শনিবার, ১২ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

সবজান্তাদের এই দেশে

সৈয়দ বোরহান কবীর

সবজান্তাদের এই দেশে

ইরানের বিখ্যাত গণিতজ্ঞ আল বেরুনি দশম শতাব্দীর শেষ দিকে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। অনেক বছর তিনি এই অঞ্চলে ছিলেন। এ নিয়ে আল বেরুনি একটি চমৎকার বই লিখেছেন, যার নাম ‘তারিখ-ই-হিন্দ’। এই বইতে তিনি লিখেছেন ‘ভারতীয় গণিত খুবই ভালো, কিন্তু এ দেশের মননজীবীরা অন্য একটি ব্যাপারে বিলক্ষণ গুণী, সেটি হলো, যে বিষয়ে কিছুই জানা নেই, তা নিয়ে অনর্গল বলে যাওয়ার ক্ষমতা।’ আল বেরুনি এই উপমহাদেশের মানুষ সম্পর্কে যে কী অসাধারণ সত্য বলেছিলেন তা এখন বাংলাদেশের চারপাশে তাকালেই অনুভব করা যায়। সম্প্রতি একজন কৃষিবিজ্ঞানীর এক গবেষণা নিয়ে দেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে আলোচনা হলো। এ আলোচনায় একজন উপস্থাপক এবং দুই আলোচক ওই বিজ্ঞানীকে রীতিমতো অপদস্থ করলেন। অথচ এদের তিনজনই কেউ গবেষণাপত্রটি ভালোভাবে পড়েননি। তিনজন মিলে উদ্ভট, হাস্যকর এবং অবান্তর প্রশ্ন করে আল বেরুনির বক্তব্যকেই যেন সত্য প্রমাণ করলেন। এই টকশো দেখতে দেখতে বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে অদ্ভুত মিল খুঁজে পেলাম। এই টকশোটাই যেন একখণ্ড বাংলাদেশ। এ দেশে কিছু মানুষ কোনো বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও অনর্গল বকে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ নিয়ে রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ এবং কিছু গণমাধ্যম এখন ওই টকশোর মতোই সরকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ওই কৃষিবিজ্ঞানী যেন বাংলাদেশ সরকার। সরকারকে নাস্তানাবুদ করাই যেন টকশোর তিন ব্যক্তির মতো, তিন পক্ষের প্রধান লক্ষ্য।

আইনজীবী থেকে হয়েছেন পরিবেশবিদ। সেখান থেকে তিনি মুহূর্তেই হয়ে গেলেন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ। ইদানীং লক্ষ্য করলাম, ওই সবজান্তা ঝানু অর্থনীতিবিদও হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন। টকশোতে যেমন বেগুনবিষয়ক গবেষণাপত্রটি না পড়েই একজন আলোচক বলছিলেন ‘উনি (গবেষক) তো ফৌজদারি অপরাধ করে ফেলেছেন।’ তেমনি ওই আইনজীবী ওরফে পরিবেশবিদ ওরফে মানবাধিকার কর্মী ওরফে অর্থনীতিবিদ, আইএমএফের কাছে ঋণ চাওয়াটা যেন গুরুতর অপরাধ হিসেবেই দেখছেন। তিনি অবলীলায় বলছিলেন, ‘অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে। আইসিইউতে চলে গেছে। এখন আইএমএফের কাছে ঋণ নিয়ে সরকার কৃত্রিমভাবে বাঁচার চেষ্টা করছে।’ কী সাংঘাতিক কথা। আসলে কি তাই? গত বুধবার (৯ নভেম্বর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ সহায়তা দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, ‘বাংলাদেশকে ঋণ সহায়তা করার বিষয়ে সংস্থাটির সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারের সমঝোতা হয়েছে।’ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বর্ধিত ঋণ সুবিধা (ইসিএফ) ও বর্ধিত তহবিল সুবিধার (ইএফএফ) আওতায় ৩২০ কোটি ডলার আর রেজিলিয়েন্স সাসটেইনেবিলিটির (আরএসএফ) আওতায় ১৩০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়া হবে। ৪২ মাসের মেয়াদে এই ঋণ দেওয়া হবে।’ আইএমএফের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার এবং বিভিন্ন ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টিকারী উপাদান ঠেকাতে নতুন এই ঋণ দেওয়ার বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে।’ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘মহামারি কাটিয়ে উঠে বাংলাদেশ জোর কদমে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ব্যাহত হয়।’ অর্থাৎ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের প্রধান কারণ হিসেবে যা বলা হচ্ছিল, আইএমএফও সেই একই কথা বলছে। বাংলাদেশ দেউলিয়াও হয়নি। শোচনীয় পরিস্থিতির মধ্যেও পড়েনি। বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে কিছুটা সমস্যায় পড়েছে। সারা বিশ্বই এখন সংকটে। বাংলাদেশের এই সংকটকে তিন শ্রেণির গোষ্ঠী ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে এখন যেন দেশের প্রায় সবাই ঝানু অর্থনীতিবিদ। সবজান্তাদের অনর্গল কথা বলা শুরু হয় অবশ্য আরও আগে থেকে। শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময় থেকেই। সে সময় একজন সম্মানীয় সুশীল কথক অর্থনীতিবিদ জরুরি ভিত্তিতে গণমাধ্যমের সামনে অর্থনৈতিক ঝড়ের বুলেটিন পাঠ শুরু করলেন। তার কথাবার্তা, বাচনিক ভঙ্গিতে মনে হলো আগামীকালই বোধহয় বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার সংকটের ছয় মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেছে বাংলাদেশের সংকট শ্রীলঙ্কার ধারেকাছেও নয়। আইএমএফও বলেছে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কা কিংবা পাকিস্তানের চেয়ে অনেক ভালো। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের বাজারে অস্থিরতা শুরু হতেই বাংলাদেশে লোডশেডিং শুরু হয়। সরকার নানা রকম কৃচ্ছ্রতা সাধনের পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। এসব উদ্যোগই যে সঠিক ছিল এমনটি নয়। কিন্তু সরকার চেষ্টা করেছে। এ সময় দেশে একযোগে কিছু মানুষ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলেন। আইনজীবী, নির্বাচন পর্যবেক্ষক সুশীল, অর্থনীতিবিদ কে না? বিদ্যুৎ খাতে কী কী ভুল তার ফিরিস্তি শুনতে শুনতে সাধারণ মানুষ ক্লান্ত হয়ে গেল। এ কথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই যে, বাংলাদেশে জ্বালানি খাতে বেশ কজন আন্তর্জাতিক মানের বিশেষজ্ঞ আছেন। তারা যেমন সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংক্রান্ত কিছু সিদ্ধান্তের যৌক্তিক সমালোচনা করেছেন, তেমনি সরকারের কী করা উচিত তাও বলেছেন। কিন্তু অচিরেই সত্যিকারের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা আড়ালে চলে গেলেন। সর্ববিষয়ে মহাজ্ঞানীরা হয়ে উঠলেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। তারা এমন সব উদ্ভট কথাবার্তা বলা শুরু করলেন যে সাধারণ মানুষের দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। একজন সুশীল দেখলাম বলছেন, ‘আসলে দেশে বিদ্যুৎ খাতে গত ১৩-১৪ বছরে কোনো উন্নতি হয়নি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আমরা পিছিয়ে গেছি।’ এ কথা শুনে তো আমার মতো অনেকের ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। ২০০৮ সালে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন কত ছিল? কত মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ ছিল? এই ন্যূনতম তথ্য না জেনে তিনি এসব কথা বললেন এবং দেশের স্বনামধন্য গণমাধ্যমগুলোও তা ফলাও করে প্রচার করল। এখন যখন লোডশেডিং কমে এসেছে তখন তারা গভীর মনোনিবেশ করলেন আইএমএফের ঋণ সহায়তা নিয়ে। এখন আইএমএফও ঋণ দিতে রাজি হলো। শিগগিরই নতুন বিষয় নিয়ে চিরচেনা বুদ্ধিজীবীরা নিশ্চয়ই অনর্গল কথা বলা শুরু করবেন।

দেশের সুশীল সফেদরা যখন অনেকটাই গায়ের জোরে তর্ক করেন তখন রাজনীতিবিদরা কি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবেন? বেগুনবিষয়ক টকশোর দ্বিতীয় আলোচকের মতো হলেন আমাদের রাজনীতিবিদরা। এদের মধ্যে দীর্ঘদিন স্বেচ্ছায় অফিসবন্দি থাকা এক বিএনপি নেতাকে আমার ভীষণ পছন্দ। তিনি আবার যাত্রাপালার বিবেকের ঢঙে কথা বলেন। এক বক্তৃতায় তিনি বলছিলেন, ‘সরকার রিজার্ভের টাকা লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার করেছে। রাষ্ট্রীয় কোষাগার উজাড় করে দিয়েছে।’ একজন বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছায়ামন্ত্রী। রাষ্ট্র, সরকার, রাষ্ট্রীয় কোষাগার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইত্যাদি সম্পর্কে তার ন্যূনতম জ্ঞান থাকাটা বাঞ্ছনীয়। রিজার্ভের টাকা লুণ্ঠন হয় না। এই টাকা পাচার করাও সম্ভব নয়। বাংলাদেশে একবার রিজার্ভের টাকা হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরি হয়েছিল। এ নিয়ে গোটা দেশে তোলপাড় হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর পদত্যাগ করেছিলেন। তাই রাষ্ট্রের রিজার্ভ সম্পর্কে কিছু না জেনে এভাবে খোলা বক্তৃতা দেওয়া কি একজন পোড় খাওয়া, ত্যাগী রাজনীতিবিদের জন্য শোভন? এই নেতার চেয়েও বড় নেতা বলেছেন আরও ভয়ংকর কথাবার্তা। কদিন আগে তখন বিএনপির সক্রিয় প্রধান এই নেতা বললেন, ‘সরকার লুটপাট করে এখন দেশে দুর্ভিক্ষের কথা বলছে।’ এই সরকার দুর্ভিক্ষের কথা বলার আগেই জাতিসংঘ এবং বিশ্বব্যাংক দুর্ভিক্ষের আগাম বার্তা দিয়েছে। জাতিসংঘ ২০২৩ সালকে সংকটের বছর হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে আগামী বছর (২০২৩) বিশ্বব্যাপী চরম খাদ্য সংকট দেখা দেবে।’ এর আলামত ইতোমধ্যে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়ে গেছে। যুক্তরাজ্যে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। মানুষ এখন প্রয়োজনীয় খাদ্য কিনতে পারছে না। পুরো ইউরোপে হাহাকার। এই শীতে ইউরোপে ভয়াবহ পরিস্থিতির পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবর্তী নির্বাচন হয়ে গেল। অর্থনৈতিক মন্দা, মুদ্রাস্ফীতির মতো ইস্যুতেই এই নির্বাচনে ব্যাকফুটে চলে গেলেন জো বাইডেন। আফ্রিকায়  ইতোমধ্যে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে এই অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী আগাম সতর্কবার্তা ঘোষণা করেছেন। তিনি বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হবে এমন কথা কোথাও বলেননি। তিনি বলেছেন, ‘বিশ্বজুড়ে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে এ জন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা এবং দূরদর্শিতার কারণে আসন্ন সংকট মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। এগুলো হলো, ১. খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। যেন আমরা নিজেরাই আমাদের চাহিদা মেটাতে পারি। ২. এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। ৩. অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস ও কৃচ্ছ্রতা সাধন। ৪. দুর্নীতি বন্ধ করা। ৫. সবার দায়িত্বশীল আচরণ। সরকারের কৌশল খুব স্পষ্ট। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আগাম এরকম পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানানো দরকার। অথচ ওই বেগুনবিষয়ক টকশোতে যেভাবে বেচারা কৃষিবিজ্ঞানীকে চেপে ধরা হয়েছিল, এই গবেষণা করলেন কেন? এই গবেষণা প্রকাশ করলেন কেন? কেন বেগুন নিয়ে গবেষণা করলেন, ঝিঙ্গা নিয়ে নয় কেন? ঠিক সে রকম, প্রধানমন্ত্রী বারবার দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন কেন? তাহলে সরকার কী করল? বিএনপি এখন এই ইস্যুতে সরকারকে নাস্তানাবুদ করতে চাইছে। সেটাতেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ন্যূনতম তথ্য-উপাত্ত না জেনে যেভাবে অনর্গল বিরোধী নেতারা সংকটের কথা বলছেন, তা যদি আল বেরুনি দেখতেন তাহলে যে কী লিখতেন, তা অনুমান করলে চমকিত হই বটে।

সুশীল সমাজ এবং রাজনীতিবিদরা যখন আসল তথ্য না জেনেই, প্রকৃত বিষয়ে খোঁজখবর না নিয়েই কথা বলছেন, তখন সেই সব কথাবার্তায় বাতাস দিচ্ছে দেশের প্রভাবশালী কিছু গণমাধ্যম। যে কোনো মূল্যে দেশের সংকটকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোই যেন এখন কিছু গণমাধ্যমের মহান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। টকশোর উপস্থাপক যেমন নিজেই একটি পক্ষ হয়ে গিয়েছিলেন। ভাবখানা এমন, পারলে এখনই দু’ঘা বসিয়ে দিতেন কৃষিবিজ্ঞানীকে। এখন গণমাধ্যম ‘সংকট গভীর ও দীর্ঘ হচ্ছে’ ‘উৎপাদন কমেছে, বিক্রিতে মন্দা’, ইত্যাদি নানা ভয়ার্ত হেডলাইন করে জনগণকে উদ্বিগ্ন করে তুলতে ব্যস্ত। জনগণ উদ্বিগ্ন না হলে কীসের সাংবাদিকতা! অথচ এসব গণমাধ্যমের খবরগুলো ভালো করে কেউ যদি বিশ্লেষণ করে তাহলে দেখা যাবে কী ভয়াবহ তথ্যের হেরফের। একটি গণমাধ্যম সংবাদ পরিবেশন করল ‘চাল উৎপাদনে ইন্দোনেশিয়াকে পিছনে ফেলে বাংলাদেশ তৃতীয়।’ এর পাল্টা হিসেবে প্রভাবশালী দৈনিকের খবর চালেও ঘাটতি। আবার গম সংকট মেটাতে বাংলাদেশ যে ইউক্রেন থেকে গম আনতে সক্ষম হয়েছে, সে খরচ চেপে গেছে অথবা অনিচ্ছায়-অযত্নে ছেপেছে কোনো কোনো গণমাধ্যম। এভাবেই না জানা সবজান্তার হাতে সংকট এখন গভীর হয়েছে। মানুষের উদ্বেগ-আতঙ্ক বাড়ছে।

অবশ্য এই তিন শ্রেণিই যে কেবল সবজান্তা এমনটি নয়। বাংলাদেশের আমলারা অনাধিকাল থেকেই সবজান্তা। ইসলামের ইতিহাসে পাস করা আমলা চিকিৎসকদের পদোন্নতি দেন। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞকে প্যাদানি দিয়ে ডাক্তারি শেখান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পাস করে মাছ ও প্রাণিসম্পদের দেখভালের দায়িত্ব পালন করেন। কৃষিবিদ আমলারা শিক্ষার ভাগ্যবিধাতা হয়ে ওঠেন। ২০২০ সালে করোনার সময় থেকে ‘সবজান্তা’ আমলারা সর্ববিষয়ে ‘পণ্ডিতে’ পরিণত হয়েছেন। আল বেরুনি বেঁচে থাকলে দেখতেন, কিছু না জেনে অনর্গল কথা বলাকে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে, আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে। এই আমলারা অর্থনীতি, বৈশ্বিক সংকট, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি সবক্ষেত্রে জাতির ভাগ্যবিধাতায় পরিণত হয়েছেন। তাদের জ্ঞানের পরিধি এখন এত ব্যাপক বিস্তৃত যে, তাদের অবসরের ফুরসত নেই। কদিন আগে এক মহাগুরুত্বপূর্ণ আমলা অবসরে গেলেন। অবসরে যাওয়ার আগের দিন তিনি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য হয়ে গেলেন। আমাদের আমলারা এতটাই সবজান্তা অবসরের আগেই বিভিন্ন সাংবিধানিক এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের গুরুদায়িত্ব তাদের কাঁধে তুলে দেওয়া হয়। ব্যাংক খাতের পুরোটাই এখন আমলা নিয়ন্ত্রিত। শাহেদ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে এক আমলার পদোন্নতি হয়েছিল মনে আছে? সচিব থেকে তিনি সিনিয়র সচিব হয়েছিলেন। এখন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বীমার চেয়ারম্যান হয়েছেন। কী চমৎকার। আমলাদের মাধ্যমেই বাংলাদেশ এখন সবজান্তাদের দেশ হিসেবে পূর্ণতা পেয়েছে।

আমলাদের বাড়বাড়ন্ত দেখে মন্ত্রীদের তো খানিকটা হিংসা হবেই। এ জন্য ইদানীং মন্ত্রীরাও সবজান্তা হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ডলার সংকটে অস্থির দেশ। জরুরি এলসি খুলতে পারছে না ব্যাংকগুলো। আইএমএফের সর্বশেষ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের হিসাব মেনে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের পরিমাণ পুনর্নির্ধারণ করেছে। সর্বশেষ হালনাগাদ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৬ বিলিয়নে এসে দাঁড়িয়েছে। ডলার সংকটের মুখে গত বুধবার অর্থ বিভাগ এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকারি টাকায় সব ধরনের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যেই সবজান্তা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এক মন্ত্রী ঘোষণা করলেন, ‘দেশে ডলারের কোনো সংকট নেই। আগের চেয়ে যথেষ্ট ডলার মজুদ রয়েছে।’ আওয়ামী লীগের আরেক হেভিওয়েট মন্ত্রী ‘খেলা হবে’, ‘খেলা হবে’ বলে চিৎকার করে নিজেই খেলো হয়ে গেছেন। যে কোনো বিষয়ে অবলীলায় তিনি কথা বলছেন প্রতিদিন। সবজান্তা রোগটা এখন বাংলাদেশে মহামারিতে রূপ নিয়েছে। অবশ্য এ অঞ্চলে দশম শতাব্দীতে যখন আল বেরুনি এসেছিলেন তখনই এই রোগের উপসর্গ তিনি শনাক্ত করেছিলেন। আমরাও বিভিন্ন সময়ে ‘সবজান্তা’ রোগে আক্রান্তদের প্রলাপ দেখেছি। এই তো কদিন আগে করোনার সময় এক সবজান্তা বলছিলেন, করোনা মহামারিতে রাস্তাঘাটে লাশ পড়ে থাকবে। আরেক সবজান্তা বলেছিলেন, বেকারত্ব বেড়ে ভয়াবহ রূপ নেবে। অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। পদ্মা সেতু নিয়েও বাচাল ভবিষ্যদ্বাণীর কথা আমরা জানি। কিন্তু এখন যেন এটি সুশীল, বিরোধী রাজনীতি, গণমাধ্যম, আমলাতন্ত্র এবং সরকারের মধ্যেও পল্লবিত হয়েছে। করোনার মতো না জেনে অনর্গল বলার মহামারি ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত।

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক চাপ আছে। সামনে অনিশ্চয়তা আছে। রপ্তানি আয় কমছে। প্রবাসী আয়েও শঙ্কা বাড়ছে। এসবই সত্যিই। কিন্তু সব সংকটে এ দেশের মানুষ অফুরন্ত প্রাণশক্তির অনবদ্য প্রকাশ ঘটিয়েছে। এ দেশের মানুষ সংকট উত্তরণে সবকিছু উজাড় করে দিয়েছে। করোনার মধ্যেও কৃষক ফসল ফলিয়ে আমাদের রক্ষা করেছেন। গত ১৪ বছরে বাংলাদেশ আপন শক্তিতে উদ্ভাসিত হয়েছে। মানুষ তার সামর্থ্য উজাড় করে দিতে শিখেছে। স্বপ্নের পরিধি বেড়েছে বহুগুণ। আসন্ন সংকটও এ দেশের মানুষ কাটিয়ে উঠবে নিজস্ব স্বকীয়তায়। কিন্তু সবজান্তা রোগের যে জীবাণু সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে, তা সারবে কে? এই সবজান্তারা ক্রমশ দেশ ও জনগণের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। এরাই মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। সবজান্তাদের এই বাচাল শব্দদূষণ ঠেকাতে হবে এখনই।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর