রবিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের বীমা খাতে ইউএমপির যুগান্তকারী প্রেক্ষাপট

সুদীপ্ত সুজন

বীমা হলো অর্থের বিনিময়ে জীবন, সম্পদ বা মালামালের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির ন্যায়সঙ্গত ও নির্দিষ্ট ঝুঁকির স্থানান্তর। এর মাধ্যমে ব্যক্তি বা বীমা প্রতিষ্ঠান অর্থের (প্রিমিয়ামের) বিনিময়ে গ্রাহকের আংশিক বা পুরোপুরি সম্ভাব্য ঝুঁকি গ্রহণ করে থাকে। এটি অনিশ্চিত ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার একটি অংশ। বাংলাদেশে ১৯৭৩ সাল থেকে বীমা কার্যক্রম শুরু হলেও বীমার অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ এখনো কাক্সিক্ষত পর্যায়ে যেতে পারেনি। বিভিন্ন ধরনের বীমার আওতায় আছে দুই কোটিরও কম মানুষ এবং বিশ্লেষকরা বলছেন, বীমা কোম্পানিগুলোর প্রতি মানুষের চরম অনাস্থার কারণে এ বিষয়ে মানুষের আগ্রহ কম। তবে বর্তমান সরকারের যে বিভিন্ন উদ্যোগ, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক ইচ্ছা ও আইডিআরের (বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ) বিভিন্ন পদক্ষেপ যেমন, প্রবাসীদের জন্য বীমা, শস্য বীমা, কৃষি বীমা, প্রতিবন্ধীদের জন্য বীমা, বঙ্গবন্ধু সুরক্ষা বীমা, বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বীমা ইত্যাদি চালু হয়েছে।

সাধারণ বীমা করপোরেশন ও জীবন বীমা করপোরেশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বাধীনতার পর শুরু হওয়া বীমা খাতে এখন সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ৮১টি কোম্পানি সক্রিয় আছে। এর মধ্যে জীবন বীমা নিয়ে কাজ করা কোম্পানির সংখ্যা ৩৫টি। আর সাধারণ বীমা নিয়ে কাজ করে আরও ৪৬টি প্রতিষ্ঠান।

বীমা শিল্প বাংলাদেশের জিডিপিতে মাত্র ১ শতাংশের কাছাকাছি অবদান রাখছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালের মধ্যে জিডিপিতে বীমা শিল্পের অবদান ৪ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা সে তুলনায় অনেক পেছনে রয়েছি। উন্নত দেশের জিডিপিতে বীমা খাতের গড় অবদান যেখানে ৭ শতাংশ সেখানে আমাদের দেশে বীমা খাতের অবদান মাত্র ০.৫৫ শতাংশ। ভারতে বীমা শিল্প জিডিপিতে ৪ শতাংশ অবদান রাখছে। বাংলাদেশের বীমা খাত অন্যান্য দেশের বীমা খাতের তুলনায় দেশের জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারছে না। তবে বর্তমান সরকার ইতিপূর্বে অবহেলিত বীমা খাতকে যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক সময় আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কর্মরত ছিলেন। এ কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেকে বীমা পরিবারের একজন বলে মনে করেন। এবং এ খাতের উন্নয়নে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকেন।

১৮ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষের জীবন বীমা রয়েছে। ২০১৯ সালে সংগৃহীত প্রিমিয়ামের পরিমাণ ছিল ১ হাজার কোটি টাকা। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ২০১ কোটি টাকা। ২০২১ সালেও প্রিমিয়াম সংগৃহীত হয় ১ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। গ্রাহকদের আস্থা তৈরি করতে সক্ষম হওয়ায় এটা সম্ভব হয়েছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, দাবি পূরণে কিছু কোম্পানির দীর্ঘসূত্রতায় ভালো কোম্পানিগুলোকে অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। গ্রাহকরা নানাভাবে প্রতারিত হন। তারা যে প্রিমিয়ামের টাকা জমা দিচ্ছেন এ সংক্রান্ত যথাযথ তথ্য পান না। একই সঙ্গে সরকারি রাজস্ব নানাভাবে ফাঁকি দেওয়া হয়। সর্বোপরি এ খাতের প্রতি আস্থার সংকট তৈরি হয়।

অটোমেশনের আওতায় আসলে এসব সমস্যা সহজেই সমাধান সম্ভব। এই বাস্তবতা অনুধাবন করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বীমা খাতে অটোমেশনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে তার বক্তব্যে বীমা খাতে অটোমেশনের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক ইচ্ছায় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) সম্প্রতি বীমা গ্রহীতা এবং বীমাকারীদের অনলাইন পরিষেবা সরবরাহ এবং আইডিআরএ, বীমাকারী এবং বীমা গ্রাহকের মধ্যে তথ্যের সরবরাহ সুনিশ্চিত করার জন্য একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফরম চালু করেছে।

ইউনিফাইড মেসেজিং প্ল্যাটফরম (ইউএমপি) নামে পরিচিত এই ডিজিটাল প্ল্যাটফরম চালু করার মধ্য দিয়ে সম্ভাব্য প্রতিটি ক্ষেত্রে ডিজিটাল পরিষেবা সরবরাহের জাতীয় লক্ষ্যে পৌঁছানোর নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। ইউএমপি বাস্তবায়নের ফলে বর্তমানে আইডিআরএ এসএমএস এবং ই-মেইলের মাধ্যমে বীমা গ্রাহককে তাদের বীমা পলিসির মেয়াদ, প্রিমিয়াম জমা, প্রিমিয়ামের পরবর্তী প্রদেয় তারিখসহ অন্যান্য সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্পর্কে অবহিত করতে পারছে। বীমা গ্রাহকের সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থার এই সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় বীমা খাতে দীর্ঘদিন বিদ্যমান আস্থাহীনতার অবসান ঘটতে যাচ্ছে।

ইউএমপিতে যে সব সার্ভিসসমূহ বাস্তবায়িত হয়েছে এবং চলমান রয়েছে :

ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে শুধু SMS-এর জন্য প্রতি অ্যাকাউন্ট বা গ্রাহকের বিপরীতে বার্ষিক ২০০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা চার্জ করে সেখানে ইউএমপি এর সব ডিজিটাল সার্ভিসের জন্য প্রতি পলিসির বিপরীতে ত্রৈমাসিক শুধুমাত্র ৩.৫০/- চার্জ করা হয়।

e-receipt : বীমা গ্রাহক কর্তৃক জমাকৃত প্রিমিয়ামের বিপরীতে ইউএমপি থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে ই-রিসিপ্ট প্রস্তুত হচ্ছে এবং বীমা গ্রাহক পর্যায়ে ডিজিটালি সরবরাহ করা হচ্ছে। সব প্রিমিয়াম রশিদ কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষিত থাকায় গ্রাহক হয়রানি অনেকাংশেই হ্রাস পাচ্ছে এবং সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ই-রিসিপ্ট সেবা চালু হওয়ায় বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে পলিসির রশিদ কুরিয়ারের মাধ্যমে প্রেরণ বাবদ পলিসি প্রতি আনুমানিক ১৫-২০ টাকা খরচ করতে হয় না। ফলে এ খাতে বীমা প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ খরচ সাশ্রয় হচ্ছে। পলিসি হোল্ডার পোর্টাল ও বীমা তথ্য নামক পলিসি হোল্ডার মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে বীমা গ্রাহক তার পলিসি সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য ও প্রিমিয়ামের ই-রিসিপ্ট সংগ্রহ করতে পারছেন, ফলে এ খাতে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

e-KYC : বীমা গ্রাহকের পরিচয় যাচাই, জাতীয় পরিচয়পত্রে উল্লিখিত সঠিক নাম, ঠিকানা ও অন্যান্য তথ্য সঠিকভাবে পলিসি ডকুমেন্টে আনয়নসহ এবং বীমা গ্রাহককে ট্র্যাক করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে API Connectivity স্থাপনকরত e-KYC সেবা চালু করা হয়েছে। ফলে গ্রাহক যাচাইসহ মেয়াদান্তে বীমা দাবি পরিশোধে গ্রাহক হয়রানি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। ইলেকট্রনিক কেওয়াইসি (e-KYC) বাস্তবায়ন ও চালুর ক্ষেত্রে বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহকে পৃথকভাবে নির্বাচন কমিশন থেকে সংযোগ গ্রহণ করতে হয়নি। IDRA কর্তৃক কেন্দ্রীয়ভাবে সবার জন্য বিনামূল্যে e-KYC বাস্তবায়ন করার ফলে এ খাতে বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহকে এককালীন খরচ বাবদ আনুমানিক ৪৩,৪৫,০০,০০০/-(তেতাল্লিশ কোটি পঁয়তাল্লিশ লাখ) টাকা এবং বার্ষিক নিয়মিত চলমান খরচ বাবদ ৮,৬৯,০০,০০০/- (আট কোটি ঊনসত্তর লাখ) টাকা খরচ করতে হয়নি। এ ছাড়াও IDRA সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহকে প্রতিটি তথ্য-উপাত্ত যাচাই বাবদ ২ (দুই) টাকার পরিবর্তে ১ (এক) টাকা খরচ করতে হচ্ছে অর্থাৎ ১ (এক) টাকা কম খরচ হচ্ছে। এতে বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহের বিপুল অঙ্কের খরচ সাশ্রয় সম্ভব হয়েছে এবং হচ্ছে।

Digital policy repository : বীমা খাতের উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়নে বীমা শিল্পের সঠিক তথ্য জানা অত্যন্ত জরুরি। সে লক্ষ্যে দেশের সব বীমা প্রতিষ্ঠানের বীমা গ্রাহকের পলিসি ও প্রিমিয়াম সংক্রান্ত তথ্য কেন্দ্রীয়ভাবে কর্তৃপক্ষের ইউএমপি’তে সংগ্রহ ও সংরক্ষিত হচ্ছে।

Policy Holder portal : বীমা গ্রাহক পলিসি হোল্ডার পোর্টালের মাধ্যমে সহজেই যে কোনো সময়ে যে কোনো স্থান থেকে বীমার লেনদেন সংক্রান্ত সব তথ্যসহ পলিসি স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করছে। তবে এক্ষেত্রেও যেসব বীমা কোম্পানি প্রিমিয়াম সংগ্রহের তথ্য দৈনিক ভিত্তিতে ইউএমপি তে আপলোড করছে সে সব কোম্পানির আপলোডকৃত ডাটার ভিত্তিতে বীমা গ্রাহক তার বীমার লেনদেন সংক্রান্ত সব তথ্যসহ পলিসি স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করতে পারছে।

Policy Holder Mobile App: পলিসি ও প্রিমিয়াম সংক্রান্ত সব তথ্য ও ই-রিসিপ্ট বীমা গ্রাহকের হাতের মুঠোয় পৌঁছে দিচ্ছে বীমা তথ্য মোবাইল অ্যাপ।

Agent Licencing Online (ALO) Module : বীমা খাতের সব বীমা বিক্রয় প্রতিনিধির (এজেন্ট) তথ্য সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ, নিবন্ধন, লাইসেন্স নবায়নসহ এ সংক্রান্ত কার্যাবলি ডিজিটালি সম্পন্ন করার লক্ষ্যে Agent Licencing Online (ALO) Module চালু করা হয়েছে। এতে বীমা এজেন্টদের লাইসেন্স প্রদানে কালক্ষেপণসহ নানা রকম ভুল ও জটিলতার নিরসন করা যাচ্ছে। 

লক্ষ্যণীয়, ইউএমপির ডিডিটাল সার্ভিস চালু হওয়ার ফলে বীমা খাতের বিভিন্ন কার্যক্রম ডিজিটালি সম্পন্ন শুরু হওয়ায় কর্তৃপক্ষ ও বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহের নানা খাতে বিপুল পরিমাণ খরচ সাশ্রয় হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল সার্ভিসসমূহের তুলনায় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ইউএমপির সার্ভিসসমূহ বাবদ খরচ অত্যন্ত নগণ্য। এ ছাড়াও ইউএমপির কারণে বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহের যে পরিমাণ খরচ সাশ্রয় হয়েছে সে তুলনায় ইউএমপি বাবদ খরচ তাদের জন্য যৎসামান্য।

ইউএমপি বাস্তবায়নের ফলে সরকার, কর্তৃপক্ষ, বীমা প্রতিষ্ঠান ও বীমা গ্রাহক যেসব সুবিধা গ্রহণ করছে :

আইডিআরএ কর্তৃক কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ।

পলিসি সংক্রান্ত ডাটা ডিজিটালি সংরক্ষণ।

আইডিআরএর পক্ষ থেকে গ্রাহককে পলিসি সংক্রান্ত এসএমএস এবং ই-মেইল প্রদান।

কোনো বীমা কোম্পানি একে অন্যের ডাটা দেখতে পারবে না; শুধু আইডিআরএ সব বীমা কোম্পানির ডাটা দেখতে পারবে।

ডাটা এনক্রিপশন নিশ্চিতকরণ।

ফায়ারওয়ালসহ সর্বোচ্চ পর্যায়ের ডাটা নিরাপত্তা প্রদান।

এখাতে স্বচ্ছতা ও গ্রাহক আস্থা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি পলিসি হোল্ডারগণের স্বার্থ সংরক্ষণ।

গ্রাহক হয়রানিসহ নানা সমস্যা হ্রাস।

অনিয়মিত ও ঝরে যাওয়া বীমা হ্রাস।

আইডিআরএ ও বীমা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বীমা সংক্রান্ত তথ্য গবেষণা, পর্যালোচনা ও সঠিক দূরদর্শী পরিকল্পনা গ্রহণে সক্ষমতা।

পলিসি সংক্রান্ত সব ডাটা ডিজিটালি প্রাপ্তি।

সঠিক পরিমাণে রাজস্ব আদায়।

ভুয়া এজেন্টের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ বন্ধ।

আইডিআরএর কাছে প্রয়োজনীয় সব ডাটা সংরক্ষিত থাকায় সময়মতো বীমা দাবি নিষ্পত্তি।

ই-রিসিপ্টের মাধ্যমে বীমা কোম্পানিসমূহের পলিসির রশিদ কুরিয়ার বাবদ ব্যয় সাশ্রয়।

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিবেশ সৃষ্টির ফলে বীমা শিল্পের ইমেজ বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়া।

সর্বশেষ খবর