বৃহস্পতিবার, ৩ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

জেলখানায় জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড

ওয়ালিউর রহমান

জেলখানায় জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড

মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম পরিচালক, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর একান্ত ঘনিষ্ঠ সহচর জাতীয় চার নেতা সাবেক উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে অবর্তমানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ১৯৭১-এ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য অপরিসীম ভূমিকা রেখেছেন।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল, ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায় রচিত হয়। নরপিশাচরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক ক্ষমতা দখল করে। ১৫ আগস্ট থেকে অভ্যুত্থানকারী রশিদ-ফারুক ও তার কিছু সহযোগী অবস্থান নেয় বঙ্গভবনে। মোশতাক ও তার সরকারের ওপর ছিল তাদের যথেষ্ট প্রভাব। এ ব্যাপারে সেনাবাহিনীর একাংশ কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। এ প্রেক্ষাপটে ২ নভেম্বর মধ্যরাতে (ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী তখন ৩ নভেম্বর) জিয়াউর রহমানের প্ররোচনায় মোশতাকের নেতৃত্বাধীন আধা-সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ। এ অভ্যুত্থানকালেই মোশতাক-রশিদ-ফারুক ও জিয়াউর রহমানের প্রেরিত ঘাতক দল জেলখানায় হত্যা করে জাতীয় চার নেতাকে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির উদ্দেশ্যই ছিল আওয়ামী লীগের এ শীর্ষস্থানীয় চার নেতাকে হত্যার মাধ্যমে দেশকে নেতৃত্বশূন্য করা। তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিল এ নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশে স্বাধীনতা অর্জন এবং স্বাধীনতা-উত্তর দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সহযোগী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। নবগঠিত এ সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় তাঁর অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।

তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের একজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাজনীতিতে বিশ্বাসী তাজউদ্দীন আহমদ গণতন্ত্র ও বাঙালি জাতির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার বা মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে তিনি এ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন এবং মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করেন। মুক্তিবাহিনীর জন্য অস্ত্র সংগ্রহ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।

মুজিবনগর সরকার গঠন এবং যুদ্ধ পরিচালনায় এ এইচ এম কামারুজ্জামানের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। মনসুর আলী ১৯৭১ সালে মুজিবনগরে গঠিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রীর এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন।

আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করে দেওয়ার জন্য কারা অভ্যন্তরে আমাদের জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সারির চারজন সংগঠককে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। কারাগারের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় এমন জঘন্য, নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ইতিহাসের এ নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় শুধু বাংলাদেশের মানুষই নয়, স্তম্ভিত হয়েছিল সমগ্র বিশ্ব।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠার পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করেন। এরপরই বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমি বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিভিন্ন দেশ থেকে ধরে আনার জন্য গঠিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টাস্কফোর্সের সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ শুরু করি। আর তখন টাস্কফোর্সের কাজ তিনটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে করা হতো। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়। এ তিনটি সমন্বয় করে প্রতিবেদন পেশ করা আমাদের দায়িত্ব ছিল। তখন এ দায়িত্ব প্রাপ্তিকে আমার চাকরি জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অধ্যায় হিসেবে গণ্য করেছিলাম।

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেলহত্যা মামলার প্রক্রিয়ার কাজও শুরু করেন। এর দুই বছর পর মামলার কিছু জটিলতা কাটিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটির রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে ২০ আসামির মধ্যে  তিনজন পলাতক সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড, ১২ জন সেনা কর্মকর্তাকে যাবজ্জীবন এবং অপর পাঁচজনকে খালাস দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- দফাদার মারফত আলী শাহ, রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ওরফে হিরন খান ও এলডি দফাদার মো. আবুল হাসেম। যাবজ্জীবন দণ্ডিত ১২ আসামি হলেন- লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও মেজর (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশিদ, লে. কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম, কর্নেল (অব.) এম বি নূর চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী, মেজর (অব.) আহম্মদ শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, ক্যাপ্টেন (অব.) কিশমত হাশেম,  ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার।

লেখক : ফরগোটেন ওয়ার, ফরগোটেন জেনোসাইড।

সর্বশেষ খবর