শনিবার, ১ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

চ্যানেল আই : হৃদয়ে বাংলাদেশ, হৃদয়ে মাটি ও মানুষ

শাইখ সিরাজ

চ্যানেল আই : হৃদয়ে বাংলাদেশ, হৃদয়ে মাটি ও মানুষ

আজ (১ অক্টোবর) চ্যানেল আইয়ের পথচলায় ২৪-এ পদার্পণ। চ্যানেল আইয়ের সূচনালগ্ন থেকেই আমরা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছি দেশি ঐতিহ্যের দ্যোতনা। যে সংস্কৃতি, যে আচার প্রতিটি বাংলাদেশির মনন-শেকড়ে প্রোথিত, আমাদের যত বাঙালিয়ানা তা আমরা তুলে ধরতে চেয়েছি। পাশাপাশি দর্শকের মনে বুনে দিতে চেয়েছি পরিবর্তিত সময়ের বীজ। যেন সমৃদ্ধ হয় আগামী। এ বদ্বীপ রাষ্ট্র বাংলাদেশের মূলে রয়েছে কৃষি ও কৃষিজীবী মানুষ। ফলে কৃষি-সংস্কৃতিই থেকে গেছে আমাদের ভাবনাচিন্তার কেন্দ্রে। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা চ্যানেল আইয়ে সম্প্রচার শুরু করি ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠান। দীর্ঘ দুই দশক ধরে এ অনুষ্ঠানটি শুধু গ্রামের সাধারণ কৃষকেরই নয়, শহরের মানুষ, গবেষক, নীতিনির্ধারকদের আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে। আমরা তুলে ধরতে চেয়েছি কৃষিকৌশল, কৃষকের কথা, বিশ্বকৃষির গতিপ্রকৃতি, সর্বোপরি মানুষের যাপিত জীবন। কেননা কোনো মানুষই আদতে কৃষির বাইরে নয়। একটা সময় ধান আর পাটই ছিল বাংলাদেশের মূল ফসল। এ দুই ফসলের বাইরে চাষাবাদের বিষয়ে কৃষক তেমন আগ্রহী ছিলেন না। এর কারণ নতুন ফসলের ফলন নিয়ে সংশয় ও বাজার অনিশ্চয়তা। আমরা চেষ্টা করেছি কৃষককে বহু ফসল ফলনে উদ্বুদ্ধ করতে। যে দু-এক জন কৃষক নতুন ফলফসল চাষ করেছেন তাদের সাফল্যগাথা আমরা তুলে ধরেছি গুরুত্বের সঙ্গে। একজনের সাফল্য দেখে যুক্ত হয়েছেন আরেকজন। তরুণ কৃষকদের হাত ধরে উচ্চমূল্যের ফলফসল চাষ শুরু হয়। দেশি সবজির পাশাপাশি বিদেশি সবজি লেটুস, ক্যাপসিকাম, বিট রুট, ব্রোকলি, রেড ক্যাবেজ, স্কোয়াশ থেকে শুরু করে সুইট কর্ন, বেবি কর্ন, থাই তুলসী, লেমনগ্রাস চাষ হচ্ছে একরের পর একর জমিতে। থাই পেয়ারা দিয়ে শুরু করে এখন স্ট্রবেরি, ড্রাগনফ্রুট, রাম্বুটান, অ্যাভোকাডো ও রকমেলনের চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এভাবে সারা দেশে ছড়িয়েছে ফসল বৈচিত্র্য। এখন পাখির চোখে দেখলে ফসলের মাঠকে মনে হয় বিচিত্র ফলফসলের নকশিকাঁথার মাঠ।

গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি দেশে শুরু হয় রুপালি বিপ্লব। ‘হাকিম আলীর মৎস্য চাষ’ হয়ে ওঠে অসংখ্য তরুণের মাছ চাষের অনুপ্রেরণা। সারা দেশে মাছ ঘিরে তৈরি হয় কর্মসংস্থান, নতুন অর্থনৈতিক বলয়। ধীরে ধীরে মাছ চাষ সম্প্রসারিত হতে থাকে। একজনের সফলতার গল্প অনুপ্রাণিত করে অন্যজনকে। একজনের সফলতার কৌশল শিখে নেয় অন্যজন। মাছ চাষে যুক্ত হওয়া নিত্যনতুন প্রযুক্তির খবর দেখে বাড়তে থাকে প্রযুক্তির ব্যবহার। আরএএস, বায়োফ্লক, বটম ক্লিন, আইপিআরএস নানান প্রযুক্তি মাছ চাষকে দিয়েছে শিল্পের আদল। আজ বিশ্বে সামগ্রিকভাবে স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। মুক্ত জলাশয় থেকে বছরে মোট ১৩ লাখ টন মাছ আহরণ করা হয়। এর মধ্যে ইলিশ প্রায় ৬ লাখ টন। ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে ১ নম্বর অবস্থানে। তবে সামুদ্রিক মাছ আহরণে বাংলাদেশ ২৭তম। বাংলাদেশ সমুদ্র থেকে ৬ লাখ ৭০ হাজার টন মাছ সংগ্রহ করে। এ ছাড়া দেশি মাছের জাত সংরক্ষণ থেকে শুরু করে ছোট মাছের ব্রিডিংয়ে হ্যাচারি মালিকদের উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের পুষ্টি নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে হৃদয়ে মাটি ও মানুষ প্রতিনিয়তই ভূমিকা রেখে চলেছে। এটি হয়ে উঠেছে মাছ চাষিদের ইনফরমেশন হাব।

মাংস ও দুধ উৎপাদনে আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে মাংস উৎপাদন হয়েছে ৮৪.৪০ লাখ টন। আর ডিম উৎপাদন হয়েছে ২ হাজার ৫৭.৬৪ কোটি। স্বাধীনতার ৫০ বছরে মাংস উৎপাদন ১৫ গুণ বেড়েছে। ডিমের উৎপাদন বেড়েছে ১২ গুণ। এ বছর ঈদুল আজহায় সারা দেশে মোট ৯৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৩টি গবাদি পশু কোরবানি হয়েছে। এর সবটাই জুগিয়েছেন আমাদের খামারিরা। এ ক্ষেত্রেও হৃদয়ে মাটি ও মানুষ সম্প্রসারণে রেখেছে ভূমিকা। খামার ব্যবস্থাপনার শুরু থেকে বাজারজাত পর্যন্ত প্রতিটি ধাপের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে আগ্রহী করে তুলেছে তরুণদের। পাশাপাশি এ খাতের সম্ভাবনা ও সংকট নিরসনে নানান প্রতিবেদন প্রচারের মাধ্যমে খামারিদের অনুপ্রাণিত করেছে। থমাস ম্যালথাসের মতে পৃথিবীর জনসংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক গতিতে আর খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ছে গাণিতিক হারে। অতএব পৃথিবীতে খাদ্যাভাব হবে, দুর্যোগ দেখা দেবে। কিন্তু কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাব উৎপাদন বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ১৯৬১ সালে বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন ছিল ৭৪১.৪৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন। ২০২১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২৭৬৯.২ মিলিয়ন মেট্রিক টনে। এ সময় খাদ্যশস্যের উৎপাদন প্রতি বছর বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ২.৩ শতাংশ হারে। অন্যদিকে মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ১.৭ ভাগ হারে। হৃদয়ে মাটি ও মানুষের সূচনা থেকেই প্রযুক্তির কৃষিকে দেওয়া হয়েছে প্রাধান্য। আমরা বহুবার চীনে অনুষ্ঠিত পৃথিবীর বৃহৎ কৃষি যন্ত্রপাতির মেলা থেকে তুলে ধরেছি কৃষিযন্ত্রের নানান দিক। এ ছাড়া জাপান, কোরিয়া, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ফ্রান্স, পর্তুগালসহ বিশ্বের আধুনিক কৃষিকৌশল উপস্থাপনের মাধ্যমে কৃষক, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের উজ্জীবিত করতে চেয়েছি। তার প্রতিফলনও আমরা আমাদের কৃষিতে দেখছি। সারা বিশ্বেই কৃষিতে প্রভাব পড়েছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের। আমরা উন্নত বিশ্বের নানান প্রযুক্তি তুলে ধরছি প্রতিনিয়ত। যেন বাংলাদেশের কৃষি বিশ্বকৃষির সঙ্গে তাল মেলাতে শেখে।

বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকের সিংহভাগই অবস্থান করেন মধ্যপ্রাচ্যে। কৃষি-অন্তঃপ্রাণ এ দেশের মানুষ মরুপ্রধান মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে সূচনা করেছে কৃষির বিস্তার। মরুর বুকে জাগিয়ে দিয়েছে ফলফসলের গান। হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে আমরা সেসব সফলতা তুলে ধরেছি। অনুপ্রাণিত হয়ে সেসব মরু কৃষক তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করেছে। পাল্টে দিয়েছে নিজেদের ভাগ্য, সমৃদ্ধ করেছে আমাদের অর্থনীতি।

কমবেশি সব পেশারই রয়েছে পেশাগত সংগঠন। কেবল কৃষকই একা। তার হয়ে কথা বলার কেউ নেই। তার কণ্ঠ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছানোর কেউ নেই। সূচনা থেকেই হৃদয়ে মাটি ও মানুষ হয়ে উঠতে চেয়েছে কৃষকের কণ্ঠ। জাতীয় বাজেটের কৃষি খাত নিয়ে চ্যানেল আইয়ের কৃষি কার্যক্রম হৃদয়ে মাটি ও মানুষের পক্ষ থেকে ২০০৬ সাল থেকে ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’ শীর্ষক প্রাক-বাজেট আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। এর মূল উদ্দেশ্য কৃষির বিভিন্ন ইস্যুতে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক নারী-পুরুষের দাবি-দাওয়া ও সমস্যা-সম্ভাবনার কথাগুলো নীতিনির্ধারকের নজরে আনা যাতে বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় কৃষকের স্বার্থের বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পায়। এসব আয়োজনে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদেরও উপস্থিতি থাকে। ফলে কৃষক ও খামারি খোলামেলাভাবে তাদের সমস্যা ও চাহিদার কথাগুলো সরাসরি জানানোর সুযোগ পায়। কৃষকের প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক তাদের সমস্যার সমাধান করেছেন- এ রকম বহু নজির রয়েছে। আবার প্রাক-বাজেট আলোচনার সুপারিশের ভিত্তিতে কৃষকের স্বার্থে জাতীয়ভাবে অনেক উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে।

জাতীয় ইস্যু থেকে শুরু করে কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত স্থানীয় অনেক খুঁটিনাটি বিষয় নিয়েও কৃষক তাদের মতামত প্রদান করে। প্রতিটি অনুষ্ঠানে কয়েক হাজার কৃষক অংশ নেয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট অঙ্গপ্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহির জন্য কৃষক উচ্চকণ্ঠ হয়। এর মাধ্যমে কৃষকের সামাজিক ক্ষমতায়ন তৈরি হয়। কৃষক হয়ে ওঠে অধিকারসচেতন।

শুরু থেকেই একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি হৃদয়ে মাটি ও মানুষ। পরিণত করতে চেয়েছি একটি আন্দোলনে। যে আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের আপামর কৃষক তথা মাটির উৎপাদক শ্রেণি ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে তো বটেই, প্রভাবিত করতে চেয়েছি শহর-নগরের অভিজাত ও উচ্চাকাক্সক্ষী শ্রেণিকেও। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে মাঠ পর্যায়ে ব্যবহারিক কৃষি শিক্ষার কার্যক্রম এবং নতুন প্রজন্ম তথা নাগরিক শিক্ষার্থীদের কৃষি উৎপাদন ও গ্রামীণ জীবন-জীবিকা সম্পর্কে ধারণা দিতে হৃদয়ে মাটি ও মানুষে অন্তর্ভুক্ত করেছি ‘ফিরে চল মাটির টানে’।

প্রিয় পাঠক! হৃদয়ে মাটি ও মানুষ বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে কতটা প্রভাব রাখতে পেরেছে তার বিচার-বিশ্লেষণ আপনাদের কাছে। আমি ভাবছি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই সময়ে এসে বিশ্বকৃষি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, আমাদের কৃষক ও নীতিনির্ধারকদের তার সঙ্গে প্রতিনিয়ত কীভাবে সম্পৃক্ত রাখা যায়।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর