বৃহস্পতিবার, ৬ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

খুব অদ্ভুত একটা সম্পর্কের সমীকরণ

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

খুব অদ্ভুত একটা সম্পর্কের সমীকরণ

ক্ষমতা বাড়লে মানুষের অবৈধ সম্পর্ক বাড়ে। বিষয়টা অনেকটা সূত্রের মতো, তবে ধ্রুব সত্য নয়।

অবৈধ সম্পর্কের বেশির ভাগই সারা দুনিয়ার মানুষের সামনে আসে না হয়তো। অথবা মানুষ জানলেও তার বিপদ হতে পারে এ ভয়ে তা বলার সাহস করে উঠতে পারে না। মানুষ ক্ষমতাকে ভয় পায়, ক্ষমতাবান মানুষকে নয়। ক্ষমতাবান মানুষটার ক্ষমতা আজ আছে, কাল নেই; কিন্তু মানুষটা ক্ষমতার পরও থাকবে। যে দু-চারটি ঘটনা সামনে আসে সেগুলো মানুষটা ক্ষমতাবান থাকলে যতটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে, ক্ষমতা না থাকলে সে খবরের কোনো মূল্য থাকে না।

এখান থেকে একটি বিষয় খুব পরিষ্কার তা হলো, পৃথিবীর সাধারণ মানুষ মানুষের চেয়ে মানুষের ক্ষমতাকে বেশি মূল্য দেয়। অথচ ক্ষমতায় থাকলে ক্ষমতার মোহগ্রস্ত মানুষ মনে করে মানুষ তার ক্ষমতা নয়, তাকে মূল্য দিচ্ছে। ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে দেয়। যেটা মানুষকে বুঝতে দেয় না, মানুষ কখনো মানুষকে মূল্য দেয় না বরং তার শরীরে চাপানো দামি পোশাকের মতো ক্ষমতাকে প্রাধান্য দেয়। আরেকটি মিরাকল হলো, ক্ষমতা ও অবৈধ সম্পর্কের সমীকরণ কোনো ভৌগোলিক অবস্থান মেনে চলে না।

এ বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ঘটে রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে। ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগী রাজনীতিবিদরা ভোগবাদিতার রোগে আক্রান্ত হয়। তবে বিষয়টি সব রাজনীতিবিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। রাজনীতিতে ক্ষমতা পেয়ে রাজনীতিবিদরা সাধারণ মানুষের ওপর সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। অনেকে সাধারণ মানুষকে তাদের দাস ভাবতে শুরু করেন, সেবক হিসেবে নিজেদের ভাবলে ক্ষমতার শোডাউন নষ্ট হতে পারে বলে তারা মনে করেন।

রাজনীতিবিদরা সুন্দরী মহিলাদের টাকা, অর্থবিত্ত, তদবির বাণিজ্যের মতো সব ধরনের অবৈধ ক্ষমতা চর্চার সুযোগ তৈরি করে দিয়ে তাদের নিজেদের মনোরঞ্জনের দাসী বলে ভাবেন। কিন্তু ঘটনাটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উল্টোভাবে ঘটে যায়। যে রাজনীতিবিদ সাধারণ মানুষের ওপর অসীম ক্ষমতা প্রয়োগের মালিক সাজেন, তিনি নিজেই সেই তথাকথিত সুন্দরী মহিলাদের দাস হয়ে যান। কেনা দাসী বিদ্রোহ বা ব্ল্যাকমেল করলে জনগণের সামনে রাজনীতির সিংহ ভেজা বেড়ালে পরিণত হয়। এসব রাজনীতিবিদের ঘরে থাকা বিয়ে করা বউরা তাদের কাছে দামি শোপিসের মতো হয়। যাদের জীবনটা অনেক সময় জড় পদার্থের মতো হয়। আবার তাদের কেউ কেউ স্বামীর ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজের ক্ষমতা জাহির করতে চায়, সেটা অনেকটা আগাছার মতো, জলে ভাসা কচুরিপানার মতো।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে হোয়াইট হাউসের এক শিক্ষানবিশ মনিকা লিউনস্কির অবৈধ সম্পর্কের ঘটনা শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, সারা বিশ্বেই আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে পর্নো তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের অবৈধ সম্পর্কের বিষয়টি সারা পৃথিবীর মানুষের আলোচনার খোরাক হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের অবৈধ সম্পর্কের রসায়ন থেকে বেরিয়ে আসছে কোটি কোটি টাকা, সম্পত্তির দলিল, স্বর্ণমুদ্রা, বিদেশি মুদ্রাসহ আরও কত কিছু।

এমন আরও অনেক ঘটনা আছে... তা না-ই বা বললাম।

কোনোটাই রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের জন্য ভালো হয়নি, বরং রাজনীতির ভিতরে রাজনীতিবিদদের ঢুকিয়ে রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ঘটনাগুলো অতীতের রাজা, রানি, প্রজা ও নর্তকীদের জীবনকাহিনির মতো হয়েছে। যেখানে রাজারা তাদের রঙ্গলীলার জন্য প্রজাদের রক্ত ঘাম করা খাজনার টাকায় নর্তকীদের কিনেছে। রানিরা রাজার জন্য অপেক্ষার পর অপেক্ষা করেছে কিন্তু কখনো রাজার মন পায়নি। রাজপ্রাসাদের ইট-পাথরের মূল্য থাকলেও রানিদের কোনো মূল্য ছিল না। সেই রানিদের কথা ইতিহাসে নেই বরং ইতিহাসে আছে রাজাদের কথা। রানীদের কষ্টের কথা এখন যেমন চার দেয়ালে বন্দি, তখনো তেমন বন্দি ছিল। কাউকে কাউকে সারা জীবন খাঁচায় বন্দি পাখি হয়ে থাকতে হয়।

সিনেমাপাড়ার গ্ল্যামারদের সঙ্গে রাজনীতির খেলোয়াড়দের একটা সম্পর্কের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, যদিও বিষয় দুটি ভিন্ন। এদের মধ্যে একটি শিল্প আর আরেকটি কৌশল। তবে যখন দুটো ভিন্ন পথ খাদক হয়ে যা সামনে আসছে তাকেই গিলে খাচ্ছে তখন দুটোর মহৎ উদ্দেশ্যগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে।

খুব অদ্ভুত একটা বিষয় ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তিলে তিলে গড়ে ওঠা সম্পর্কগুলো কেমন যেন শিথিল হয়ে ভেঙে পড়ছে। একটা সম্পর্ক গড়ছে, আবার ভাঙছে, আবার আরেকটা গড়ছে, আবার সেটাও ভাঙছে- এর বিরাম চিহ্নটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে কেউ জানে না। অনেকটা সিরিয়াল কিলারদের মতো, থামতেই চাচ্ছে না বিচ্ছেদ। ঘটনাগুলো হিন্দি নাটকগুলোকেও হার বানাচ্ছে। সম্পর্কের এ টানাপোড়েনে সন্তানদের জীবন অস্থির হয়ে উঠছে। কেন এমনটা ঘটছে, তা সমাজবিজ্ঞানীরা বলবেন। কিন্তু সমাজে পচন ধরেছে। এ পচন মানুষের মনেও ধরেছে। মানুষের মনের পচন শরীরের পচনের চেয়েও খারাপ।

অভিনেতা সিদ্দিকুর রহমান নিজের ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে নিজের মন খারাপের কথা তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘টুটুল ভাই এবং তানিয়া আপার একটি সন্তানের নাম আরশ, আমার সন্তানের নামও আরশ কিন্তু আমি কখনো ভাবিনি আরশ নামের সন্তানদের জীবনে একই অবস্থা হবে। সত্যি আমরা মিডিয়ার মানুষরা কী করি কী করছি কী করা উচিত- এগুলো নিয়ে আরেকটু ভাবতে হবে। আসলে আমি কখনো কোনো কিছু বলতে চাইনি, এসব নিয়ে কিন্তু আজ আর পারলাম না, মনে হলো কোনো কিছু বলা উচিত আমার, কেন এমন হচ্ছে? আসলে কি আমরা অনেক খারাপ? নাকি বিধাতা আমাদের এভাবেই জীবন দিয়ে পাঠিয়েছেন। আমরা না হয় আমাদের জীবন আনন্দে কাটিয়ে গেলাম। আমাদের সন্তানরা কী দোষ করেছে? আমাদের জন্য তাদের এমন জীবন গড়তে হবে কেন? আজকে একটা নিউজ দেখে আমার মনটা অনেক খারাপ। তানিয়া আপু এবং এস আই টুটুলের বিবাহবিচ্ছেদের নিউজটি। যখন আমার চোখের সামনে নিউজটি পড়ল তখন মনে হলো কী হতে চলেছে এসব?

আমরা কি একে অন্যকে একটু স্যরি বা থ্যাংকস বলতে পারি না। আমার মনে হয় এ দুটি শব্দের কারণে শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীর অনেক সন্তানই তাদের জীবন সুন্দরভাবে গড়তে পারে না।

সর্বোপরি বলব, তানিয়া আপু এবং টুটুল ভাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘ ৩১ দিন আমেরিকায় কাটিয়েছি, দেখেছি তাদের মিল, তাদের জীবনে এমন ঘটনা ঘটবে আমি ভাবতে পারি না। আল্লাহর কাছে শুধুই প্রার্থনা- আরশ তোমরা সব সময় ভালো থেকো এবং থাকবে এটা আমার বিশ্বাস, ইনশাআল্লাহ।’

ক্ষমতার চেয়ে সাধারণ মানুষের জীবন যে অনেক আনন্দের ব্রিটিশ রাজ পরিবারের প্রিন্স হ্যারি ও তাঁর স্ত্রী মেগানের জীবনদর্শনে তার প্রভাব পড়েছে।

প্রিন্স হ্যারি ও মেগান রাজ পরিবারের ক্ষমতার বলয় থেকে স্বেচ্ছায় বের হয়ে সাধারণ মানুষের কাতারে নেমে এসেছেন। সাধারণ নাগরিকের মতো সাধারণ জীবনযাপন তাঁরা বেছে নিয়েছেন। রাজ পরিবারের অর্থের ওপর নির্ভর না করে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর জীবনকে তাঁরা প্রকৃত জীবন মনে করছেন। তাঁদের সন্তানকে নিয়ে তাঁরা সুখী জীবন গড়তে চান। ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে হ্যারি তালিকায় ষষ্ঠ, হয়তো রাজসিংহাসনে আরোহণের সুযোগও আসতে পারত। কিন্তু তাতে কী। ক্ষমতায় সুখ নেই, ক্ষমতার লোভ একটা অসুখ। একইভাবে ১৯৩৬ সালের ১০ ডিসেম্বর অষ্টম এডওয়ার্ড ক্ষমতার চেয়ে প্রেমকে মূল্য দিয়ে সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন।

সাধারণ মানুষ আশা করে, রাজনীতিবিদরা মানুষ হবেন, যাদের শরীর ও মনে কোনো আবর্জনা থাকবে না। সামনে সামনে লোক দেখানো ভালো সাজার অভিনয় আর ভিতরে ভিতরে অবৈধতা মানুষ কখনই পছন্দ করে না। রাজনীতিবিদদের বুঝতে হবে, পৃথিবীর সাধারণ মানুষ এত বোকা নয়। মানুষের ভিতরের প্রতারণা দেখার জন্য হয়তো মানুষকে বোকা সাজতে হয়। মানুষ সব দেখে, সব বোঝে, মুখ ফুটে সত্য কথাটা বলতে চায় না, তবে নিজেকে অবনত করে সত্যটা সে তার নিজের মতো করে দেখে। অনেকটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার অনুভূতির মতো-

‘আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে, হৃদয়কে অবহেলা

করে রক্ত; আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে

থাকি-তার ভিতরের কুকুরটাকে দেখব বলে। আমি আক্রোশে

হেসে উঠি না,

আমি ছারপোকার পাশে ছারপোকা হয়ে হাঁটি, মশা হয়ে উড়ি একদল মশার সঙ্গে।’

সম্পর্কের গল্পটা মানুষের গল্প হোক, প্রতিদিনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার গল্প হোক, মাটিতে মাদুর বিছিয়ে পরিবারের গল্প হোক। যেখানে তরতাজা তরুণদের স্লোগান ‘নেতাদের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র’ যেন সত্য হয়। সেটা যদি সত্য না হয়ে মিথ্যা হয় তবে নেতারা আর তাদের সঙ্গে তরুণদের কখনো পাবেন না। সাধারণ মানুষকেও পাবেন না। মানুষ একবার মুখ ফিরিয়ে নিলে সে মুখ আবার ফিরে পাওয়াটা খুব কঠিন, অনেক সময় অসম্ভব। কারণ আজ যে রাজা কাল সে ভিখারি। কার কপালে কী আছে তা আগে থেকে কেউ বলতে পারে না।

            লেখক : শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

সর্বশেষ খবর