বৃহস্পতিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

স্মৃতিতে মেজর খন্দকার নুরুল আফসার

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার (অব.)

স্মৃতিতে মেজর খন্দকার নুরুল আফসার

সাবেক সেনা কর্মকর্তা, ‘রাওয়া’র চেয়ারম্যান, আফসার গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এক্সিম ব্যাংকের পরিচালক ও বিশিষ্ট সমাজসেবী মেজর খন্দকার নুরুল আফসার ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ঢাকার ইউনাইটেড হসপিটালে মৃত্যুবরণ করেন। এই সাহসী ও মানবদরদি সেনা কর্মকর্তার বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর।

খন্দকার নুরুল আফসার ১৯৫৪ সালের ১ জানুয়ারি কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার ফরদাবাদে। তিনি ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গ্র্যাজুয়েট। তরুণ আফসার চট্টগ্রামের ভাটিয়ারীতে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি (বিএমএ) থেকে তৃতীয় শর্ট সার্ভিস কমিশন (এসএসসি-৩)-এর সঙ্গে কমিশন লাভ করেন। তিনি সেকেন্ড লে. হিসেবে ২৪ ইস্ট বেঙ্গলে যোগদান করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মেজর আফসার একজন চৌকশ ও প্রতিশ্রুতিশীল অফিসার ছিলেন। মেজর পদবিতে বিএমএর প্রশিক্ষক (প্লাটুন কমান্ডার) ও ৪৪ পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজরের মতো মর্যাদাবান পদে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি চীনের নানজিং সামরিক একাডেমি থেকে ক্ষুদ্র অস্ত্রের ওপর বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। একটি দুর্ঘটনার কারণে দুঃখজনকভাবে ১৩ বছরের চাকরিতেই তাঁকে সামরিক জীবনের সমাপ্তি টানতে হয়েছিল। ১৯৯০ সালে মেজর আফসারের কর্মজীবনের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হয়। তবে প্রথম দিকে এটি ছিল অকল্পনীয় কঠিন এক জীবন সংগ্রাম। পরে ঢাকা সিটি করপোরেশনের জোন-১০-এর জোনাল এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর নেমে পড়েন নিজস্ব ব্যবসায়। প্রচ- পরিশ্রম, অধ্যবসায়, উদ্ভাবনী ক্ষমতা, সাহস, মেধা ও ব্যবস্থাপনা গুণের সমন্বয়ে নিজেকে ধীরে ধীরে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। আফসার গ্রুপ এখন একটি প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এ গ্রুপে ১০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।

চমৎকার নেতৃত্বগুণ ও সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী মেজর আফসার রাওয়ার (রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন) চেয়ারম্যান হিসেবে অসাধারণ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ ও উন্নয়ন করে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের অকৃত্রিম আন্তরিক ভালোবাসা অর্জন করেন। বিশেষত করোনাকালে রাওয়ার উদ্যোগী ভূমিকা উদাহরণ হয়েই থাকবে। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই কক্সবাজারে মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর হত্যার বিচার চেয়ে তিনি অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন। যা পরবর্তীতে এ বিচারটি সঠিকভাবে এগিয়ে নিতে অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল। এ ছাড়া ডিওএইচএস মহাখালী পরিষদের সভাপতি হিসেবে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত মেজর আফসার অবসরপ্রাপ্তদের সামরিক কমিউনিটিতে স্বাভাবিক নেতায় পরিণত হন।

ব্যক্তিজীবনে তিনি অত্যন্ত পরোপকারী, সদালাপী, বিশাল হৃদয় ও মানবিক গুণাবলির অধিকারী খুবই শ্রদ্ধাভাজন একজন সেনা অফিসার ছিলেন। আত্মীয়স্বজন, সামরিক কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবার কোনো সমস্যায় পড়লে এই মানবদরদি ব্যক্তি সর্বদাই তাদের পাশে দাঁড়িয়ে নিজের সাধ্যমতো সাহায্য -সহযোগিতা করতেন। তিনি নিঃস্বার্থ দানশীল ও পরোপকারী ছিলেন। সুযোগ পেলে গোপনে মানুষের অনেক উপকার করতেন। এর সাক্ষী হয়ে রইল বিকাশ মোবাইল ব্যাংকিং।

সামরিক জীবনের ঠিক প্রথম দিন থেকেই বিএমএতে মেজর আফসার আমাদের ১২তম লম্বর কোর্সের প্লাটুন কমান্ডার (প্রশিক্ষক) ছিলেন। দ্বিতীয় টার্মে ছিলেন সরাসরি আমাদের প্লাটুনের প্লাটুন কমান্ডার। তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান সিরিয়াস টাইপের ‘২৪ ঘণ্টার প্রশিক্ষক’। এ সময় আমাদের টার্ম কমান্ডার ছিলেন মেজর আলাউদ্দিন মোহাম্মদ আবদুল ওয়াদুদ, বীরপ্রতীক (পরে মেজর জেনারেল, বর্তমান রাওয়ার চেয়ারম্যান)। বিএমএতে প্লাটুন কমান্ডারদের বলা হয় ‘মেকারস অব লিডার্স’। মেজর ওয়াদুদ, মেজর আফসারসহ একঝাঁক তারকা প্রশিক্ষক ছিলেন আমাদের দ্রোণাচার্য। আজ এ কথা ভাবতেই গর্ব হয়। ব্যক্তিজীবনে মেজর আফসারের রয়েছেন স্ত্রী সোমা নাসরিন। দুই পুত্র- খন্দকার জুনায়েদ তামিম ও খন্দকার জুনায়েদ তাওসিন। এক কন্যা- জাসিয়া আমরিন। ৬ সেপ্টেম্বর বাদ জোহর মহাখালী ডিওএইচএস মসজিদে মেজর আফসারের জানাজা। ডিওএইচএসের তুলনায় প্রায় জনসমুদ্র। তাঁর প্রতি মানুষের ভালোবাসা দেখে অভিভূত হলাম। এরপর তাঁর লাশ আনা হলো বনানী সামরিক কবরস্থানে। মৃত্যুঞ্জয়ী পঁচিশ নামে পরিচিত ২৫ ইস্ট বেঙ্গলের একটি স্মার্ট কন্টিনজেন্ট মরণোত্তর সালাম দিল, এমন একজন সেনা কর্মকর্তাকে যিনি এসএসসি পাস করেছিলেন ময়মনসিংহের ‘মৃত্যুঞ্জয় স্কুল’ থেকে। সারা দিন ঢাকার আকাশ মেঘে ঢাকা ছিল। কিছুক্ষণ বৃষ্টি হলো। অবশেষে আমাদের সঙ্গে শোকের মিছিলে দাঁড়াল বনানীর প্রকৃতি। সবশেষে বেজে উঠল বিউগলের করুণ সুর, দ্য লাস্ট পোস্ট। এভাবেই সেনাবাহিনীর মর্যাদায় মনে-প্রাণে সৈনিক মরহুম মেজর আফসারের সামরিক ফিউনারেল বা দাফন সম্পন্ন হলো। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকাল ৩টা ১৫। ওপারে ভালো থাকুন, শান্তিতে থাকুন প্রিয় আফসার স্যার। স্যালুট টু ইউ। অভিবাদন...।

 

                লেখক : গবেষক

সর্বশেষ খবর