শুক্রবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দিবস

ওয়াকিলুর রহমান

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দিবস

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) বহু অনুষদভিত্তিক গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়। এটি ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় স্থাপিত হয়। এটি দেশের তৃতীয় ও আয়তনে সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী ও ৯০০ শিক্ষক রয়েছেন। চবিতে রয়েছে নয়টি অনুষদের অধীন ৫২টি বিভাগ। ২১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে কয়েক জোড়া শাটল ট্রেন, যা শিক্ষার্থীদের শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা-নেওয়া করে, এটা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে সহজেই অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা করে ফেলে। এ শাটল ট্রেন চবির গৌরব। চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। এখানে রয়েছে চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক প্রথিতযশা সাবেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণ ও অধ্যাপনা করেছেন যার মধ্যে একজন নোবেলবিজয়ী এবং একাধিক একুশে পদক বিজয়ীসহ আন্তর্জাতিক খ্যতিসম্পন্ন বহু শিক্ষক অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে চট্টগ্রাম বিভাগে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় চট্টগ্রামের অধিবাসীরা স্থানীয়ভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ১৯৪০ সালের ২৮ ডিসেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সর্বভারতীয় সম্মেলনে চট্টগ্রামের বাসিন্দা মাওলানা মুনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সভাপতির ভাষণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রথম একটি ‘ইসলামিক ইউনিভার্সিটি’ নির্মাণের কথা উপস্থাপন করেন এবং একই লক্ষ্যে তিনি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার দেয়াং পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য ভূমি কেনেন। দুই বছর পর ১৯৪২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নূর আহমদ বঙ্গীয় আইন পরিষদে চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করেন। ষাটের দশকে তৎকালীন পাকিস্তানের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৬০-১৯৬৫) প্রণয়নকালে চট্টগ্রামে একটি ‘বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণের স্থান হিসেবে শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত চট্টগ্রাম সরকারি কলেজকে সম্ভাব্য ক্যাম্পাস হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।  চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের স্থানে এ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হওয়ার পর, ১৯৬১ সালের ৭ মে চট্টগ্রামবাসীর উদ্যোগে স্থানীয় মুসলিম হলে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রধান অতিথির ভাষণে চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে মত প্রকাশ করেন এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করেন। পরে ১৯৬২ সালের ৩০ ডিসেম্বর ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ নামে আরেকটি পরিষদ গঠিত হয়। এসব সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ ও স্মারকলিপি প্রদান, পত্রপত্রিকায় বিবৃতি, সেমিনার অনুষ্ঠিত হতে থাকে। সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ১৯৬২ সালের ৯ ডিসেম্বর লালদীঘি ময়দানে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৩ সালের ৮ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়।

১৯৬৩ সালের ২৯ নভেম্বর ফজলুল কাদের চৌধুরী পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার মনোনীত হন। ১৯৬৪ সালের ৯ মার্চ তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের বৈঠকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ মঞ্জুর করা হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এম ওসমান গনিকে (বিএনপির সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমানের ফারুকের বাবা) চেয়ারম্যান ও ড. কুদরাত-এ-খুদা (বিশিষ্ট বিজ্ঞানী), ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (চবির চারুকলার সাবেক অধ্যাপক মুর্তজা বশীরের বাবা এবং আমার এমবিএর সহপাঠী মুনিজা বশীরের পিতামহ), এম ফেরদৌস খান ও ড. মফিজউদ্দীন আহমদকে সদস্য নির্বাচিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্থান নির্বাচন কমিশন’ গঠিত হয়। এ কমিশন সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে হাটহাজারীর ফতেহপুর ইউনিয়নের জঙ্গল পশ্চিম-পট্টি মৌজার নির্জন পাহাড়ি ভূমিকে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান হিসেবে সুপারিশ করে। ১৯৬৪ সালের ২৯ আগস্ট পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

১৯৬৫ সালের ৩ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের সাবেক কিউরেটর ড. আজিজুর রহমান মল্লিককে (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি ১-১০-১৯৬৬ থেকে ৩১-২-১৯৭২, পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা সচিব ও অর্থমন্ত্রী) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অধ্যাপক আজিজুর রহমান মল্লিক, ড. এ আর মল্লিক নামেই যিনি সমধিক পরিচিত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যার অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে, যিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য। বলা হয়, তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দালানকোঠা নির্মাণ তদারক করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরুতে কোনো শিক্ষকই সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতার কারণে সেখানে জয়েন করতে চাইতেন না। তিনি অনেকটা নিজ প্রচেষ্টায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেধাবী ছাত্র-শিক্ষকদের এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসেন। আমার মরহুম বাবা অধ্যাপক মুজিবুর রহমানও তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সে সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগে যোগদান করেন। ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সেনারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দখল করে এবং টানা নয় মাস তাদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। পাকিস্তানি সেনারা এখানে তাদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বানিয়েছিল। পরে যুদ্ধের শেষে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযান চালায় এবং ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের নয় দিন পর ২৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানিদের আওতামুক্ত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, ১২ জন শিক্ষার্থী ও তিনজন কর্মকর্তা নিহত হন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দফতরের কর্মচারী মোহাম্মদ হোসেনকে বীরপ্রতীক খেতাব দেওয়া হয়।

লেখক : সাবেক শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর