রবিবার, ২ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

দুর্গতিনাশিনী দুর্গা

অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী

দুর্গতিনাশিনী দুর্গা

দেবী দুর্গা হলেন শক্তির রূপ, তিনি পরব্রহ্ম। অন্যান্য দেব-দেবী মানুষের মঙ্গলার্থে তাঁর বিভিন্ন রূপের প্রকাশ মাত্র। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুসারে দেবী দুর্গা ‘দুর্গতিনাশিনী’ বা সব দুঃখ-দুর্দশার বিনাশকারিণী। হিন্দু শাস্ত্রমতে, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। পৃথিবীতে শুভ-অশুভর যুদ্ধ চলছে প্রতিনিয়ত। সাধনার মহাযুদ্ধে জয়ী হতে পারলেই মানুষ মহাশক্তি দুর্গার সন্ধান পায়। পরাশক্তির অধিকারী অসুরকে বধ করার জন্য মা দুর্গা ১০ হাতে ১০ অস্ত্রে সুসজ্জিত; তাঁর ১০ হাত ১০ দিক রক্ষার প্রতীক। মূলে তিনি এক পরমবিদ্যা স্বরূপিণী, যিনি সর্বভূতের প্রাণরূপী মহা দিব্য মূর্তি মা ও জগৎ মঙ্গলময়ী দুর্গা।

দুর্গার শাস্ত্রীয় স্বরূপ : তিনি শাশ্বত, মহাকাল ও সনাতনী, তিনিই নিয়তি ও নিয়ন্তা। দুর্গার এ গুণ ও বৈশিষ্ট্য থেকে বোঝা যায় তিনি শুধু দেবী নন, তিনি ঈশ্বর। ঈশ্বরকে নারীরূপে ভাবতে মানুষ খুব অভ্যস্ত নয়। কিন্তু ঈশ্বর তো পুরুষও নন। ঈশ্বরের যে অনন্ত মহিমার বর্ণনা রয়েছে তাকে ভাস্কর্যে উপস্থাপন করতে গিয়ে বাঙালির কাছে বহুভুজা ও সশস্ত্র নারী রূপই যথার্থ মনে হয়েছে। দুর্গম অসুরের কাজ ছিল জীবকে দুর্গতিতে ফেলা। দুর্গমকে বধ করে যিনি স্বর্গ বিতাড়িত দেবগণকে হৃতরাজ্য ফিরিয়ে দেন এবং জীবজগৎকে দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করেন তিনি মা দুর্গা। মায়ের পদতলে মহিষাসুর অশুভ এবং অহংকারের প্রতীক, যা জগতের অমঙ্গলের হেতু। ত্রিনয়নী মহাদেবী দুষ্টের দমনে শিষ্টের পালনে আবির্ভূতা, এ পূজার মূর্তি কল্পনায় ফুটে ওঠে শৌর্যবীর্য (কার্তিক), জ্ঞানভক্তি (সরস্বতী), সিদ্ধি (গণেশ), সম্পদ (লক্ষ্মী) এবং মানব জীবনের ইহকালের বস্তুলাভ এবং অন্তিমকালে মাতৃক্রোড়ে চির আশ্রয়। পুরনো শাস্ত্রমতে দেবীর বোধন হয় বিল্ববৃক্ষে বা বিল্বশাখায়। ষষ্ঠীতে সন্ধ্যাকালে দেবীর বোধন হয়। পূজার ষষ্ঠীতে দেবীর ষষ্ঠাদিকল্প অর্থাৎ আবাহন, বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস প্রভৃতি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। অন্যদিকে সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিমায় দেবীর অর্চনা করা হয়। সপ্তমীতে অন্যতম অনুষ্ঠান নবপত্রিকা প্রবেশ। কদলী বৃক্ষসহ আটটি উদ্ভিদ এবং জোড়াবেল একসঙ্গে বেঁধে শাড়ি পরিয়ে বধূর আকৃতির মতো তৈরি করে দেবীর পাশে বসানো হয়, একেই বলে কলাবউ। পূজার অষ্টমীতে বিশেষ অনুষ্ঠান অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিতে দেবীর বিশেষ পূজা হয় যার নাম ‘সন্ধিপূজা’।

হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুসারে দেবী দুর্গা ‘দুর্গতিনাশিনী’ বা সব দুঃখ-দুর্দশার বিনাশকারিণী। দেবী দুর্গা হলেন শক্তির রূপ, তিনি পরব্রহ্ম। অন্যান্য দেব-দেবী মানুষের মঙ্গলার্থে তাঁর বিভিন্ন রূপের প্রকাশ মাত্র। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের শরীর থেকে আগুনের মতো তেজরশ্মি একত্রিত হয়ে বিশাল এক আলোকপুঞ্জে পরিণত হয়। ওই আলোকপুঞ্জ থেকে আবির্ভূত হন এক দেবীমূর্তি। দেবী দুর্গা দিব্য অস্ত্রে সজ্জিত আদ্যশক্তি মহামায়া অসুরকুলকে একে একে বিনাশ করে স্বর্গ তথা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে শান্তি স্থাপন করেন।

আমাদের দেশে জাতীয়ভাবে এ উৎসবকে দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব হিসেবে অভিহিত করা হয়। এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে একে শরৎকালের বার্ষিক মহোৎসব হিসেবে ধরা হয় বলে একে শারদীয় উৎসবও বলা হয়। কার্তিক মাসের দ্বিতীয় দিন থেকে সপ্তম দিন পর্যন্ত এ উৎসবকে মহালয়া, ষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী, মহানবমী ও দশমী নামে পালন করা হয়। অকালে বা অসময়ে দেবীর আগমন বা জাগরণ বলে বসন্তকালের এ উৎসবকে বাসন্তী পূজা বা অকালবোধনও বলা হয়। দুর্গা যেন সব জগতের প্রতীক, দুর্গাপূজা সমাজের সব বর্ণ, শ্রেণি ও পেশা তথা সর্বস্তরের মানুষের মিলনমেলা ও উৎসব; সবার কল্যাণ ভাবনা ও প্রেরণার উৎস। মায়ের ডান পাশে রয়েছেন লক্ষ্মী ও গণেশ, বাঁ পাশে সরস্বতী ও কার্তিক। লক্ষ্মী ঐশ্বর্য ও সম্পদের, গণেশ সিদ্ধিদাতা ও গণঐক্যের, সরস্বতী জ্ঞানের, কার্তিক শৌর্যবীর্যের প্রতীক। দেবী দুর্গা জগৎরূপে আমাদের আহার্যের সংস্থান করে আমাদের রক্ষণ ও প্রতিপালিত করছেন। দুর্গা যেন সব জগতের প্রতীক। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বলা হয়েছে- তিনি আমাদের বুদ্ধিরূপে, নিদ্রারূপে, ক্ষুধারূপে, তৃষ্ণারূপে, ক্ষন্তিরূপে ইত্যাদি জীবন প্রকাশের যাবতীয় শক্তির উৎস, তাঁর অস্তিত্বেই আমরা চেতনাবান, তাঁর শক্তিতেই আমরা শক্তিমান।

দুর্গা শক্তিদায়িনী। রাজভ্রষ্ট রাজা যুধিষ্ঠির বিপদ থেকে মুক্তিলাভ করার জন্য মা দুর্গার আরাধনা করেছিলেন বলে মহাভারতের বিরাট পর্বের ২৪ অধ্যায়ে উল্লেখ আছে। ‘মা’ নাম করলেই আমরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ভাব অনুভব করি। পূজা ও উপাসনার মাধ্যমে আমরা তাঁরই শক্তিতে শক্তিমান হয়ে তাঁকেই লাভ করার চেষ্টা করি। ১০ ভুজা মায়ের ১০টি হাত ১০ দিকের প্রতীক। অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্রই ঈশ্বর বিরাজমান। মা দাঁড়িয়ে আছেন ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমায়। তা হলো- সৃজনী, পালনীত ও সংহারী শক্তির প্রতীক। অর্থাৎ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতীক। তাহলে দেখা যাচ্ছে, যিনি ব্রহ্মারূপে সৃষ্টি করেন, বিষ্ণরূপে পালন করেন শিবরূপে তিনিই বিশ্ব প্রসারিণী, মাতৃরূপিণী শ্রীশ্রীদুর্গা।

দেবী মা দুর্গা ব্রহ্মশক্তি স্বরূপিণী, তিনি বিভাসিতা মাতৃশক্তি, তিনি জগজ্জননীরূপে সর্বভূতে বিরাজমান। তিনি সব প্রাণীতে চেতনারূপে, বুদ্ধিরূপে, শক্তিরূপে, শান্তিরূপে, শ্রদ্ধারূপে, দয়ারূপে ইত্যাদি নানা রূপে বিরাজিতা। সকল প্রকার অকল্যাণের হাত থেকে তিনি আমাদের অর্থাৎ তাঁর সন্তানদের রক্ষা করেন। শাস্ত্রমতে দেবতা ও অসুরদের সংগ্রামে শরণাগত শুভবুদ্ধি ও কল্যাণকামী দেবতাদের তিনি সব সময় বরাভয় দান করেছেন।

লেখক :  একুশে পদকপ্রাপ্ত, শব্দসৈনিক স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাম্মানিক উপদেষ্টা, অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম হাসপাতাল

Email : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর