মঙ্গলবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

ভেজাল প্রতিরোধ ও নিরাপদ খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে

প্রিন্সিপাল এম এইচ খান মঞ্জু

ভেজাল প্রতিরোধ ও নিরাপদ খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে

অপরিকল্পিত নগরায়ণ, পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ যেমন জনস্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। খাদ্যের ভেজাল তার চেয়েও ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। একদিকে খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ করে তুলেছে, অন্যদিকে ভেজাল খাদ্য কিনে মানুষ প্রতারিত ও জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। খাদ্যে ভেজাল এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, কোনো সচেতন মানুষের পক্ষে কোনো খাদ্যই স্বস্তির সঙ্গে খাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো খাবার পুষ্টির বদলে মানুষকে আরও রোগাক্রান্ত করছে। খাদ্যপণ্যে ভেজাল জনস্বাস্থ্যের জন্য এ মুহূর্তে এক নম্বর হুমকি। খাদ্যসামগ্রী ও কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রণের খবর ছড়িয়ে পড়ার ফলে দেশের সাধারণ ভোক্তারা উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছেন। খাদ্যে নকল-ভেজাল বন্ধে সরকারি উদ্যোগ বা মোবাইল কোর্টের অভিযান যেমন অব্যাহত রাখতে হবে তেমন এজন্য গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় খাদ্যে ভেজালের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠলে এ আপদ থেকে সহজেই নিস্তার পাওয়া যাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। মানুষের জীবন নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলছে তারা দেশ ও জাতির শত্রু। জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত এ আপদের বিরুদ্ধে সমন্বিত পদক্ষেপের বিকল্প নেই।

বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ৬০ কোটি মানুষ ভেজাল ও দূষিত খাদ্য গ্রহণের কারণে অসুস্থ হয়। এর মধ্যে মারা যায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এ ছাড়া দূষিত খাদ্য গ্রহণের কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সের আক্রান্ত ৪৩ শতাংশ শিশুর মধ্যে মৃত্যুবরণ করে ১ লাখ ২৫ হাজার। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের কারণে প্রতি বছর দেশে ২ লাখ লোক কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

দেশের শতকরা ৯৭ ভাগ মানুষ হৃদরোগের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে এক সমীক্ষায় জানা গেছে। বর্তমানে প্রায় ২ কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত এবং ২০ লক্ষাধিক মানুষ ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করছে। প্রধান এ তিনটি রোগ ছাড়া আরও বেশ কিছু জটিল রোগে ভুগছে কোটি কোটি মানুষ। এসব স্বাস্থ্য সমস্যার মূলে রয়েছে পরিবেশগত দূষণ ও খাদ্যে ভেজাল।

ভেজাল খাদ্যের কারণে জনস্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হয় তা পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর যেমন চাপ পড়ে তেমন অসংখ্য পরিবার চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। হোটেলগুলোয় এখন নানা ধরনের কেমিক্যালের পাশাপাশি মবিল ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব ভেজাল ও মারাত্মক ক্ষতিকর খাদ্য প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে জনস্বাস্থ্যের জন্য তা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। ভেজালবিরোধী কার্যক্রম ও অভিযানের কথা গণমাধ্যমে উঠে এলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল। খাদ্য নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত হওয়ায় খাদ্যের ভেজাল প্রতিরোধ রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান থাকলেও বছরের পর বছর ধরে খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে দুষ্টচক্র পার পেয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ ও পদক্ষেপ লক্ষণীয় নয়। আইন থাকলেও যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় খাদ্যে ভেজাল, প্রতারণা ও পরিবেশগত দূষণের ভয়াবহতা রোধ করা যাচ্ছে না। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তৎপর হলে ভেজাল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কয়েক বছর আগে রাজধানীতে কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পরিচালিত ভেজালবিরোধী অভিযান যথেষ্ট ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করেছিল।

ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা বাড়িয়ে ভেজাল ও দূষণ বিরোধী অভিযান জোরদার ও অব্যাহত রাখা হলে ভেজাল ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব নয়। জাতীয় জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট কয়েক বছর আগে নামিদামি করপোরেট ব্র্যান্ডিং কোম্পানিসহ শত শত পণ্যের মান পরীক্ষা করে প্রায় অর্ধশত খাদ্যপণ্যে ভেজাল চিহ্নিত করেছিল। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে এ বিষয়ে আরও সোচ্চার ভূমিকা নিয়ে মাঠে নামতে হবে।

খাদ্যে ভেজালবিরোধী অভিযান সারা বছর বলবৎ রাখতে হবে। সরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন, বাজার কমিটিসহ জনসাধারণের সামাজিক সচেতনতা ও আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে খাদ্যের ভেজাল প্রতিরোধ ও নিরাপদ খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

 

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রিন্সিপাল এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ

সর্বশেষ খবর