মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

সশস্ত্র বাহিনী : শক্তি, আস্থা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক

কর্নেল মেসবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী, বিএসপি

জল-স্থল-অন্তরিক্ষে দেশের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার দৃপ্ত শপথে বলীয়ান সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। বাংলাদেশের বীরত্ব, শক্তি ও গৌরবের প্রতীক এবং দেশপ্রেমের মহান চেতনায় উজ্জীবিত চৌকশ এ বাহিনী রক্ষা করে চলেছে দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটির সার্বভৌমত্ব। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২১ নভেম্বর গঠিত হয়ে সেদিন থেকেই মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনতে স্থল, জল ও আকাশ পথে একযোগে লড়াই শুরু করে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। মিত্রবাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর চতুর্মুখী আক্রমণে দিশাহারা হয়ে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদাররা নতিস্বীকারে বাধ্য হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন বিশ্বের অন্যতম আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে পরাজিত করে ৯৩ হাজার পাক সৈন্যকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিল বাংলাদেশ সশন্ত্র বাহিনী। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস এবং সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর অসামান্য অবদান তুলে ধরতে প্রতি বছর ২১ নভেম্বর দিনটিকে সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৮০ সাল থেকে ২১ নভেম্বর দিনটিকে নিয়মিতভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী সম্মিলিতভাবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করে আসছে।

রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণা এবং ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চালিকাশক্তি ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বতাধীন সশস্ত্র বাহিনী। যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে কয়েক হাজার প্রশিক্ষিত সৈন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের লক্ষ্যে একটি দক্ষ ও সুগঠিত সশস্ত্র বাহিনী গঠনের মাধ্যমে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির হাত শক্তিশালী করেছিল পশ্চিমাদের স্বপ্ন নস্যাৎ করে দেওয়া বাঙালি সেনারা। ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের নৃশংস হত্যাকান্ডে শহীদ হন সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ এবং ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলসের (ইপিআর) অগণিত সদস্য। ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস এ রাতের পর বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে সশস্ত্র বাহিনীর অনেক সদস্য জীবন বাজি রেখে একত্র হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু ঝটিকা ও গেরিলা আক্রমণ করা হলেও ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া রণকৌশলের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপকতা লাভ করে। কর্নেল এম এ জি ওসমানীর নেতৃত্বে সারা দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে কমান্ডার নিয়োগের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত সেনাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করা হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন ১৭ এপ্রিল যে ঐতিহাাসিক সরকার গঠিত হয় তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে এ বাহিনীর সদস্যরা যেমন যুদ্ধ ক্ষেত্রে সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান, শরণার্থী শিবিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা প্রভৃতি কাজে সশস্ত্র বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

সেক্টর কমান্ডারদের কনফারেন্সের ঘোষণা মোতাবেক বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর অধীনে যাত্রা করে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। প্রাথমিকভাবে ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ নামে ছোট দুটি গানবোট এবং ৪৯ জন নাবিক নিয়ে সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত হয় এ বাহিনীর সদস্যরা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ‘অপারেশন জ্যাকপট’-এর মাধ্যমে শত্রুপক্ষের ২৬টি জাহাজ ধ্বংস এবং সমুদ্রপথ অচল করে দেয় নৌবাহিনী। এ ছাড়া ১৯৭১ সালে হিরণ পয়েন্টের মাইন আক্রমণ, শত্রুবাহিনীর নৌযান ধ্বংস, চালনা বন্দরে নৌ হামলা, চট্টগ্রামে নৌ অভিযানসহ অনেক উল্লেখযোগ্য সফল অভিযান পরিচালনা করে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় ত্বরান্বিত করে। (সূত্র : আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন, লিঙ্ক : https://cutt.ly/TN0FO7X) মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেপ্টেম্বরের মধ্যভাগে তৎকালীন ভারত সরকার বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে স্বাধীন বিমান বাহিনী গঠনের জন্য একটি পুরনো ডিসি-৩ বিমান, একটি অটার বিমান ও একটি অ্যালুয়েট-৩ হেলিকপ্টারের পাশাপাশি নাগাল্যান্ডে একটি পরিত্যক্ত রানওয়ে ব্যবহারের অস্থায়ী অনুমতি দেয়। পাকিস্তান বিমান বাহিনী থেকে প্রায় ৩৫ জন অফিসার ও ক্যাডেট এবং প্রায় ৫০০ বিমানসেনা বাংলাদেশের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। (সূত্র : আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন : https://cutt.ly/nNGMLES)   মহান মুক্তিযুদ্ধের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সশস্ত্র বাহিনী থেকে সাত সদস্যকে সর্বোচ্চ বীরত্বপূর্ণ বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব প্রদান করা হয়। এ ছাড়া সশস্ত্র বাহিনীর মোট ৬৭২ জন খেতাবপ্রাপ্ত, ২১২ জন যুদ্ধাহত, ১ হাজার ৫৮৫ জন শহীদ ও ২৫ হাজার ৭৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। (সূত্র : https://freedomfighters. afd.gov.bd/)

জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনে বিশ্বে বাংলাদেশকে রোল মডেলে পরিণত করতে ভূমিকা রেখেছে সশস্ত্র বাহিনী। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলে অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজমান ছিল। পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতি সম্প্রদায়গুলোর সঙ্গে দীর্ঘদিনের সংঘাত নিরসন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মাইলফলক হিসেবে কাজ করে, যার মূল ভূমিকায় ছিল বাংলাদেশ সেনাবহিনী। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’, যার প্রতিফলন বিগত ৫০ বছরের পররাষ্ট্রনীতেতে আমরা দেখতে পাই। আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের কোনো শত্রুদেশ দৃশ্যমান না থাকলেও সার্বভৌমত্ব বজায় রাখাসহ বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ। কোনো দেশের সেনাবাহিনীকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমাদের দেশের সেনাবাহিনীকেও তাই শক্তিশালী করে গড়ে তোলা হয়েছে। নৌবাহিনীতে যোগ হয়েছে সাবমেরিন, হেলিকপ্টার ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ যুদ্ধজাহাজ। বিমানবাহিনীর রয়েছে চতুর্থ ও পঞ্চম প্রজন্মের আধুনিক বিমান।

বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কর্মদক্ষতা ও পেশাদারি প্রশংসিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের ভূমিকা বিশ্বব্যাপী আলোচিত। বিশ্বের অস্থিতিশীল এলাকাগুলোয় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৯৪৮ সালে সূচনা হয় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের। ১৯৮৮ সালে ইরান-ইরাক শান্তি মিশনের মধ্য দিয়ে শান্তিরক্ষার এ মিশনে বাংলাদেশের যে পথচলা শুরু হয়, দীর্ঘ ৩৪ বছর পর তা শেকড় থেকে শেখরে অবস্থান করে নিয়েছে। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা বর্তমানে জাতিসংঘের চলমান ১২টির শান্তিরক্ষা মিশনের মধ্যে ৯টিতেই দায়িত্ব পালন করেছে; যার সংখ্যা ১ লাখ ৮৩ হাজার ৬৯১। ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ পর্যন্ত বাংলাদেশ ৫৪টি মিশনে মোট ৭ হাজার ৩ জন সৈন্য পাঠিয়ে বিশ্বশান্তি রক্ষায় শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। (সূত্র : https://cutt.ly/rN07JV1)যুদ্ধবিধ্বস্ত অনেক এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিকূল অঞ্চলে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আফ্রিকার দেশগুলোয় শান্তিরক্ষীরা নিরস্ত্রীকরণ, মাইন অপসারণ, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন তৈরিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বে নিপীড়িত মানুষের শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নিজেকে বিসর্জন দিতে দ্বিধাবোধ করেনি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ১৪২ জন শান্তিরক্ষী। (সূত্র : আর্ম ফোর্সেস ডিভিশন : https://cutt.ly/KV0YvJf) যার মধ্যে সর্বশেষ ৪ অক্টোবর সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে মোতায়েন করা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর তিন বাংলাদেশি সেনা রাস্তায় পুঁতে রাখা বোমার বিস্ফোরণে প্রাণ হারান। (সূত্র : আইএসপিআর কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য লিঙ্ক :  https://cutt.ly/LNuIlIY) বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের অবদানের কথা স্মরণ রাখতে সিয়েরা লিওন বাংলাকে তাদের সম্মানজনক দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের মধ্যে অনেকেই দ্যাগ হ্যামারশোল্ড পদকে ভূষিত হয়েছে। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘ সদর দফতরে ‘বাংলাদেশ লাউঞ্জ’ স্থাপনের অনুমতি পেয়েছে বাংলাদেশ; যা দেশের ব্র্যান্ডিংয়ে অন্যতম ভূমিকা পালন করবে।

স্বাধীনতার পর থেকে দেশ গঠনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা রক্ষার পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, সন্ত্রাস দমন, কভিড মহামারি মোকাবিলা, বেসামরিক প্রশাসনকে সহযোগিতা, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ নানা কর্মকান্ডে তারা মানুষের আস্থা অর্জন করেছে। করোনাভাইরাসের সময় প্রতিকূল পরিবেশে সারা দেশের মানুষের চিকিৎসা ও সরকারি আদেশ বাস্তবায়ন করে বিশ্ববাসীর প্রশংসার পাশাপাশি মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ভৌগোলিকভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রলয়ঙ্করী বন্যা, ভূমিধস, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী যেকোনো ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সশস্ত্র বাহিনীর সতর্কতামূলক কাজ ও মানুষকে সাইক্লোন শেল্টারে নেওয়ার দায়িত্ব পালনের ফলে প্রাণহানি অনেকটাই কমে এসেছে। ২০০৭ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর ও ২০০৯ সালে আইলার আঘাতে উপকূল ল-ভ- হয়ে যায়। সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তায় দ্রুত এ অঞ্চলের মানুষ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায়। রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য অঞ্চলে ভূমিধসে প্রতি বছর শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হতো। দুর্যোগপ্রবণ এ মানুষদের উদ্ধারে প্রাণ দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি সশস্ত্র বাাহিনীর অদম্য সদস্যরা। ২০১৭ সালের ১৩ জুন রাঙামাটিতে পাহাড়ধসে উদ্ধার কার্যক্রম চলাকালে দুজন সেনা কর্মকর্তাসহ চার সেনা সদস্য মারা যান। (সূত্র : আইএসপিআর : https://cutt.ly/HNFCDlk) এ ছাড়া ১৯৮৮ সালের বন্যা, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা দিনরাত তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ২০২২ সালের মে মাসে সিলেট অঞ্চলের ভয়াবহ বন্যায় জীবন বাজি রেখে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। বন্যার্ত এলাকায় আক্রান্ত মানুষকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর, চিকিৎসা প্রদান, জরুরি ত্রাণ বিতরণসহ অন্যান্য মানবিক কাজে সশস্ত্র বাহিনীর কার্যক্রম প্রশংসিত হয়েছে। দুর্যোগকালীন এবং দুর্যোগ-পরবর্তী মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করতে সেনাবাহিনী সিভিল প্রশাসনের সমন্বয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে আসছে। ২০১২ সালের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনেও সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া আছে। (সূত্র : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২)

বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা প্রতিরক্ষার পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গৃহহীনদের জন্য বাসস্থান নির্মাণসহ নানাবিধ মানবহিতৈষী কাজ করে চলেছে। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ছবিসহ ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করা ছিল চ্যালেঞ্জিং; যা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন হয়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় মহাসড়ক নির্মাণ ও সংস্কার, ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস নির্মাণে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা অগ্রগণ্য। সাধারণত বাংলাদেশে কোনো প্রকল্পে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের প্রশ্নবিদ্ধ কাজের মান ও প্রকল্পে দীর্ঘসূত্রতা দেখা যায়, কিন্তু সশস্ত্র বাহিনী সেখানে নির্ধারিত সময়ের আগেই টেকসই নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ফেনীতে নির্মিত দেশের প্রথম ছয় লেনের উড়ালসড়ক। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে নির্ধারিত সময়ের ছয় মাস আগেই উড়ালসড়কের কাজ সম্পন্ন করে সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। এ ছাড়া, আশ্রয়হীন অসহায় মানুষের জন্য নির্মিত কক্সবাজারে খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে ভূমিহীন ৩ হাজার ৮০৮টি পরিবারের পুনর্বাসনের কাজ করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড। বঙ্গবন্ধু সেতুর নিকটবর্তী যমুনার তীরে যেমন স্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু সেনানিবাস, সেভাবেই পদ্মার দুই পাড়ে তৈরি হয়েছে শেখ রাসেল সেনানিবাস। সেনাবাহিনীর প্রকৌশলীরা পার্বত্য অঞ্চলে রাস্তাঘাট, কক্সবাজার-চট্টগ্রাম উপকূল ঘেঁষে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মেরিন ড্রাইভ, জাতীয় মহাসড়কসহ অনেক প্রকল্প সুন্দরভাবে শেষ করেছে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নির্মিত হাতিরঝিল প্রকল্প ঢাকাবাসীর জন্য নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা। পদ্মা সেতুর মূল কাজ শুরুর আগে সেতুর অ্যালাইনমেন্ট বরাবর ব্যাপক ভাঙন শুরু হলে বড় ধরনের ঝুঁকির আশঙ্কা দেখা দেয়। পদ্মা নদীর পাড় বরাবর মাওয়া-কান্দিপাড়া-যশোলদিয়া অঞ্চলে প্রায় ১.৩ কিমি নদীশাসনের কাজ সম্পন্ন করে সেই ঝুঁকি প্রশমনের পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে জাজিরা ও মাওয়া অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণের মাধ্যমে স্বপ্নের পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে সশস্ত্র বাহিনীকে আরও আধুনিক, দক্ষ ও গতিশীল করার প্রত্যয়ে প্রণয়ন করেছে ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’, যা বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে একটি প্রভাবশালী দেশে পরিণত করবে। এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ২০১২-২০১৭ সাল পর্যন্ত মোট ৫.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ইতোমধ্যে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ, BIPSOT, Peace Keeping Institute, Bangladesh University of Professionals সহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান তাদের শিক্ষাক্রম ও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। সমুদ্র অঞ্চলের সম্পদ আহরণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নৌবাহিনীকে আধুনিকায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। (সূত্র : আর্মড ফোর্সেস গোল : https://cutt.ly/QNGL2C5) ফোর্সেস গোল ২০৩০-এর সঙ্গে মিল রেখে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কিছু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। লক্ষ্যমাত্রাগুলোর মধ্যে ক. বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার লক্ষ্যে একটি আধুনিক সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা খ. একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সশস্ত্র বাহিনীতে সক্ষম ও উপযুক্ত মানবসম্পদ গড়ে তোলা; আধুনিক জ্ঞান, দক্ষতা ও কারিগরি কুশলতায় সমৃদ্ধ এ মানবসম্পদকে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে তোলা গ. অন্যান্য দেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ে ধারণা লাভ ঘ. একটি উন্নততর, সুখী ও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনগুলোয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং প্রশংসনীয় অবদান রাখা। (সূত্র : প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন, লিঙ্ক : https://cutt.ly/ONGqApG) পরবর্তীতে ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত ফোর্সেস গোল ২০৩০-এর কার্যক্রমের ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করা সশস্ত্র বাহিনী বাঙালি জাতির অহংকার শিরস্ত্রাণ। মুক্তিযুদ্ধকালে জন্ম বলেই এ দেশের সাধারণ মানুষের আবেগ, অনুভূতি, চেতনা সবকিছুর সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর আত্মিক সম্পর্ক। তাই সবার প্রত্যাশা- সশস্ত্র বাহিনী দিবসের মহিমায় তৈরি হবে জাতীয় সম্প্রীতি ও শক্তির সেতুবন্ধ।

 

                লেখক : সামরিক বাহিনীতে কর্মরত

সর্বশেষ খবর