শুক্রবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

গণতন্ত্র ও পারস্পরিক সহনশীলতা

রণেশ মৈত্র

গণতন্ত্র ও পারস্পরিক সহনশীলতা

দেশের সংসদ নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে রাজনৈতিক দলগুলো স্বভাবতই দিন দিন সক্রিয় হতে শুরু করছে- নেমে পড়ছে রাজপথেও। নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো সম্ভাব্য সব শান্তিপূর্ণ ও আইনানুগ পন্থায় মাঠে নামবে-তাদের দাবি-দাওয়া জনগণের সামনে তুলে ধরবে এবং এভাবেই জনমতকে তাদের পক্ষে আনতে প্রয়াস পাবে।

এ অধিকার বিরোধী দলগুলোর ক্ষেত্রে অধিকতর হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ প্রচার বাহনগুলো আমাদের দেশে সচরাচর বিরোধী দলগুলোর বক্তব্য সমভাবে প্রচার করে না। শুধু সংবাদপত্রের পৃষ্ঠাগুলোতেই নয়, দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর দিকে তাকালেই আমার উপরোক্ত কথার যথার্থ মিলবে। সরকারের মন্ত্রীদের সংবাদ সম্মেলনগুলোতে বা নানা বৈঠক ও সমাবেশগুলোতে প্রদত্ত বক্তব্য টিভি চ্যানেলগুলোতে বারবার দেখানো হয় কিন্তু একটি ছাড়া বাদবাকি কোনো বিরোধী দলের কার্যকলাপই কোনো প্রচারমাধ্যমে স্থান পায় না। যে বিরোধী দল কিছুটা প্রচার পায়-তারাও সরকারি মন্ত্রীদের মতো প্রচার পায় না।

অবাক ও বিস্ময়কর কান্ড হলো- আমাদের দেশে সরকারি মালিকানায় কোনো দৈনিক পত্রিকা না থাকলেও, বিটিভি নামে গোটা তিনেক চ্যানেল রয়েছে। বেসরকারি চ্যানেলগুলো, বিস্ময়কর হলেও সত্য, বিটিভি প্রচারিত খবর একবার করে প্রতিদিন বেসরকারি চ্যানেলগুলোতে বাধ্যতামূলকভাবে প্রচার করতে হয়। গণতন্ত্র, গণতন্ত্র বলে আমাদের সরকার নানা কথা বললেও বিশ্বের কোথাও কোনো টিভি চ্যানেলে এমনটি ঘটতে দেখা যায় না। এর দ্বারা খবর প্রচারে যে অনাকাক্সিক্ষত বৈষম্যের সৃষ্টি হয়, তা-ও যেন সরকারের বা তার প্রচার মন্ত্রণালয়ের চোখে পড়ে না। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো- যারাই যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, এ সুবিধাটি তারাও ব্যবহার করেন-যদিও এ সরকারি চ্যানেলটির দর্শক সরকারদলীয় লোকেরাও হন না-যেমন দলীয় পত্রিকার গ্রাহক সংশ্লিষ্ট দলের নেতা-কর্মীরাও হন না। এ নিবন্ধটি লেখার তাগিদ অনুভব করেছি-ইদানীং বিরোধীদলীয় সভা-সমাবেশে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে। সরকারদলীয় কর্মীদের হামলা- গণতন্ত্রের বিকাশ তো দূরের কথা, আইনের শাসনের যে সামান্য অংশ কায়ক্লেশে টিকে আছে তার ওপরও প্রচন্ড আঘাত হানছে। উদ্বেগটা সেখানেই।

দেশের পরিস্থিতি ও বিরোধী দল : বেশ অনেক দিন ধরে দেশের মানুষ ক্রমবর্ধমান নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের কশাঘাতে মারাত্মকভাবে জর্জরিত। নিম্ন আয়ের বা উপার্জনহীন কোটি কোটি মানুষের কথা বাদ দিলেও নির্দিষ্ট বেতনভুক মধ্যবিত্তের জীবনও আজ সম্পূর্ণ অচলাবস্থার সম্মুখীন। এক্ষেত্রে কোনো সংকট নেই, আমরা আয়ের আছি বা জ্বালানি তেলের দাম লিটারপ্রতি ৩৬ টাকা বাড়িয়ে তিন সপ্তাহ পর মাত্র ৫ টাকা কমানোর মতো সরকারি প্রহসন-জনস্বার্থের প্রতি যে চরম অবহেলা-তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।

এহেন পরিস্থিতিতে বিরোধী দলগুলোর স্বাভাবিক করণীয় কী? বর্তমান সরকারি দল যদি বিরোধী অবস্থানে থাকত তবে তারাই বা কী করত? নিশ্চয়ই যাঁরা এমন প্রহসনমূলক আচরণ জনগণের সঙ্গে করছেন-তার বিরুদ্ধে, অহরহ পণ্যমূল্যের অব্যাহত মূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে, যুক্তিহীন লোডশেডিংয়ের বিরুদ্ধে হাস্যকর প্রশিক্ষণের নামে নানা বিভাগ বা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বিদেশ পাঠানো প্রভৃতির বিরুদ্ধে প্রবল গণআন্দোলন গড়ে তোলা এবং সরকারকে বিরোধী দলগুলোর ন্যায্য দাবিগুলো মেনে নিতে বাধ্য করা বিরোধী দলগুলোর অবশ্য করণীয়। এ ঐতিহ্য ধারণ করেই বাঙালি জাতি অসংখ্য আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে।

বিরোধী দলগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে রাজপথে নেমে সভা সমাবেশ-মিছিল প্রভৃতির আয়োজন করে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের দাবি ঊর্ধ্বে তুলে ধরাসহ দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করার। সেখানে তাদের মোকাবিলা করার একমাত্র বৈধ পথ হলো পৃথক দিনে পাল্টা সমাবেশ করে জনগণকে বুঝানো। সরকারি দল সেই পথ পরিহার করে বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ-মিছিলের ওপর হামলা করলে এদেশে গণতন্ত্র কদাপি প্রতিষ্ঠিত হবে না।

কী ঘটেছে সম্প্রতি : বিগত ২৯ আগস্টের সংবাদপত্রে ‘আট জেলায় গুলি, হামলা, মামলা’ শিরোনামে বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ সংক্রান্ত খবর পরিবেশন করতে গিয়ে লিখেছে :

বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ ঘিরে অন্তত আটটি জেলায় গত রবিবার পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বিএনপির ২৫ নেতা-কর্মী গুলিবিদ্ধসহ ৩৫ জন আহত হয়েছে।

যশোর শহরে তান্ডব চালিয়েছে যুবলীগের নেতা-কর্মীরা। তারা বিএনপি অফিসও তছনছ করেছে। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায়  বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে সাতজন আহত হয়েছে। পুলিশের বাধায় ভোলার বোরহানউদ্দিন বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ ভন্ডুল হয়ে গেছে।  নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে বিএনপির ৪৯৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ।

মাগুরায় সহিংস ঘটনায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ৩৬ জনের নামে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়েছে। রাঙামাটির কাপ্তাই, ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ ও কক্সবাজারের পেকুয়ায় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ডাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন।

জ্বালানি তেলসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং ভোলায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে দুই নেতা নিহত হওয়ার প্রতিবাদে ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিভিন্ন জেলায় প্রতিদিনই বিক্ষোভ সমাবেশ করছে বিএনপি। এর আগের দুই দিনই বিভিন্ন স্থানে হামলা ও সংঘর্ষ হয়েছে। এর মধ্যে শুক্রবার কয়েকটি জেলায় বিএনপির মিছিল সমাবেশে হামলায় অন্তত ২০০ জন আহত হন। শনিবারও নয় জেলায় হামলায় আহত হয়েছে অর্ধ শতাধিক নেতা-কর্মী। এর পরদিন, অর্থাৎ ৩০ আগস্ট প্রকাশিত একই সংবাদপত্রের শেষ পৃষ্ঠায় ‘ফেনী, নোয়াখালীতে সংঘর্ষ : মাগুরা নারায়ণগঞ্জে হামলা’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরে বলা হয়- বিএনপির চলমান বিক্ষোভ সমাবেশ ঘিরে সহিংসতা অব্যাহত আছে। সোমবারও নোয়াখালী, ফেনী ও মাগুরায় হামলা ও সংঘর্ষে অর্ধ শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়েছে। আবার নারায়ণগঞ্জে বিএনপি নেতা-কর্মীদের অফিস ও ঘরবাড়িতে হামলা চালিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা।

নোয়াখালীর সেনবাগে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কর্মীদের সংঘর্ষে পুলিশসহ ৩৫ জন আহত হয়েছেন। ফেনীর সোনাগাজীতে বিএনপি কর্মীদের হামলায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ ১০ জন আহত হয়েছেন। মাগুরার শ্রীপুরে আওয়ামী লীগ কর্মীদের হামলায় বিএনপির অন্তত ১০ নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। পিরোজপুরের ইন্দুরকানিতে বিএনপির প্রতিবাদ সভা শুরুর আগেই মঞ্চ ও প্যান্ডেল ভেঙে দিয়েছে পুলিশ। চট্টগ্রামে বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও হালকা সংঘর্ষ ঘটেছে। লক্ষ্মীপুরে ক্ষমতাসীনদের বাধায় বিএনপি সমাবেশ করতে পারেনি।

জ্বালানি তেল, পরিবহন ভাড়াসহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং ভোলায় ছাত্রদল নেতা নুরে আলম ও স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা আবদুর রহিম হত্যার প্রতিবাদে ২২ আগস্ট থেকে দেশব্যাপী ধারাবাহিক কর্মসূচি শুরু করে বিএনপি। এসব কর্মসূচি ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দল ও পুলিশের বাধা, হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে। এতে বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী আহত হচ্ছেন। অনেক স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করছে প্রশাসন। এসব হামলায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী ছাড়াও পুলিশ তাদের কর্মসূচিতে বাধা দিচ্ছে, হামলা করছে, গ্রেফতার করছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।  বিএনপির দাবি, এ পর্যন্ত হামলার ঘটনা ঘটেছে শতাধিক স্থানে। এ ছাড়া, বিএনপির সমাবেশে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে ৪০টির বেশি জায়গায়। এ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে ৬০ জনের বেশি নেতা-কর্মী। আহত হয়েছেন ৭৭৫ জন। মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে হাজার হাজার কর্মীর নামে।

শুধু বিএনপি নয়, ছোট ছোট দল বা মোর্চা, যারা মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত সক্রিয় ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছিল, এমন একাধিক বাম দল কখনো এককভাবে আবার কখনোবা মোর্চাগতভাবে যখন রাজপথ মিছিল সমাবেশ করতে নামে, তখনো লজ্জা-শরম বাদ দিয়ে সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা চড়াও হতে দ্বিধাবোধ করে না। গণতান্ত্রিক বিধি-বিধান যদি কেউ না মানে- তিনি বা তাঁরা সরকারেই থাকুন বা বিরোধী দলেই থাকুন-তাঁকে কিছুতেই গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বলে অভিহিত করা যায় না।

ব্যক্তিগতভাবে বিএনপির ঘোর বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও যখন দেখি বিএনপি এবং অন্যরা গণদাবিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে রাজপথে নেমে সরকারি দল বা তাদের দলীয় বাহিনী বা পুলিশ বাহিনী কর্তৃক নিগৃহীত তখন সরকারের বা সরকারি দলের তেমন কাজকে কোনোক্রমে সমর্থন করতে পারি না। সরকারি দলের এহেন গণবিরোধী অবস্থানের নির্মম ফল তাদেরই আজ হোক বা কাল হোক ভোগ করতে হবে।

সামনে নির্বাচন। কিছুদিন আগে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বৈধ পথে আন্দোলন করতে গেলে সরকার বা সরকারি দল তার বিরোধিতা করবে না-আক্রমণ তো নয়ই। বিএনপি নেতারা তখন এই বক্তব্যে আস্থা স্থাপন করে নি-আবার সরকারি দলের কেউ প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যকে সাধুবাদ জানায়নি। সময় লাগল না, প্রমাণিত হলো যে সরকারি দল প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেরও তোয়াক্কা করে না। প্রশ্ন ওঠে, পুলিশও কি তবে তাই?

আন্দোলন করতে গিয়ে বিএনপির যে দুজন নিহত হলো তার প্রতিবাদে ধারাবাহিক সভা-সমাবেশ করার গণতান্ত্রিক অধিকার বিএনপির আছে। ওই কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হলে তাতে ন্যূনতম বাধা সৃষ্টির সামান্যতম অধিকারও সরকারের নেই।

ভুললে চলবে না-গণতন্ত্র ও সহনশীলতা একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

লেখক : সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক।

E-mail:[email protected]

সর্বশেষ খবর