বুধবার, ৯ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

শেখ হাসিনার বার্তা বুঝতে পারছেন না মন্ত্রীরা

অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী

শেখ হাসিনার বার্তা বুঝতে পারছেন না মন্ত্রীরা

বর্তমানে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা পড়লে দেখা যায় বিভিন্ন মন্ত্রী এবং নেতানেত্রীর অনেকে দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার দর্শন ঠিকমতো বোঝেন না। বুঝতে না পারার ফলে জনসমক্ষে একজন মন্ত্রী বা উপদেষ্টা হিসেবে কী বলতে হবে অথবা দলের একজন নেতা হিসেবে কী বার্তা তাদের দিতে হবে নেত্রীর পক্ষ থেকে, সেটা তারা সঠিকভাবে দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই যারা জনগণের সেবক হিসেবে থাকেন, জনগণ এদের জনগণের সেবক হিসেবেই ভাবেন। তিনি দলীয় পর্যায়ের নেতা হোন অথবা রাষ্ট্রীয় কোনো দায়িত্বেই থাকুন না কেন। যারা রাজনীতিতে থেকে রাজনৈতিক কারণে এসব পদের অধিকারী তাদের জনগণ আয়নার সামনে ফেলবে, এটাই স্বাভাবিক। দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক যেহেতু খুব পরিষ্কারভাবে বারবার বলছেন এবং সেটা উনি প্রতিফলন করে দেখাচ্ছেন। দুটো বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি হচ্ছে- তাঁর সহকর্মীদের বলছেন যে, কী কী কাজ এ সরকার করেছে সেগুলো যারা সরকারে আছে তারা এবং যারা দলে আছে তারা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে। আরেকটির গুরুত্ব একই রকম। আমি বলব একই মাপের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তিনি অবতারণা করেছেন। সেটাও বেশ কঠিনভাবে। বিরোধী দলকে শক্তিশালী হতে হবে। সরকারি দলের যে-কোনো কাজকর্ম যদি বিরোধী দল মনে করে সঠিক হচ্ছে না তার বিরুদ্ধে তারা কথা বলবে, বিরোধিতা করবে। দরকার হলে প্রধানমন্ত্রীর অফিস ঘেরাও করবে এবং তিনি তাদের চা খাওয়াবেন। এখন এ কথার দর্শন উনারা কী বুঝেছেন আমি জানি না।

শেখ হাসিনা যিনি একজন দার্শনিক, শুধু রাষ্ট্রনায়ক নন, তার প্রমাণ দিয়েছেন নানা বক্তব্যে, নানা কর্মকাণ্ডে। উনি বলার পরই যারা এত দিন ঘরে বসে ছিলেন তারা এখন রাস্তায় বের হচ্ছেন। নেতারা রাস্তায় বের হওয়ার ফলে কর্মীরাও রাস্তায় বের হচ্ছেন। আর অনেক নিরপেক্ষ লোক যাদের সংখ্যা কিন্তু কম নয়, তারা রাস্তায় গিয়ে বিরোধী দল কী বলছে, তাদের নেতারা কী বলছেন, তারা কী করতে চায় এটা শোনার জন্য আসছে। কারণ, রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন তাদের কাছে তো আশাই করেন যে তারা দেশের জন্য ভালো ভালো কাজ করবেন। কিন্তু তারা কোথায় কোথায় ঠিকমতো করছেন না এটা বিরোধী দল বলবে। তারা কী বলে এটা শোনার খুব আগ্রহ মানুষের আছে। এ আগ্রহের কারণেই কিন্তু বিরোধী সমাবেশে লোকজন হচ্ছে এর অর্ধেক কিন্তু উৎসুক মানুষ। আমাদের দেশে হঠাৎ আগুন লাগলে নেভানোর চেষ্টা করে না, আগুন দেখতে যায়। আজকাল আবার ফটো তুলে ফেসবুকে দিয়ে দেয়। কেউ রাস্তায় পড়ে থাকলে তার ফটো তোলা নিয়ে যত অস্থির হয় বা একজন সুইসাইড করতে গেলে তার সেই ফটো তুলতে যত আগ্রহ প্রকাশ করে তারা- তাকে বাঁচানোর জন্য ততটা চেষ্টা করে না। অন্য দেশে কিন্তু তা এতটা নয়। যা হোক, যারা বিভিন্ন দায়িত্বে থাকেন, তারা যত দিন এসব দায়িত্বে আছেন তাদের বিরুদ্ধে যেসব বক্তব্য আছে সেগুলোয় তাদের খুব ভালোভাবে নজর দিতে হবে এবং যদি নিজস্ব কোনো গাফিলতি থাকে সেই গাফিলতি তিনি ঠিক করার চেষ্টা চালাবেন। কারণ একমাত্র শয়তানের কোনো ভুল হয় না, যে-কারও ভুল হতেই পারে। কারণ একটা বিষয় মনে রাখতে হবে নেত্রী যেটা মুখে বলেন, তিনি সেটা ধারণ করেন। আমি তো পাঁচ বছর উপদেষ্টা হিসেবে ছিলাম, আমি দেখেছি। আমার বিরুদ্ধে একসময় খুব লেখা হতো। তিনি বলতেন আমি পত্রিকা দেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না এবং পত্রিকা দেখে দেশ চালাই না বা কাউকে মূল্যায়ন করি না। তাঁর বক্তৃতা আমরা তাঁর কাজে প্রতিফলিত হতে দেখি। দেখা যায় যার সম্পর্কে বেশি বলা হয় তার মন্ত্রিত্ব বা তার পদ কিন্তু যায় না। আমার মতে দার্শনিক রাষ্ট্রনায়কের দর্শন এতই শক্তিশালী যে, কোনো লোককে দিয়ে তিনি যে-কোনো কাজ করাতে সক্ষম।

একজন সাধারণ লোক হিসেবে আমার চিন্তা হয় যে, ৬২ বছর ধরে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে আমি জানি। আমি সব সময় মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, যত ঝড়ঝাপটা আসুক না কেন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের খোদা না করুন যে-কোনো আপদ-বিপদে বুক পেতে দিতে আমি কখনো সামান্যতম পিছপা হব না, মাথা উঁচু করে রাখব। এখন যত দিন যাচ্ছে ততই আমার আরও বিশ্বাস বেড়ে যাচ্ছে। যখন নেত্রীর সঙ্গে আলাপ হয় তখন উনি যেসব বক্তব্য দেন তখন আরও নিজের জোর বেড়ে যায়। আর আমার একটা উপরি পাওনা আছে। আমাকে উনি মোদাচ্ছের ভাই বলেন। সুতরাং একমাত্র আমি যদি খুনি মোশতাকে রূপান্তরিত না হই তাহলে তো তাদের বিপদাপদে আমি পাশে দাঁড়াব এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। এটা এমন কোনো কিছু বিশেষ কাজ না। এটা আমার স্বাভাবিক দায়িত্বের ভিতরে পড়ে। অন্যের হয়তো এটা তাদের রাজনৈতিক বা দলীয় দায়িত্ব হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে সেই দায়িত্ব না। আমার দায়িত্ব হচ্ছে তিনি মোদাচ্ছের ভাই বলেন সেজন্য দায়িত্ব পালন করব।

এখন দেশ এবং দল চালাতে গেলে দার্শনিক শেখ হাসিনার দর্শন ভালো করে বুঝতে হবে। যারা বোঝেন না তারা কিন্তু তাকে কোনো সাহায্য করতে পারবেন না। অনেকে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে বলেন যে তাদের জন্যই আমলারা এত ক্ষমতা পাচ্ছে। আবার অনেকে আমলাদের বিষয়ে বলেন যে তারা সবকিছু নেত্রীকে ভুল বোঝাচ্ছেন এবং বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়াচ্ছেন। আমার মতে এগুলো সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। শেখ হাসিনাকে কেউ কিছু বলল, পত্রিকায় কিছু লিখল বা টকশোয় কেউ কিছু বলল তাতেই তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন তাহলে তিনি দার্শনিক কেন? তাঁর যে দর্শনের মূল ভিত্তি তা তো তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পেয়েছেন। তাঁর মাতার কাছ থেকে পেয়েছেন। আর এ কারণে তিনি সফলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন এবং দেশ এখন সফল। এখন ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি নড়বড়ে। আমাদের দেশে দার্শনিক যাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁরা সেভাবে নেত্রীর দর্শন বুঝতে পারেননি। সে কারণে আমাদের ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু এটা এমন পর্যায়ে না যে, দার্শনিক শেখ হাসিনা এটাকে আবার সঠিক পথে আনতে পারবেন না। এটা সঠিক পথেই আসবে এবং বিশ্বের সব দেশে যদি মন্দার প্রভাব পড়ে তাতে আমরা এর বাইরে থাকব এটা তো আশা করা ঠিক না। কিন্তু এটা ঠিক যে, আমাদের ওপর পরে প্রভাব পড়বে। কারণ উনি প্রথম বিষয়টি বুঝে ফেলেছেন। কী বুঝেছেন, খাবারের দিকে জোর দিচ্ছেন। আমাদের লোকদের তো খাওয়া-দাওয়া, চাওয়া-পাওয়া খুব কম। আমাদের দেশের লোক কিছু ভাত আর লবণ, সঙ্গে বড় একটা কাঁচা মরিচ বা একটা পিঁয়াজ, প্রয়োজনে শুধু ভাত আর লবণ দিয়ে অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারে। কারণ যেহেতু আমাদের জনগণের চাহিদা কম। দার্শনিক শেখ হাসিনা ঠিক নজর দিয়েছেন, কোন কোন সেক্টর আমাদের ভঙ্গুর হতে পারে যুদ্ধের ফলে। সেগুলোয় তিনি আগেই পদক্ষেপ নিচ্ছেন।

আমার মতে, দুটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি হচ্ছে দার্শনিকের দর্শন বোঝা এবং তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত থাকা। আর সঙ্গে সাহস থাকত হবে। আমার স্পষ্ট মনে আছে একবার তিনি দলের জাতীয় কাউন্সিলে বলেছিলেন যে, দলের নেতৃত্ব দিতে হলে কঠিন সময়ে সাহসের প্রয়োজন। দলের কঠিন সময়ে যাদের সাহসের অভাব আছে তাদের নেতৃত্ব নেওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই এবং তাদের নেতৃত্বে আসা উচিত নয়। আমি মনে করি নেত্রীর যদি সমস্ত বক্তৃতা কিছু কিছু করেও মনে রাখা যায় তাহলে দেখা যায় প্রতিটি কথা তিনি কিন্তু আগেই বলেছেন। সুতরাং আমি মনে করি, নেত্রীর যারা কর্মী, যারা মন্ত্রী-উপদেষ্টা আছেন তাদের অবশ্যই সাহসী হতে হবে। তাদের প্রতিটি কথা হিসাব করে বলতে হবে এবং জনগণকে আশার বাণী শোনাতে হবে। তারা যদি নিরাশার কথা শোনান তার মানে তারাই নিরাশ। আরেকটি বিষয় দেখা যায়, যখন দল ক্ষমতায় থাকে তখন অনেকেই খুব বড় বড় কথা বলে, বড় বড় বক্তব্য দেয়। এক্কেবারে প্রয়োজনে নেত্রীর জন্য জীবন দেয়। একটা স্লোগান আমার খুব হাসি লাগে সেটি হলো ‘নেত্রী তুমি এগিয়ে চলো আমরা আছি তোমার পিছে’ অর্থাৎ তুমি বিপদে পড়লে তুমি যাবা, আমরা পেছন থেকে পালিয়ে যাব। বলা উচিত ‘নেত্রী তুমি এগিয়ে চলো আমরা আছি তোমার সঙ্গে’। সঙ্গে থাকতে হবে। তাঁর হাত ধরে থাকতে হবে। যে-কোনো বিপদাপদ এলে সঙ্গে থাকতে হবে। ২১ আগস্ট কোনো কোনো নেতা তা করে  দেখিয়েছেন। তাঁরা তাঁদের বুক এগিয়ে দিয়েছেন। তাঁরাই হচ্ছেন আসল নেতা। সেটি যদি না হয় তাহলে তো লাভ নেই।

একজন আমলা যদি দার্শনিকের দর্শন বোঝেন এবং সঙ্গে এক শ ভাগ দার্শনিকের প্রতি আনুগত্য থাকেন এবং তার দায়িত্ব ঠিকঠাকমতো পালন করেন তাহলে একজন যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর চেয়ে আমি ওই আমলাকে কেন অবমূল্যায়ন করব বা তাকে কেন শ্রদ্ধা করব না? তার কাজের জন্য শ্রদ্ধা করব। সে হয়তো আমার সন্তানতুল্য হতে পারে। তার গুরুত্ব কম হতে পারে না। কাজের তো কোনো ছোট-বড় নেই। একজন স্কুল টিচারও পারেন, একজন ইউএনও পারেন, একজন সামান্য কর্মীও পারেন। মুশকিল হচ্ছে কিছু লোক সরকারের মধ্যে, এমনকি দলের ভিতরে আছে যারা সত্যিকার অর্থে রাজনীতি করতে আসেননি। আর এ কারণে তারা দর্শনও বুঝতে সক্ষম হন না। জনগণকে কখন কী বলতে হবে সেটা তারা বুঝতে পারেন না। সব জাতিরই কঠিন সময় আসে। আমাদেরও এসেছে। সমস্ত বিশ্বের সঙ্গে আমরা একটা কঠিন সময় পার করছি। নেত্রীর কথাগুলোই তো বললে হয়। উনি জাতিকে এ টু জেড একদম সঠিক যে অবস্থা সেটা বলেন। পাশাপাশি তিনি সমস্যার সমাধান কী হবে সেটাও বলে দেন। যিনি দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক তিনি তো দর্শন দিয়ে চালান। কোনো কাজ খুব সহজে হয়ে যায় আবার কোনো কাজে একটু সময় লাগে। এটাই নিয়ম এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আমরা যখন এরকম একজন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক পেয়েছি তখন আমাদের কেন ভুল হবে। তখন আমরা কেন বুঝতে পারব না যে উনি যা বলছেন আমরা তো তার বিপরীত কিছু বলতে পারি না। একজন নেতা বলে বসলেন, বিএনপি যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে এক রাতে লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে। বিএনপি রাতারাতি এত ক্ষমতাবান হয়ে গেল যে, এক রাতে তারা লাখ লাখ মানুষ মেরে ফেলবে! এ বাণী দিয়ে তিনি কর্মীদের কী বোঝাতে চেয়েছেন তা তো বোধগম্য নয়। এরা আসলে নেত্রীর দর্শন বোঝেন না। এদের একটু লেখাপড়া করার দরকার আছে। অন্ততপক্ষে দু-তিনটি বই পড়লে যেমন বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, তাঁর কারাগারের রোজনামচা এগুলো পড়লেও পারে। এগুলো মাঝেমধ্যে পড়তে হবে। একবার পড়ে সাজিয়ে রাখলে হবে না। বারবার পড়তে হবে, অনুধাবন করতে হবে, তার পরে নিজের কাজ ঠিকভাবে করতে হবে। তাহলে এত দিন যে রকম দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার সরকার অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে টিকে ছিল সে রকম আগামীতেও থাকবে। এতে কোনো সামান্যতম সন্দেহ নেই।

লেখক : সাবেক উপদেষ্টা, চেয়ারম্যান, বিএমআরসি

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর