমি জানি এসব চলচ্চিত্র পরিচালক কালজয়ী খ্যাতি পেয়েছেন। কেউ চাইলেই হয়তো এক-দুই দিনে তাঁদের মতো হতে পারবেন না। কিন্তু চেষ্টা করতে দোষ কী! আজ শুরু করলে একদিন হয়তো কেউ না কেউ তাঁদের জায়গায় পৌঁছতে পারবেন। কেউ হয়তো বলতে পারেন, ওসব প্রতীচ্যের সংস্কৃতির ধারা এখানে চলবে কেন? ভালো কথা, আমি আমার হার স্বীকার করে নিচ্ছি; কিন্তু আমাদের দেশে এমন কি কেউ নেই যে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, ঋতুপর্ণ ঘোষ কিংবা অপর্ণা সেনদের মতো কিছু একটা তৈরি করতে পারেন? গৌতম ঘোষের অন্তর্জলী যাত্রা কিংবা পদ্মা নদীর মাঝি, ঋতুপর্ণ ঘোষের হীরার আংটি, অন্তরমহল, অপর্ণা সেনের গয়নার বাক্স কী অসাধারণ মর্মভেদী ও হৃদয়স্পর্শী। ঠিক সেভাবে আমাদের দেশি সংস্কৃতির আবহ ও পরিমন্ডলে কি এ ধরনের কিছু তৈরি করা যায় না? আমাদের নাটকগুলো দেখে খুব অবাক হতে হয়। ভালো কোনো গল্প নেই, চিত্রনাট্য নেই, নির্দেশনা নেই। যা জীবনবোধ কিংবা মানুষের সম্পর্কের জটিলতম বিষয়গুলোকে স্পর্শ করে কিংবা জীবনে নিরবচ্ছিন্ন সুখ বলে যে কিছু নেই সেই সঙ্গে ভালোবাসার বহুমাত্রিক টানাপোড়েনের সূক্ষ্ম বিষয়গুলো অণুবীক্ষণ যন্ত্রের ভিতর দিয়ে আমাদের দেখাতে পারে। আজ পর্যন্ত কোনো নাটকে সঠিকভাবে দৃশ্যমান হলো না স্যাটায়ার (ব্যঙ্গবিদ্ধ), ম্যাটাফর (রুপালঙ্কার), এলিগরি (রূপক বর্ণনা) বিষয়গুলোর সার্থক প্রয়োগ। বেশির ভাগ নাটকই বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষামিশ্রিত কিছু জগাখিচুড়ি সংলাপ, সেই সঙ্গে কলাকুশলীদের উদ্ভট সব আচরণ। যত দূর মনে পড়ে একটি নাটকে এমন একটি সংলাপ শুনলাম, ‘আইজ্জ্যা কী খাইতিরে’। যদিও আমার জন্ম বাংলাদেশে এবং আমার যৎসামান্য ভাষাজ্ঞানও রয়েছে বলে মনে করি, তবু আমার বোধগম্য হলো না এটি আসলে কোন অঞ্চলের ভাষা। প্রতিটি অঞ্চলের ভাষাকে আরও অধিকতর বিকৃত করে দেখানো হচ্ছে, বাংলা ভাষায় প্রমিত রূপ বলে একটি বিষয় আছে, দিনে দিনে মনে হয় যেন সেটি হারিয়ে গিয়ে ক্রমেই বাংলা ভাষা একটি হযবরল রূপ ধারণ করছে। সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হচ্ছে একই পরিবারের পাঁচ সদস্য ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলে। এক ভাই বরিশালের ভাষা তো অন্য ভাই নোয়াখালীর। আবার দেখা যায় বাবা, মা কথা বলছেন অন্য কোনো অঞ্চলের ভাষায়। এর চেয়ে হাস্যকর বিষয় আর কী হতে পারে। বেশ কিছুদিন আগে এক পন্ডিতকে বলতে শুনলাম ভাষা হচ্ছে নদীর মতো। এটি বিকৃত হবেই। তাঁর কাছে বিনীতভাবে আমার জানতে ইচ্ছা করে, তাঁর জগৎটি কি শুধুই বাংলাদেশ? নাকি তিনি পৃথিবীর অন্যান্য ভাষা নিয়ে গবেষণা করেছেন। আমার একবার কানাডার মনট্রিয়ালে যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল। মনট্রিয়ালের লোকজন ফরাসি ভাষায় কথা বলে। আমার সঙ্গে ছিল আমার এক ফরাসিভাষী বন্ধু। আমি নিজেও কিছুদিন ফরাসি শেখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। যা-ই হোক, মনট্রিয়াল অঞ্চলটিতে ভ্রমণকালে তাদের মুখে ফরাসি ভাষাটি শুনে আমার মনের মধ্যে কেমন যেন একটু খটকা লাগল। আমি বন্ধুকে শুধালাম, আচ্ছা আমি তো বেশ কবার প্যারিস ভ্রমণ করেছি কিন্তু সেখানকার ফরাসি আর মনট্রিয়ালের ফরাসির মধ্যে কোথায় যেন বেশ পার্থক্য লক্ষ্য করছি। বন্ধুটি বলল, তুমি ঠিকই ধরেছ। ফরাসি ভাষাটির জন্ম ফ্রান্সে হলেও মনট্রিয়ালের লোকজনই আমাদের শেখাচ্ছেন ভাষাটিকে আরও কী করে সুন্দর ও মাধুর্যময় করে বলা যায়। ঠিক তেমনি আমার এক ইংরেজ বন্ধু আমাকে বলেছিলেন, তোমাদের সালমান রুশদি আমাদের ইংরেজ ভাষাভাষীদের শেখাচ্ছেন ইংরেজি ভাষাটিকে কত সুন্দর ও শৈল্পিকভাবে লেখা যায়। সত্যি আশ্চর্যের বিষয় বইকি! সেজন্যই বলছি, পৃথিবীজুড়ে যেখানে ভাষার উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধির চেষ্টা চলছে, সেখানে আমাদের দেশে আধুনিকতা ও গল্পের আঙ্গিক খোঁজার নামে চলছে বাংলা ভাষার ওপর কিছু মানুষের নির্বিচার বলাৎকার। আমি নিশ্চিত, সুদূর কোনো ভবিষ্যতে ভাষার বিকৃতির দায়ে যখন কাউকে অভিযুক্ত করা হবে তখন সর্বাগ্রে যাদের নাম আগে আসবে তারা হলেন বর্তমান নাটকগুলোর প্রযোজক, পরিচালক ও অন্যান্য কুশীলব। আর সেই সঙ্গে যাদের মুখ দিয়ে নির্গত হয় ‘আমার এত আবেগ ক্যারে’র মতো অন্তঃসারশূন্য সংলাপ, তারাও নিশ্চয়ই বাদ যাবেন না এ অভিযোগ থেকে। যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ইংরেজি চলচ্চিত্র দেখার পাশাপাশি ফরাসি, স্প্যানিশ ও জার্মান চলচ্চিত্রের প্রতিও বেশ অনুরক্ত হয়ে উঠেছিলাম। তারই সূত্র ধরে কি না বলতে পারব না, আমার কিছু জার্মান ও ফরাসি বন্ধু জুটে গিয়েছিল। তাদের সঙ্গে সেই বন্ধুত্ব অদ্যাবধি অটুট আছে। তারা একদিন আবদার করল, বাংলাদেশি চলচ্চিত্র দেখবে। আমি সকৌতুকে বললাম, এখানকার সিনেমা হলগুলো তো আর বাংলা ছায়াছবি দেখায় না। তবে তারা চাইলে ভারতীয় হিন্দি ছবি দেখতে পারে। তারা তাতেই রাজি। একদিন চার-পাঁচ জন সদলবলে বেশ আয়োজন করে একটি হিন্দি চলচ্চিত্র দেখা হলো। চলচ্চিত্রটির নাম যত দূর মনে পড়ে ‘কাভি খুশি কাভি গম’। ছবিটি দেখার পর তাদের অভিব্যক্তি জানতে চাইলাম। আমার জার্মান বন্ধুটি রাশভারি চেহারায় বলল, আচ্ছা তোমার কি মনে হয় না এসব চলচ্চিত্র দেখিয়ে তোমাদের একটি ইলিউশনের মধ্যে রেখেছে। অর্থাৎ একটি স্বপ্নের মধ্যে বসবাস করার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে তোমাদের এ চলচ্চিত্রগুলো। ফরাসি বন্ধুটি বলল, তোমাদের এ চলচ্চিত্রে বাস্তবতা কোথায়? সবকিছুই তো অতিরঞ্জিত করে দেখানো হচ্ছে, যা কৃত্রিম ও আনরিয়ালিস্টিক (অবাস্তব)। আর এ যুগে এত লম্বা লম্বা গানেরই বা প্রয়োজন কী। সেই অর্থে তোমাদের চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা না থাকলেও নায়ক-নায়িকাদের আচরণ ও ভঙ্গিমায় প্রচুর অশ্লীলতা বিদ্যমান, যা কুরুচিপূর্ণ ও দৃষ্টিকটু। পাশ্চাত্যের চলচ্চিত্রে বাস্তববিবর্জিত বিষয় যে নেই তা নয়। কিন্তু পাশ্চাত্যের ছবিগুলোয় অবাস্তব কিছু দেখানো হলে বেশির ভাগ সময়ই এর কারণগুলো বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে দেওয়া হয়। চলচ্চিত্রে নাচ-গানের ইতিহাস সম্পর্কে আমার কিছুটা জানাশোনা আছে সে আলোকে বলতে গেলে বলতে হয়, যদিও মেলোড্রামা মঞ্চস্থ হয়ে আসছে সেই প্রাচীন গ্রিক যুগ অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ অব্দ থেকেই; কিন্তু সেটি আমাদের সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়েছে মূলত ইংরেজি নাটক থেকে। ১৮৪০ সালের দিকে লন্ডনে যেসব নাটক মঞ্চস্থ হতো সেসব নাটকে প্রচুর সংগীতের সংযোগ ঘটানো হতো। এ প্রথা শুরু হয়েছিল মূলত দুটি কারণে। প্রথম কারণটি, লাইসেন্সিং প্রথার একটি বাধা দূর করার জন্যই সাধারণত এ ধরনের নাচ-গান ও সংগীতের আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল। কারণ ওই সময়ের ব্রিটিশ আইন অনুযায়ী লন্ডনের ‘ডুরি লেইন’ এবং ‘কভেন গার্ডেনের’ থিয়েটারগুলো ছাড়া অন্য কোথাও যথার্থ লেজিটিমেট নাটক মঞ্চস্থ করার আইন ও অনুমতি ছিল না। শুধু তাদেরই ছিল নাটক মঞ্চস্থ করার একচেটিয়া অধিকার। তবে অন্যত্র বিনোদনমূলক সংগীতানুষ্ঠান করার কোনো বাধা ছিল না। এ কারণে তখন গানবাজনাপূর্ণ নাটক তথা মেলোড্রামার প্রচলন শুরু হয়ে গেল। দ্বিতীয় কারণটি হলো বিভিন্ন দৃশ্যে আবেগময় আবেদন তীব্র থেকে তীব্রতর করার জন্য নাটকে গানের ব্যবহার। উনিশ শতকের শুরুতে অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে আমাদের নাটক-চলচ্চিত্রে অনিবার্যভাবেই সেই ব্রিটিশ প্রথা ঢুকে পড়ে। পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিতে নাটক-চলচ্চিত্রে নাচ-গান বর্তমানে প্রায় উঠে গেছে। কিন্তু আমরা সেই জগৎ থেকে আজও বের হয়ে আসতে পারিনি। সোপ অপেরা সম্পর্কে দু-চার কথা না বললে এ লেখাটি হয়তো অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। আজকাল সোপ অপেরা নামক নাটকগুলো ভারতীয় চ্যানেলগুলোর আগ্রাসনের কারণে ঢুকে পড়েছে একেবারে আমাদের অন্দরমহলে। আমাদের চাচি ও মা-খালারা ঘরকন্নার কাজ কোনোমতে রাত ৮টা-৯টার মধ্যে শেষ করে বাড়ির ঝি ও আয়া-বুয়াদের সঙ্গে নিয়ে কেউ সোফায়, কেউ মাদুর-পাটি বিছিয়ে আত্মনিমগ্ন হয়ে যান সেই সোপ অপেরার জগতে। সোপ অপেরার জন্ম হয়েছিল রেডিও আবিষ্কারের অব্যবহিত পরই। ১৯০০ সালে রেডিও আবিষ্কার করেন দুজন মনীষী- ইতালিয়ান বিজ্ঞানী মার্কনি ও জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল ফার্দিনান্দ ব্রাউন। কোনো এক অদৃশ্য কারণে বাংলাদেশের মানুষ রেডিও আবিষ্কারক হিসেবে শুধু মার্কনিকেই চেনেন। যা-ই হোক, রেডিও আবিষ্কারের সঙ্গে যদিও অনেকেই জড়িত ছিলেন কিন্তু ১৯০৯ সালে রেডিও আবিষ্কারের জন্য যুগপৎভাবে নোবেল পান মার্কনি ও ব্রাউন। এ রেডিও আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে এটিকে কীভাবে জনপ্রিয় করা যায় সে চেষ্টাই চলতে থাকে নিরন্তর। ১৯৩০ সালের দিকে দেখা যায়, দুপুরের পর রেডিওতে যেসব নাটক প্রচারিত হয় সেসব নাটকের প্রধান শ্রোতা মহিলারা। তারা সারা দিন রান্নাবান্না, কাপড়-চোপড় ধোয়ামোছা ও ঘরের অন্যান্য কাজকর্ম সেরে ছেলেপুলেদের ঘুম পাড়িয়ে যে-যার মতো মগ্ন হয়ে যান রেডিওতে প্রচারিত নাটক শুনতে। এ বিষয়টি টের পেয়ে বিভিন্ন সোপ অর্থাৎ সাবান কোম্পানিগুলো এগিয়ে আসে সেসব নাটকের পৃষ্ঠপোষকতায়। এজন্য এসব নাটককে বলা হতো ‘সোপ অপেরা’। ১৯৩০ সালে আমেরিকার শিকাগোয় প্রথম সোপ অপেরা চালু হয়। এরপর নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, লন্ডনসহ পৃথিবীর সর্বত্র জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এ-জাতীয় সোপ অপেরাগুলো।

স্কুল-কলেজে পড়ার সময় দেখতাম আমাদের মা-খালা, প্রতিবেশীসহ প্রায় সবারই বই পড়ার একটি অভ্যাস ছিল। তখনো আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে ঘরে ঘরে সোপ অপেরার দৌরাত্ম্য শুরু হয়নি। আমার মা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করেননি। কিন্তু ছোটবেলায় তাঁকেও দেখেছি গল্প-উপন্যাস পড়ে নীরবে-নিভৃতে অশ্রু বিসর্জন করতে। পক্ষান্তরে আমার বাবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ-এমএ পাস করা সত্ত্বেও তাঁকে কখনো নভেল পড়তে দেখেছি কি না মনে পড়ে না। আর পাশের বাড়ির খালাম্মারা প্রায়ই আমার কাছে বই ধার চাইতেন নিদারুণ ও সকাতর দৃষ্টিতে। তাঁরা প্রায় সবাই ওই সময় নীহাররঞ্জন গুপ্ত, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, নিমাই ভট্টাচার্য প্রমুখ লেখকের বই পড়তেন গ্রোগাসে। আমাদের নাটক শুরুর ইতিহাসও বেশ গৌরবোজ্জ্বল। বাংলায় প্রথম নাটক মঞ্চায়িত হয় ১৮৫৭ সালের মার্চে। কলকাতার জয়রাম বসাকের বাড়িতে। ইতিহাসে এটিই প্রথম বাংলা নাটক। আর নাটকটি লিখেছিলেন রামনারায়ণ তর্করত্ন। সে যুগে নাটক লিখতেন রামনারায়ণ তর্করত্ন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বিখ্যাত সব লেখক। নাট্যকাররাও ছিলেন বিদ্বান ব্যক্তি, যেমন- শিশিরকুমার ভাদুড়ী, গিরিশ চন্দ্র ঘোষ প্রমুখ। দীনবন্ধু মিত্র, মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথ অনেক প্রসিদ্ধ ও সার্থক নাটক রচনা করেছিলেন। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ও জোড়াসাঁকোর লোকজন যখন কলকাতার কোনো থিয়েটারে নাটক দেখতে যেতেন, তখন সম্পূর্ণ থিয়েটারটি ভাড়া নেওয়া হতো। কারণ রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পরিবার-পরিজন নিম্নস্তরের লোকজনের সঙ্গে বসে নাটক দেখবেন এটি ওই সময় তাঁরা নিজেরা চিন্তাও করতে পারতেন না। যা-ই হোক, বাংলাদেশে সব মননশীল, সৃজনশীল ও সুচিন্তার মানুষের একটিই চাওয়া- ফিরে আসুক আমাদের নাটকের গৌরবোজ্জ্বল দিনগুলো। বন্ধ হোক এ অপসংস্কৃতি।

লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর