শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

সবজি বীজের গ্রামে বীজতলায় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত

শাইখ সিরাজ

সবজি বীজের গ্রামে বীজতলায় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত

যশোর শহর থেকে খুলনা মহাসড়ক ধরে এগিয়ে গেলেই চুড়ামনকাটি। বর্ষা শেষে ওই পথে গেলে এক জায়গায় চোখে পড়ে পথের দুই ধারে ফসলের মাঠজুড়ে নৌকার ছইয়ের মতো গোল গোল সাদা পলিথিন টানানো। যত দূর তাকানো যায়, দেখে মনে হবে অদ্ভুত কিছু একটা হচ্ছে। চুড়ামনকাটির এ গ্রামটির নাম আবদুলপুর। বছর বিশেক আগের কথা। এখানকার এক কৃষক আরশাদ মোড়ল শুরু করলেন ভিন্ন রকমের কাজ। পাঠক, আজ আপনাদের সে গল্পই শোনাব। ধান-পাটের কৃষি থেকে বের হয়ে সবজি চাষের ক্ষেত্রে যশোরের কৃষকই ছিল অগ্রণী। বিভিন্ন সবজি চাষের মাধ্যমে বাংলাদেশের কৃষিতে নতুন মাত্রা যোগ করার সময় প্রথম যে বিপত্তিটার মুখোমুখি হন কৃষক তা হলো মানসম্পন্ন বীজ ও চারার অভাব। যদিও দেশে বিভিন্ন ফলফসলের বীজ ও চারার ব্যাপক বাণিজ্যিক প্রসার ঘটছে কিন্তু মানসম্মত বীজ ও চারা নিয়ে কৃষকের সমস্যা কাটেনি। বিভিন্ন সময় প্রতারিত হতে হচ্ছে কৃষককে। সেখান থেকে বের হতেই যশোর সদরের চুড়ামনকাটির কৃষক আরশাদ মোড়ল বছর বিশেক আগে শুরু করেছিলেন বীজ থেকে সবজি চারা উৎপাদন। প্রথমে উদ্দেশ্য ছিল নিজের সবজির চারা নিজে উৎপাদন করবেন। উদ্বৃত্ত চারাগুলো বিক্রি করে দিতেন। এটিই ছিল চারা উৎপাদনের বাণিজ্যিকভাবে প্রথম ধাপ। যখন দেখলেন তাঁর উৎপাদিত চারার চাহিদা বাড়ছে, তখন পুরো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়েই সবজি চারা উৎপাদন শুরু করলেন। আরশাদ মোড়লের সাফল্য দেখে অন্য কৃষকও চারা উৎপাদন শুরু করেন। এ অঞ্চলটি হয়ে ওঠে সবজি চারা উৎপাদনের ক্ষেত্র। গ্রামটি এখন সবজি বীজের গ্রাম হিসেবে পরিচিত।

আমি একাধিকবার চুড়ামনকাটির এ সবজি বীজতলায় গিয়েছি। এ পথে আসা-যাওয়ার সময় দেখেছি প্রতি বছরই এর পরিধি বাড়ছে। গত মাসে আবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। মহাসড়কের পাশে এ বীজতলা ঘিরে গড়ে উঠেছে বাজার। নানা পণ্যের দোকান, চা-স্টল। বছরের ছয় মাস এখান থেকে সবজির চারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হয়। মাঠের পর মাঠ আবাদ হচ্ছে আগাম শীতকালীন সবজি চারা। একটু দূর বা ওপর থেকে দেখলে সাদা পলিথিনে আবৃত এসব বীজতলাকে অপরূপ মনে হয়। গাড়ি থেকে নেমে একটা চা-স্টলে বসে চা খেতে খেতে কৃষকের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তাঁরা জানালেন, চলতি বছর বেচাকেনা শুরু হলেও এবার বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় ঠিক এ মুহূর্তে চারার চাহিদা অন্য বছরের থেকে কম। কারও কারও চারা ক্রেতার অভাবে বিক্রি হচ্ছে না। ফলে চারাগুলো বড় হয়ে অকেজো হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া সার, কীটনাশকসহ যাবতীয় কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে সবজি বীজ উৎপাদনকারী চাষিদের ওপরে। চা শেষ করে মাঠের দিকে এগিয়ে গেলাম। এখানে বিভিন্ন কৃষেকর জমির পরিমাণ কারও ৫ কাঠা, কারও ১০ কাঠা। ১৫ হাত বাই আড়াই হাত লম্বা এক একটি মাটির বেডেই তৈরি হচ্ছে ফুলকপি, বাঁধাকপি, মরিচ, বেগুনসহ নানা প্রকারের সবজির চারা। আবার কোনো কোনো বেডে চলছে মাটি প্রস্তুতিও। কারও ৫০টি বেড, কারও বা ১০০। উপস্থিত কারও যেন সময় নেই একটু বসে জিরানোর। কারণ অতি অল্প এ জায়গাটি ব্যবহার করে বছরে ছয় মাসে তুলে আনতে হয় কমপক্ষে চার ফসলের চারা। তবেই আসে লাভের অংশ। মাঠে বীজ বপনের কাজ করছিলেন কৃষক মজিদ। কাজ করতে করতেই কথা বলছিলেন আমার সঙ্গে। বললেন, ১৫ হাত বাই আড়াই হাত আকারের একেক বেডে যে-কোনো ফসলের ৬ হাজার চারা তুলতে পারেন তারা। খরচ বাদ দিয়ে প্রতি বেড থেকে ৪ হাজার টাকা লাভ হয় প্রতিবার। এভাবে ছয় মাসে চারবার চারা বিক্রি করে পান মোট ১৬ হাজার টাকা। বাকি ছয় মাস সাধারণ ফসল ফলান তারা। গত দেড়-দুই দশকের অনুশীলনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে স্থানীয় কৃষক। এগিয়ে যেতেই সাক্ষাৎ পেলাম আরশাদ মোড়লের। লাল টকটকে রঙের শার্ট গায়ে দিয়ে বীজতলা দেখাশোনা করছেন। মুখ লাল হয়ে আছে পানের রসে। এগিয়ে এলেন আমার দিকে। কথা হলো তাঁর সঙ্গে। বলছিলেন, চারার ব্যবসা ঠিকঠাকমতো করা গেলে এ চারা সোনার চেয়েও দামি। এখানকার কৃষক এ ব্যবসা করেই বড় বড় ইলিশ খেতে পারছে, গরুর মাংস খেতে পারছে। বেশ রসিক মানুষ আরশাদ মোড়ল। এ মানুষটির হাত থেকে চারা তৈরির কৌশলটি এখন শতাধিক কৃষকের হাতে পৌঁছে গেছে।

কথা হলো আরেক কৃষক আজিজুরের সঙ্গে। আজিজুর মাত্র ১০ কাঠা জমি লিজ নিয়ে চারা উৎপাদন করছেন। ফুলকপি, বাঁধাকপি, বেগুন, টমেটো, মরিচসহ নানা সবজির চারা উৎপাদনে ভালো আছেন তিনি। তবে এ উৎপাদন খাতের সবচেয়ে বড় বাধা বৈরী আবহাওয়া। এ বছর বৃষ্টি কম হওয়ায় চারা তৈরিতে যেমন সময় লাগছে, কৃষকও চারা কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন না। তবে আশার কথা, শীতের সবজির আগাম চাষ করতে কৃষক অনাগ্রহী হলেও মৌসুমে নিশ্চয়ই চাষ করবেন।

এখন সারা দেশে সবজি আবাদের এক বিপ্লব ঘটে গেছে। কৃষক বিভিন্ন সবজির ফলন যেমন ভালো পাচ্ছেন, বাজারমূল্যও পাচ্ছেন ভালো। বছরে চারটি ফসল আবাদের সুযোগে ছোটখাটো দুর্যোগ ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করার সামর্থ্যও অর্জন করেছেন তাঁরা। তবে এ অর্জন নিশ্চিতে দরকার মানসম্মত চারা। এ ক্ষেত্রে যশোরসহ অনেক স্থানেই গ্রিনহাউস বা নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে চারা উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। রংপুরের নাসিক অ্যাগ্রো কিংবা যশোরের ম্যাক্সিম অ্যাগ্রোর ওপর বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে তুলে ধরেছি। তবে দেশে যে পরিমাণ চারার প্রয়োজন তার অধিকাংশ কৃষক নিজেরাই তৈরি করেন। আবার বিভিন্ন জেলায় গড়ে উঠেছে বীজতলা বা নার্সারি। সেখান থেকেও চারা কিনে অনেকে সবজি ফসল উৎপাদন করেন।

নদীতীরবর্তী নিচু জমিতে ভাসমান বেডে সবজি চারা উৎপাদনের ঐতিহ্য প্রায় শত বছরের। বরিশাল, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, গোপালগঞ্জে ভাসমান পদ্ধতিতে শাকসবজি ও মসলা আবাদ করা হয়। এসব অঞ্চলের ভাসমান চারা উৎপাদন ও সবজি আবাদকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

যা হোক, চুড়ামনকাটির এ বীজতলায় সামান্য একটু জায়গাতেই অধিক বাণিজ্য। একই সঙ্গে বহু মানুষের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয়েছে। সব মিলে এখানে বীজতলার জমি লিজের মূল্য অন্য সব এলাকার থেকে অনেক বেশি। জানা গেল, প্রতি বিঘায় লিজ গুনতে হয় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত। জমির মালিক, কৃষক ও কৃষিশ্রমিক কাউকে দেখে ব্যবধান বোঝার উপায় নেই। খেতের মাঝখানে টং ঘরের মতো মাচা। যেখানে কৃষক তপ্ত রোদে ক্লান্ত হয়ে একটু জিরোতে আসেন। মাচায় বসা সোহেলকে দেখেও বুঝতে পারিনি, সুদূর রাজবাড়ী থেকে এসেছেন সবজির চারা কিনতে। শুধু সোহেল নন, তাঁর মতো অনেকেই দূর থেকে এসেছেন চারা কিনতে। দেখলাম গামছা দিয়ে মোড়ানো খাবারের থালাবাটি আর বোতলে করে পানি নিয়ে বসে আছেন মধ্যবয়সী এক নারী। কথা বললাম তাঁর সঙ্গে। তাঁর সন্তান কৃষিশ্রমিক তরিকুলের জন্য নিজ হাতে রান্না করে খাবার নিয়ে এসেছেন। এর মধ্যেই তরিকুল চল এলেন। হাত ধুয়ে খেতে বসেন। মা গামছার বাঁধন খুলে বের করেন গামলায় রাখা ভাত। আর একটা বাটিতে ডিম ভাজা, কলা ভর্তা, আলু ভর্তা। এসব দিয়েই খুব তৃপ্তি নিয়ে তরিকুল খাবারটা খেলেন। পাশে বসে আমি খুব গভীরভাবে দেখছিলাম মা আর সন্তানের ভালোবাসার জায়গাটা। কত সামান্যতেই তাঁরা ভালো আছেন।

চারপাশে রোদের তীব্রতা বেশ। তার পরও মাঠে, ঘরে-বাইরে সবখানে কৃষকের নানামুখী ব্যস্ততা। ফসল বৈচিত্র্য, চাষ কৌশল ও চারা বীজতলা পাল্টে দিয়েছে গোটা এলাকার চিত্র। বীজতলা ঘিরে গড়ে ওঠা বাজারে বহুমুখী ব্যস্ততা। তবে গত বছর এ ব্যস্ততা আরও বেশি ছিল। আরও বেশি ছিল ক্রেতার ভিড়। এ বছর বৃষ্টি না হওয়ায় ব্যবসা মন্দ। কৃষক বলছেন তাঁরা টের পাচ্ছেন আবহাওয়া ঠিক আগের মতো নেই। ঠিক সময়ে আসে না বৃষ্টি, ঠিক নেই ষড়ঋতুর চিরায়ত সময়। এ পরিবর্তিত সময়ে কী করতে হবে তাঁরা তা জানেন না। তবে জানতে চান। যে চারা বাণিজ্য থেকে তাঁদের সচ্ছলতা এসেছে, তা ধরে রাখতে চান আগামীতেও। তাই তাঁরা শিখতে চান টিকে থাকার কৌশল। এ ক্ষেত্রে সরকারের কৃষি বিভাগকে এগিয়ে আসতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তি ও কলাকৌশলের সঙ্গে এই কৃষকদের পরিচয় করিয়ে দিতে হবে।

সবজি উৎপাদনে অন্যতম সফল একটি ক্ষেত্র যশোর জেলা। এখানকার বহু কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে সবজি চাষের মধ্য দিয়ে। একইভাবে দেশের অনেক স্থানে সবজি চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে এ জেলার সাফল্য অনুসরণ করে। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও এ এলাকার কৃষক নিজেদের জমিতে এনেছেন ফসল বৈচিত্র্য। চারা উৎপাদনের মধ্য দিয়ে একদিকে বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হচ্ছেন তাঁরা, অন্যদিকে কৃষক হিসেবে কৃষির সমৃদ্ধির পেছনে ভূমিকা রাখছেন। আধুনিক কৃষি কৌশল অনুশীলনের মাধ্যমে তাঁদের এ সচ্ছলতা অটুট থাকুক।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর