রবিবার, ২ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

দুই দলের যুদ্ধংদেহি অবস্থান

মহিউদ্দিন খান মোহন

দুই দলের যুদ্ধংদেহি অবস্থান

সাফ নারী ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আমাদের মেয়েরা দেশে প্রত্যাবর্তন করেছেন ২১ সেপ্টেম্বর। তাঁদের দেওয়া হয়েছে বিপুল সংবর্ধনা। এ এক মহা আনন্দের খবর। দেশবাসীর পক্ষ থেকে তাঁদের আক্ষরিক অর্থেই প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানানোর খবর পরদিন পত্রিকাগুলোয় ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। মানুষ যখন এসব খবরে উদ্বেলিত, তখন একই দিনে প্রকাশিত আরেকটি খবর জনমনে সৃৃষ্টি করেছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। খবরটি এসেছে রাজধানী ঢাকার সন্নিকটবর্তী জেলা মুন্সীগঞ্জ থেকে। পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ কর্মসূচি কেন্দ্র করে পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষে জেলা সদরের মুক্তারপুর পুরান ফেরিঘাটসংলগ্ন এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার খবর ওইদিন সব দৈনিক গুরুত্বসহ প্রকাশ করেছে। খবরে বলা হয়েছে, ওই সংঘর্ষে সাংবাদিক, পুলিশ, বিএনপি কর্মীসহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৫০ জন পুলিশ। সাংবাদিক রয়েছেন পাঁচজন। আহত বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাঁদের ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। আহতদের মধ্যে যুবদল কর্মী শহিদুল ইসলাম শাওন ২২ সেপ্টেম্বর রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে মারা যান।

ঘটনা সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বিকাল ৩টার দিকে সভাস্থলে বিএনপি নেতা-কর্মীরা মিছিল-সহকারে আসতে থাকেন। পুলিশ এ সময় তাঁদের মিছিল করতে বাধা দেয়। স্থানীয় এক বিএনপি নেতার উদ্ধৃতি দিয়ে খবরে বলা হয়েছে, জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিনহাজ-উল ইসলাম মিছিলকারীদের বহন করা একটি ব্যানার ছিনিয়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেললে বিএনপি কর্মীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশের প্রতি ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। পুলিশ লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, গুলি ও রাবার বুলেট ছোড়ে। এতে ওইসব ব্যক্তি আহত হন। বিএনপি নেতারা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তাঁরা পুলিশের পূর্বানুমতি নিয়েই সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন। তা সত্ত্বেও পুলিশ তাঁদের নির্ধারিত স্থলে সমাবেশে বাধা দিলে তাঁরা পুরান ফেরিঘাট এলাকায় সরে আসেন। তার পরও পুলিশ বাধা দেয়। আর এতেই সংঘর্ষের সূত্রপাত। অন্যদিকে পুলিশ বলছে, বিএনপি কর্মীরা পরিকল্পিতভাবে পুলিশের ওপর হামলা করেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিনহাজ, মুন্সীগঞ্জ সদর থানার ওসি তারিকুজ্জামানসহ অন্যরা আহত হন।

ঘটনাটি দুঃখজনক সন্দেহ নেই। কেননা গণতান্ত্রিক রীতি শুধু নয়, আমাদের সংবিধানের ধারা অনুযায়ী গুরুতর কোনো কারণ ছাড়া পুলিশ রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে বাধা দিতে পারে না। কেননা আমাদের সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনশৃঙ্খলা ও জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষ শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রা করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে’। মুন্সীগঞ্জের ঘটনাটিকে আমরা যাদি সাংবিধানিক বিধানের ছাঁচে ফেলি, তাহলে কোনোভাবেই তা মেলানো যাবে না। কারণ বিএনপি কর্মীরা মিছিল করে এসে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটাননি। যেহেতু তাঁরা পূর্বাহ্ণেই পুলিশের অনুমতি নিয়েছিলেন তাই এ ক্ষেত্রে পুলিশের বাধা দেওয়া ও গুলি ছোড়ার যৌক্তিক কোনো কারণ দেখানো যাবে না। এখানে একটি কথা প্রাসঙ্গিকভাবেই এসে যায়, রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের জন্য পুলিশের অনুমতি নিতে হবে কেন? অনুমতি তো সংবিধান দিয়েই দিয়েছে। তাহলে এ অনুমতির বিধান কেন? জনসভা বা মিছিল করতে যদি পুলিশের অনুমতি নিতে হয়, তাহলে তো গণতন্ত্র বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে। তবে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তার স্বার্থে দলগুলো পুলিশ প্রশাসনকে তাদের কর্মসূচি সম্পর্কে পূর্বাহ্ণে অবহিত করে রাখতে পারে; যাতে জরুরি প্রয়োজনে তারা ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে পারে। তা ছাড়া পুলিশ প্রশাসন যদি শান্তিশৃঙ্খলা ও জনস্বার্থে পূর্বাহ্ণে মিছিল-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাহলে সমাবেশ-মিছিল করার জন্য পুলিশের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। এখানে একটি কথা না বললেই নয়। জনসভা বা মিছিল করার জন্য পুলিশের অনুমতি নেওয়ার প্রথাটি আগে ছিল না। সামরিক শাসনের সময় ‘ঘরোয়া রাজনীতি’ চালুর পর এ অনুমতি প্রথা চালু হয়। ওটা ছিল সামরিক আইনের একটি বিধান। এখন দেশে সামরিক আইন নেই। অথচ সে সময় চালু করা অসাংবিধানিক এ প্রথাটি রয়ে গেছে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সব সময় সামরিক আইনের সমালোচনা করে। সামরিক শাসনকে তারা অবৈধ বলেও আখ্যায়িত করে। কিন্তু সেই ‘অবৈধ’ আমলে চালু হওয়া এ বিধানটি বাতিল করার গরজ কেউই অনুভব করেননি। এও সেই বিশেষ ক্ষমতা আইনের মতো। যখন যারা ক্ষমতার বাইরে থেকেছে, তখন তারা ওই আইন বাতিলের দাবি জানিয়েছে। যে-ই ক্ষমতা হস্তগত হয়েছে, বেমালুম সবকিছু ভুলে গিয়ে সে আইন বিরোধীদের দমনের কাজে ব্যবহার করেছে। যেসব কারণে পুলিশ রাজনৈতিক দলের সভা-মিছিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে, মুন্সীগঞ্জের ঘটনায় এসব কারণ একেবারেই অনুপস্থিত। না সেখানে আগেভাগে পুলিশ কোনো নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, না জনশৃঙ্খলা ভঙ্গের কোনো ঘটনা ঘটেছিল। সংবাদপত্রের খবরে কোথাও এ কথা বলা হয়নি, বিএনপি কর্মীরা সশস্ত্র অবস্থায় ছিলেন বা জনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছিলেন। বরং প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে যেসব খবর এ পর্যন্ত গণমাধ্যমে এসেছে, তাতে এটা অনুমান করা যায় যে, পুলিশের অতি উৎসাহই এ দুঃখজনক ঘটনার জন্য দায়ী। তাহলে প্রশ্ন, কেন পুলিশের এ অতি উৎসাহ। একজন পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্ব শান্তিশৃঙ্খলা যাতে বিনষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা। বিরোধী দলের মিছিলের ব্যানার কেড়ে নেওয়া বা ছিঁড়ে ফেলা নয়। এটা তার কর্তব্যকর্মের মধ্যে পড়ে না। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সহিংস ঘটনাগুলো গভীর মনোযোগে পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তা একটু বেশি আগুয়ান হয়ে পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছেন। ভোলা, নারায়ণগঞ্জসহ সবখানেই একই ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। কিন্তু কেন তাদের এ তৎপরতা? তারা কি সরকারের শুভানুধ্যায়ী হিসেবেই বিরোধী দল, মানে বিএনপির ওপর চড়াও হচ্ছেন, নাকি পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে কোনো বিশেষ পক্ষের পারপাস সার্ভ করতে চাচ্ছেন, জনমনে এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। সচেতন ব্যক্তিরা মনে করেন, এসব অতি উৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তার বিষয়ে সরকারের ভালোভাবে খোঁজখবর নেওয়া উচিত। সরকার তো হামেশা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে স্যাবোটাজের অভিযোগ করে। কিন্তু স্বগৃহ থেকেও যে এটা ঘটতে পারে তার নজির নিকট অতীতেই রয়েছে। সুতরাং ওইসব পুলিশ কর্মকর্তাকে বাহবা নয়, বরং তাঁদের সংযত হতে এবং কর্মপরিধি ও আইনের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়াই উত্তম।

মুন্সীগঞ্জের ঘটনা যদিও পুলিশ ও বিএনপির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষ ঘটতে দেখা গেছে। অতি সম্প্রতি ঢাকার মিরপুরে ঘটেছে তেমনি ঘটনা। পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করেছেন বিএনপি কর্মীদের ওপর। প্রতিদিনই এ ধরনের খবর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসছে। এসব ঘটনায় আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা ঘরপোড়া গরুর মতো সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাচ্ছি। যেভাবে মুখোমুখি সরকারি ও বিরোধী দল, বিশেষ করে বিএনপি এখন দাঁড়িয়ে, তাতে পরিস্থিতি যে-কোনো সময় সংঘাতময় হয়ে উঠতে পারে। আর এ ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতি যে কখনই ভালো ফল বয়ে আনে না, সে কথা বলাই বাহুল্য।

বিষয়টি সচেতন ব্যক্তিদের ভাবিয়ে তুলেছে। ইদানীং উভয় দলের সিনিয়র নেতারা একে অন্যকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়ে যেসব বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে চলেছেন, তা কোনোভাবেই গণতন্ত্রের জন্য শুভলক্ষণ নয়; সংজ্ঞায় তো পড়েই না। তাঁরা ‘রাজপথে খেলা হবে’ বলে যে হুংকার দিচ্ছেন তা কীসের ইঙ্গিত দেয় তা-ও ভেবে দেখার দরকার। ১৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত নিবন্ধে আমি এ বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোকপাতের চেষ্টা করেছি। একদিকে বিএনপি বলছে ‘ফয়সালা হবে রাজপথে’, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বলছে ‘রাজপথেই বিএনপিকে মোকাবিলা করা হবে’। ইদানীং আবার রাজপথ কোন দলের বাপদাদার সম্পত্তি তা নিয়েও চলছে বাক্যগোলা নিক্ষেপ। প্রকৃতপক্ষে রাজপথ বিএনপি, আওয়ামী লীগ কারোরই সম্পত্তি নয়। রাজপথ রাষ্ট্রের তথা জনগণের সম্পত্তি। জনগণের সে রাজপথে নিজ নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার যে মহড়া দিচ্ছে দেশের এ বৃহৎ দুই দল, তাতে অচিরেই তা জনগণের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠতে পারে। কথায় আছে, ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়’। প্রবাদটির উৎপত্তি সম্ভবত রাজা-বাদশাহদের আমলে; যখন তলোয়ার, তীর, ধনুক, বর্শা নিয়ে এক পক্ষ আরেক পক্ষের মোকাবিলা করত। ওই সময় যুদ্ধ হতো বড় বড় প্রান্তরে, যেখানে উলুখাগড়া জাতীয় ছোট ছোট ঘাস জন্মাত। যুদ্ধরত সৈনিক ও হাতি-ঘোড়ার পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে ময়দানের উলুখাগড়া বিনষ্ট হতো। আজ যখন বড় দুটি দল ভোটযুদ্ধের পরিবর্তে রাজপথে একে অন্যকে মোকাবিলার হুমকি দিচ্ছে, তখন সংগত কারণেই সচেতন ব্যক্তিরা নিজেদের উলুখাগড়া বিবেচনা করে উদ্বিগ্ন হচ্ছেন। অতীতেও আমরা এ ধরনের পরিস্থিতি দেখেছি এবং তার ফল ভালো হয়নি। উল্লেখ করা নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ২০০৬ সালে বাংলাদেশ তেমনই একটি বাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পড়েছিল। তখনো এ দুই দল এমনভাবে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল, যার ফলে একটি অগণতান্ত্রিক শাসন চেপে বসেছিল জাতির ওপর। না, তাই বলে আমি এটা বলছি না যে, সব সময় একই ঘটনা ঘটবে। তবে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে যদি গণতন্ত্রের অনুশীলন না থাকে, তাহলে অপশক্তির মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার আশঙ্কাটা বেড়ে যায়।

কথায় আছে, পাটাপুতায় ঘষাঘষি, মরিচের দফারফা। আমরা এ দেশের সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মরিচ বই যেন কিছু নয়। তারা ঘষাঘষি, ঝাপ্টাঝাপ্টি করবে, আর তাতে পিষ্ট হয়ে আমজনতার প্রাণ হবে ওষ্ঠাগত। আমরা এ ধরনের পরিস্থিতি কামনা করি না কখনই। সুতরাং যে যুদ্ধংদেহি মনোভাব নিয়ে বৃহৎ দুই দল মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তা পরিহার করে গণতান্ত্রিক আচরণই কাম্য। আর এটা তাদের করতে হবে হাতে সময় থাকতে। সাধক-বাউল লালন শাহ সে কথাই বলে গেছেন তাঁর গানে- ‘সময় গেলে সাধন হবে না/দিন থাকিতে দিনের সাধন, কেন জানলে না....’। 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর