মঙ্গলবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

ত্যাগ-তেজস্বিতায় দীপ্ত এক রাজনীতিক

সোহেল সানি

ত্যাগ-তেজস্বিতায় দীপ্ত এক রাজনীতিক

মোজাফফর হোসেন পল্টু

প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এমনকি এমপি না হয়েও ভারতে যেমন গোপাল কৃষ্ণ গোখলে, মহাত্মা গান্ধী জাতীয় জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখেছেন, তেমনিভাবে আমাদের বাংলাদেশের রাজনীতিতেও অমর হয়ে আছেন মওলানা ভাসানী, কমরেড মণি সিং, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ, কমরেড ফরহাদ, মোজাফফর হোসেন পল্টু, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম কিংবা ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনের মতো নেতারা। বিগত চার পাঁচ দশকের জাতীয় রাজনীতিতে অবিস্মরণীয় অবদান রাখা নেতারা একেক করে চির অচেনার দেশে চলে গেছেন। যাঁদের অনেকেই ক্ষমতার স্বাদ পাননি। চাইলে তাঁরা সুযোগসন্ধানীদের দলে ভিড়ে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী হতে পারতেন। সেই তাঁদের মতোই একজন বেঁচে থাকা ত্যাগী নেতার মুখোমুখি হয়েছিলাম। তিনি বর্ষীয়ান জননেতা মোজাফফর হোসেন পল্টু।

বঙ্গবন্ধুর একান্ত সান্নিধ্য পাওয়া এ নেতা রাজনীতিতে এক ত্যাগের উপমা। তিনি একান্ত আলাপচারিতায় বললেন, বঙ্গবন্ধু একটা কথা বলতেন, ‘তুমি দেশ ও জাতিকে কী দিলা এটা যদি চিন্তা কর, তাহলে রাজনীতি কর, আর আমি কী পেলাম যদি এটা চিন্তা কর তাহলে রাজনীতি কোরো না।’ বঙ্গবন্ধু এও বলতেন- ‘রাজনীতি হলো দেশ ও জাতির পক্ষে একটা প্রতিশ্রুতি এবং আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থায় সংকল্পবদ্ধ থাকা।’ আমি যথাযথভাবে বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পেরেছি কি না জানি না, তবে চেষ্টা করেছি।

১৯৯০-এর তিন জোটের রূপরেখারও অন্যতম রূপকার ছিলেন তিনি। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ছিলেন ঢাকা মহানগরীর সভাপতি। তারপর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক। ১৯৯৪ সালের ৩০ জানুয়ারির সিটি নির্বাচনে মেয়র পদের প্রধানতম দাবিদার ছিলেন মোজাফফর হোসেন পল্টু। কিন্তু দলের স্বার্থে সে দাবি থেকে সরে দাঁড়াতে হয় তাঁকে।  মোজাফফর হোসেন পল্টু বারবার ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার হন। ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৬ আসনে বিজয়ী হলেও মিডিয়া ক্যু করে সে বিজয় জাতীয় পার্টি ছিনিয়ে নেয়। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে রাজধানীর তৎকালীন আটটি আসনেই সূক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পরাজয় নিশ্চিত করা হয়। পরাজিতদের অন্যতম পল্টু। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচন ছিল আওয়ামী লীগের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। এবারও ভাগ্যবিধাতা সহায় হলো না। অর্থবিত্তের সংকটে অনেক পরীক্ষিত নেতা মনোনয়নবঞ্চিত হন। দলে ভেড়ানো হয় দলছুট বহু বিত্তশালীকে। সেই অঙ্কের ফাঁদে পড়েন মোজাফফর হোসেন পল্টুর মতো ত্যাগী নেতাও। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ফেরে। অনেক নেতাই টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রী হন কিন্তু  মোজাফফর হোসেন পল্টুর স্থান হয়নি। ১৯৯৭ সালের কাউন্সিলে হন কেন্দ্রীয় যুগ্মসাধারণ সম্পাদক। তারপর ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচন। আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব করা হয় মোজাফফর হোসেন পল্টুকে। প্রহসনের ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপর্যয় ঘটে। একে ‘সালসা’ নির্বাচন বলে তিরস্কার করা হয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। পরবর্তীতে কথিত এক অভিযোগে মোজাফফর হোসেন পল্টুকে দলের যুগ্মসাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। হতবিহ্বল হয়ে পড়েন তাঁর ভক্ত-অনুসারীরা। সে সময় মোজাফফর হোসেন পল্টু ‘কারণ দর্শাও’ নোটিসের জবাবে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান বরাবর লিখেছিলেন, ‘মাননীয় নেতা! বঙ্গবন্ধু যখন সভাপতি তখন আপনি কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক। আর আমি ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। বঙ্গবন্ধু ও আপনার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যের অধিকারী হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমার নীতিবোধ, দলের প্রতি, নেতৃত্বের প্রতি আমি কতটা আনুগত্য দেখিয়েছি এবং আজও দেখাচ্ছি সে বিষয়ে আপনিই সবচেয়ে অবগত রয়েছেন- মোজাফফর হোসেন পল্টু।’

একবুক জ্বালা ধারণ করে প্রায় ১৫ বছর ছিলেন পদহারা। ব্যক্তিমাধুর্য দিয়ে মানুষকে আপন করে নেওয়ার, মানুষের আপন হয়ে ওঠার অসাধারণ প্রতিভা বিধাতা তাঁকে দিয়েছেন। কর্মীবান্ধব নেতা হিসেবেও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে রয়েছে বিশেষ খ্যাতি। রাজনৈতিক চরিত্রের বিশেষ পরিস্ফুটিত দিকটি হলো অকুণ্ঠ ত্যাগ। তাঁর জীবন বর্ণাঢ্য, সংগ্রামমুখর। ত্যাগ স্বীকার আর তেজস্বিতার হিরণ¥য় দ্যুতিতে ভাস্বর এ মহান রাজনীতিকের জন্ম ১৯৪২-এর ২৫ সেপ্টেম্বর। ৮০ বছর পার করেছেন ইতোমধ্যে। আশার কথা, বয়সভার তাঁর গতি মন্থর করতে পারেনি। নির্বিঘ্নে পথ চলেন। তাঁকে অতি কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। আদর্শবাদী এ নেতার জীবনগল্প শুরু করা গেলেও শেষ করা দুষ্কর। গুণমুগ্ধ এ মানবিক মানুষের শেষের ভিতরেও আছে অশেষ। তাঁর ছয় দশকের রাজনীতির মূল্যায়ন করা কঠিনতর কাজ। তিনি পুরোদস্তুর এক রাজনীতিবিদ। ঢাকা মহানগরীর রাজনীতিতে কিংবদন্তিতুল্য এক পুরুষোত্তম ব্যক্তিত্ব।

বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল এটাই তাঁর কাছে বড় অর্জন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তিনি। মোজাফফর হোসেন পল্টু আসলেই এক বিদগ্ধ রাজনীতিবিদ। হাজারো কর্মীর তির্যক প্রশ্নের তীর বুকে বিদ্ধ হলেও প্রতিক্রিয়ার কর্কশ ভাষার প্রকাশ ঘটাননি কখনো। পথে-প্রান্তরে পথচলার বাঁকে বাঁকে হয়তো থমকে দাঁড়ান। তারপর বঞ্চনা নামক কাব্যনামার শিরোনাম হতে চান না সংবাদপত্রের পাতায়। মোজাফফর হোসেন পল্টু এ কারণেই সাধারণের মধ্যেও অনন্য, অসাধারণ। আমরা তাঁর গুণমুগ্ধরা সব সময় কামনা করি তিনি সুস্থ থাকুন, সক্রিয় থাকুন। দীর্ঘজীবী হোন পল্টু ভাই।

            লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর