শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

‘ভাটির পুরুষ’ শাহ্ আবদুল করিম

আফতাব চৌধুরী

‘ভাটির পুরুষ’ শাহ্ আবদুল করিম

বাংলা লোকসংগীতের মতো সমৃদ্ধ আর কোনো সংগীত লক্ষ্য করা যায় না। বিচিত্র নাম ও শ্রেণিকরণ লোকসংগীতে ফুটে উঠেছে। বাংলা বাউল সংগীতের কদর আলাদা। আত্মার সঙ্গে পরমাত্মা, সৃষ্টির গূঢ় রহস্য নিয়ে ভাবনা বাউল সংগীতে প্রতিফলিত হয়। শাহ্ আবদুল করিমের দর্শন হলো- মানবপ্রেমই বড় ধর্ম। সৃষ্টিকর্তাকে পেতে হলে আগে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। মানুষের মাঝেই সৃষ্টিকর্তার অবস্থান। অভাব-অনটন দুঃখ দারিদ্র্য ছিল শাহ্ আবদুল করিমের জীবনসাথী। কিন্তু কখনো নুয়ে পড়েননি তিনি। তাঁকে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, আপনার লেখা ও সুরারোপিত গান গেয়ে আজ অনেকে মস্ত বড় শিল্পী বনে গেছেন, অথচ আপনি কোনো প্রতিবাদ করছেন না। তাঁর লা জবাব- আমি বেতার শুনি না, টিভি দেখি না, আমার ভাঙা ঘরে এসব নেই, আমার গান চুরি করে কেউ যদি নামিদামি হয় তাতে আমার কী, আমি এসবের ধার ধারি না। আমি হলাম রাখাল। আধপেটা কিংবা উপোসে কেটেছে আমার জীবন। রাখালের চাকরি ছেড়ে ধলবাজারে মুদির দোকানে কাজ করেছি। দিনে চাকরি, আর রাতে হাওর-বাঁওড়ের ধারে ঘুরে ঘুরে গান গেয়েছি। দিন যায়, শাহ্ আবদুল করিম নিজের এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গান গাইতে শুরু করেন। করিম বাউলের হাঁকডাক বাড়ে। কিন্তু পকেট পুরে না। বাউল সংগীতে নয়, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। এমনকি এদেশের স্বাধিকার আন্দোলনেও করিম বাউলের গান উৎসাহ জুগিয়েছে। ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী-বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছেন শাহ্ আবদুল করিম গানের জন্য। তিনি নিজের পরিচয় উপস্থাপন করেছেন এভাবে-‘কেউ বলে শাহ্ আবদুল করিম, কেউ বলে পাগল/ যার যা ইচ্ছা তাই বলে বুঝি না আসল-নকল/বসত করি দিরাই থানায় গ্রামের নাম হয় ধল/ধল একটি প্রসিদ্ধ নাম দূরদূরান্তে আছে নাম/এই গ্রামের জয় জিলাম নাই কোনো সম্বল/গানের উস্তাদ করমুদ্দিন, ধল আশ্রমে বাড়ি/পরে সাধক রশীদ উদ্দিন, উস্তাদ মান্য করি/বাউল ফকির আমি একতারা সম্বল/সবলাকে সঙ্গে নিয়া আদি উজান ঢল।’ বাউলিয়ানার মাধ্যমে শাহ্ আবদুল করিমের নাম ছড়িয়ে পড়ে। সর্বত্র তাঁকে বাউল সম্র্রাট হিসেবে ভূষিত করা হলো। ১৯৫৬ সালে তাঁর লেখা প্রথম গ্রন্থ, ‘আফতাব সংগীত’ প্রকাশিত হয়। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘গণসংগীত’, ‘কালনীর ঢেউ’, ‘ধলমেলা’, ‘ভাটির চিঠি’, ‘কালনীর কূল’ ইত্যাদি গ্রন্থ। বাউল সম্র্রাটের জীবন গাড়ি থেমে যায় গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯। তাঁর ওপর নির্মিত হয় প্রামাণ্যচিত্র ‘ভাটির পুরুষ’। দার্শনিক আরজ, আলী মাতুব্বর, শাহ্ আবদুল করিম-এদের দুজনের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। উভয়ের মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে পরিচিতি লাভ করেছেন। তারা গ্রামে বাস করতেন, বড় কোনো ডিগ্রি নেই, সেজন্য মূল্যায়ন করা হয়নি। যাই হোক শেষতক গাড়ি ইস্টিশনে থামার আগে কিছুটা হলেও উপস্থাপিত হয়েছেন।

সর্বশেষ খবর