বুধবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

মূর্তি ক্যাম্প থেকে মুক্তিযুদ্ধে

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

মূর্তি ক্যাম্প থেকে মুক্তিযুদ্ধে

বাংলাদেশ এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটে যাওয়া স্বাধীনতার রক্তাক্ত সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৭১ একটি অনন্য মাইলফলক। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ২৬৬ দিনের টানা যুদ্ধ শেষে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ২৫ মার্চ কালরাতে শুরু হওয়া নির্বিচারে গণহত্যা, লুটতরাজ, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের প্রেক্ষাপটে তৎকালীন বর্তমান বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষের একটি বড় অংশ জীবন রক্ষার্থে এবং সংগঠিত হয়ে প্রতি আক্রমণ চালাতে পাশের দেশ ভারতে আশ্রয় নেয়। এ বিশাল শরণার্থীদের প্রথমত বাঁচার জন্য যুদ্ধ করতে হয়। কারণ তাদের মৌলিক চাহিদা তথা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান কিংবা চিকিৎসার ব্যবস্থা করাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এরপর আসে সংগঠিত হয়ে প্রতি আক্রমণ চালানোর প্রসঙ্গ। তবে বাংলার মুক্তিকামী মানুষ এ ক্ষেত্রে ছিল ব্যতিক্রম। সব প্রতিকূলতা দূরে সরিয়ে এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে তারা যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলায় নেমে পড়ে। সব ভেদাভেদ ভুলে সব বয়সের মানুষ তখন প্রথম দিকে গেরিলা কায়দায় পাকিস্তানিদের প্রতিহত করে। তবে প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্লা দিয়ে যুদ্ধ করার জন্য গেরিলা বাহিনীর পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট কমান্ড বা নিয়ন্ত্রণে থাকা সুবিন্যস্ত ও সুশৃঙ্খল নিয়মিত বাহিনীর প্রয়োজনীয়তাও অনুভূত হয়। এ ধারণা থেকেই ভারতের মূর্তি ক্যাম্পে ‘প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্স’-এর ৬১ জন তরুণ অফিসার স্বল্পমেয়াদি অথচ কঠোর ও কার্যকর প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধের প্রয়োজনে ১৯৭১ সালের ৯ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে।

বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাঙালির মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ইত্যাদির ছাত্রছাত্রী। তাদের প্রায় সবাই সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশের মাটি থেকে দখলদার বাহিনীকে উৎখাত করতে উদ্গ্রীব ছিলেন। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন সেনানিবাস ও সংলগ্ন এলাকা থেকে বিদ্রোহ করে অস্ত্র, গোলাবারুদসহ বেরিয়ে আসা এবং ভারত ও মুক্ত সীমান্ত অঞ্চলে সংগঠিত হতে সচেষ্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও বিক্ষিপ্তভাবে থাকা সেনা, সীমান্তরক্ষী বাহিনী ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের সংগঠিত করা ও সম্মুখসমরে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো অফিসারের সংখ্যা ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। এমনই এক প্রেক্ষাপটে ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে গড়ে ওঠা মুজিবনগর সরকার এবং অপারেশন পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা কমান্ড দেশের ভূখন্ডকে ১০টি সেক্টরে বিভক্ত করে। এরপর তৎকালীন বাংলাদেশ ফোর্সেস হেডকোয়ার্টার ও এসব সেক্টর পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সেক্টর কমান্ডাররা আগত শরণার্থী ও আগ্রহী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে কমপক্ষে উচ্চমাধ্যমিক পাস যুবকদের মধ্য থেকে মেধাসম্পন্ন ও শারীরিকভাবে যোগ্যদের স্বল্পকালীন ও যুদ্ধোপযোগী কার্যকর প্রশিক্ষণ দিয়ে সেনা অফিসারের দায়িত্ব প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যারা সেক্টর সদর দফতর এবং বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধরত পদাতিক ও অন্য সেনা সদস্যদের নেতৃত্ব প্রদান করবেন। এ উদ্দেশ্য সামনে রেখেই প্রাথমিকভাবে প্রতি সেক্টর থেকেই কিছু কিছু প্রশিক্ষণার্থী নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।

মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া সেনা অফিসাররা সুপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্প, রণাঙ্গন, সেক্টরে সশরীরে উপস্থিত হয়ে উপযুক্ত যুবকদের নির্বাচন করেন এবং ভারতের অভ্যন্তরে গোপনে স্থাপিত সেক্টর সদরসহ বেশকিছু সুনির্দিষ্ট স্থানে জড়ো করেন। এখানে বাংলাদেশি সেনা অফিসার এবং কিছু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ভারতীয় সেনা অফিসার ও ভারতীয় মেডিকেল কোরের ডাক্তারদের সহায়তায় চূড়ান্ত সাক্ষাৎকার ও শারীরিক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। জুন, ১৯৭১-এর শেষ দিকে এই নির্বাচিত যুবকরা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্নভাবে এসে জড়ো হন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি। এখান থেকে হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশে সে দেশের তিস্তা নামক এক খরস্রোতা নদীর পাশে মূর্তি নামক দুর্গম পাহাড়, জঙ্গল ও চা বাগানের মধ্যে গড়ে ওঠা এক সেনা ক্যাম্পে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। মূর্তি ভারত-সিকিম-ভুটান সীমান্তে গড়ে ওঠা একটি সেনা গ্যারিসন, যেখানে মূলত একটি ব্রিগেড গ্রুপ অর্থাৎ ৬-৭ হাজার সেনা অবস্থান করত। ভারতীয় বিমানবাহিনীর ছোট্ট একটি বিমান অবতরণ কেন্দ্র বা অ্যাডভান্স এয়ার ল্যান্ডিং স্ট্রিপও ছিল এ মূর্তিতে, যেখানে চা বাগানের মালিকরা ব্যক্তিগত বা ভাড়া করা ছোট ছোট বিমান নিয়েও কালেভদ্রে নামতেন। পুরো এলাকায় মাঝেমধ্যেই পশ্চিম বাংলার নকশালরা উৎপাত করত। তা ছাড়া রণকৌশলগত কারণে ভারত তখনো চায়নি বহির্বিশ্ব জানুক যে বাংলাদেশের মেধাবী যুবকদের সেনা অফিসার হিসেবে গড়ে তুলতে নিজ ভূখন্ডে ভারত প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তাই দুর্গম ও জনমানবের কম বসতি সত্ত্বেও চা শ্রমিকসহ হাতে গোনা যারাই মূর্তিতে যেত তাদের সবাইকেই কঠোর নজরদারিতে রাখা হতো।

একসময় মূর্তি সেনা গ্যারিসনে একটি ভারতীয় মারাঠা সেনাদল ছিল। তাদের সাময়িক বসবাসের জন্য নির্মিত হয়েছিল ওপরে টিন ও পাশে বাঁশের বেড়ার দেওয়া লম্বা ব্যারাক ঘর। বাছাইকৃত প্রশিক্ষণার্থী যুবকদের নিয়ে গড়া ‘প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্স’-এর ক্যাডেটদের এ ব্যারাকজীবনেই শুরু হয় যুদ্ধের হাতেখড়ি। একদিকে গণটয়লেট, সামনের মূর্তি খালে গোসল, জংলি জোঁক ও মশার জ্বালাতন, মশারি ও চাদরবিহীন লম্বা পাতা বিছানা, নিম্নমানের খাবার ইত্যাদি হাসিমুখে মেনে নিয়ে এই যুবকরা শুধু দেশের টানে এবং মুক্তির নেশায় তথা স্বাধীনতার আশায় প্রশিক্ষণে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিল।

এ প্রশিক্ষণার্থীদেরই একজন ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাই শেখ কামাল। বলা বাহুল্য, ইচ্ছা করলেই এই যুবক কলকাতার শহুরে জীবনে অন্য যেকোনো কাজে সম্পৃক্ত থাকতে পারতেন। কিন্তু দেশের টানে সব প্রতিকূলতা মেনে নিয়েই তিনি প্রশিক্ষণে যোগ দেন। প্রশিক্ষণের সময় সকালে দুটি পুরি ও চা, দুপুরে ডাল রুটি অথবা সবজি রুটি আর রাতে ডাল, ভাত ও সবজি ছিল প্রশিক্ষণার্থীদের বরাদ্দকৃত খাবার। শেখ কামাল এসব খেয়েই সতীর্থদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন। কঠোর প্রশিক্ষণ ও খাবারের স্বল্পতার কারণে শেখ কামালসহ অনেকেই প্রশিক্ষণের তৃতীয় সপ্তাহেই শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। শেখ কামালের পাশের বিছানায় থাকতেন এককালের জাতীয় ফুটবল দলের গোলরক্ষক নবী (তখন ক্যাডেট নবী)। তারা উভয়েই ছিলেন ফুটবল অন্তঃপ্রাণ। শারীরিক দুর্বলতার কারণে চিন্তিত হয়ে তারা উভয়ে ভাবলেন তাদের কাছে থাকা অল্প-স্বল্প টাকা যা-ই আছে তা দিয়ে হরলিক্স বা বিস্কিট কিনে খাবেন। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলেন বাকিদের কাছে তো তেমন টাকা নেই, তারা তো কিনতে পারবেন না, ফলে সেই চিন্তা উভয়েই বাদ দেন। শনিবার ছিল প্রশিক্ষণার্থীদের কাছে একটি কাক্সিক্ষত দিন বা সময়। ওইদিন রাতের খাবারের জন্য একটি ছাগল বা খাসি জবাই করা হতো। শেখ কামাল পাথরে ছুরি ধার দিয়ে নিজে মহা উৎসাহে সেই কাক্সিক্ষত খাসি জবাই করতেন। আরেক প্রশিক্ষণার্থী সাদেক নিজ হাতে সেটা রান্না করতেন। শেখ কামালের আরেক বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি খুবই সাহসী ছিলেন। বিশেষত বিষাক্ত সাপের ভয়ে সবাই যখন ভীতসন্ত্রস্ত থাকতেন তখন শেখ কামাল থাকতেন নিশ্চিন্ত ও নির্ভার। বিষাক্ত সাপ ধরে ও সাপ নিয়ে খেলা করে তিনি বাকিদের আনন্দ দিতেন।

সাপের সঙ্গে পরবর্তীতে প্রায় সবারই কমবেশি সখ্য গড়ে উঠেছিল। কারণ মাঝেমধ্যে ব্যারাকের ভিতরে এমনকি বিছানায়ও সাপ পাওয়া যেত। এমনিতেই হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত এ অঞ্চলে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। তার ওপর প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের প্রশিক্ষণের সময়টা ছিল ঘনঘোর বর্ষাকাল। কিন্তু বৃষ্টি, কাদা, জল, জোঁক, সাপ সবকিছু উপেক্ষা করে বাংলার দামাল ছেলেরা আত্মনিয়োগ করেন অস্ত্র প্রশিক্ষণ, বিস্ফোরকের ব্যবহার, রণকৌশল, নেতৃত্বের গুণাবলির মতো মৌলিক বিষয়গুলো রপ্ত করতে। আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁদের এ বিষয়গুলো শিখিয়েছিলেন এ প্রশিক্ষণের সার্বিক দায়িত্বে থাকা ব্রিগেডিয়ার জোশি, প্রধান প্রশিক্ষক কর্নেল দাশগুপ্ত ও অফিসার ইনচার্জ মেজর আসোয়ান থাপা। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন স্থানাপাতী, ক্যাপ্টেন যাদব, ক্যাপ্টেন চন্দন, ক্যাপ্টেন আরপি সিং, ক্যাপ্টেন সজ্জন সিংসহ অন্য আরও কজন অফিসার প্রশিক্ষক এবং জুনিয়র কমিশন ও নন-কমিশন প্রশিক্ষক। তাঁরা জানতেন এ প্রশিক্ষণার্থীরা প্রশিক্ষণ শেষে অচিরেই হয়তো বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের একেকটি অঞ্চলে তাঁদের অধীন সেনাদের নিয়ে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করবেন। তাই যুদ্ধের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সবকিছু শিখিয়ে দিতে তাঁদের কোনো কার্পণ্য ছিল না। ভারতীয় উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ৩৩ কোর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এম এল থাপন কয়েকবার এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিদর্শন করেছেন। জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, জিওসি-ইন-সি, ইস্টার্ন কমান্ড, বাধা অতিক্রম বা অ্যাসল্ট কোর্স প্রশিক্ষণ পরিদর্শন করেছিলেন এবং তাঁদের দক্ষতা দেখে তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছিলেন।

প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের এ প্রশিক্ষণ কত দিন চলবে তা নিয়ে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব অথবা মতের পার্থক্য ছিল। একদিকে যুদ্ধের জন্য নতুন অফিসার অপরিহার্য হয়ে ওঠে, আবার অন্যদিকে অনেকেই ভেবেছিলেন শীতকালের কিছুটা সময় যদি প্রশিক্ষণের কাজে লাগানো যায় তাহলে তাদের দক্ষতা অনেকাংশেই বেড়ে যাবে। শেষ বিচারে যুদ্ধের প্রয়োজনই বড় হয়ে দেখা দেয়। ফলে সিদ্ধান্ত হয়, অক্টোবরের ৮ তারিখ তাদের প্রশিক্ষণ শেষ করা হবে এবং ৯ তারিখে প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজের মাধ্যমে তাদের অফিসার হিসেবে বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাঠানো হবে। সে ধারণা থেকেই প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজেরও প্রস্তুতি চলতে থাকে।

অবশেষে আসে ৯ অক্টোবরের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সেদিনের সেই প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজে আড়ম্বরতা বা জৌলুশ ছিল না, তবে তা ছিল আন্তরিকতা, উত্তেজনা, আবেগ এবং আশা জাগানিয়া ভাবগম্ভীর পরিবেশ। সেদিনের কুচকাওয়াজ পরিচালনা করেছিলেন শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে এগিয়ে থাকা ক্যাডেট সাঈদ, যিনি পরবর্তীতে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজের অভিবাদন মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল (পরবর্তীতে জেনারেল) এম এ জি ওসমানী এবং মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। এরপর প্যারেড ময়দানে উপস্থিত হন মুজিবনগর সরকারের উপরাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সদ্য কমিশনপ্রাপ্ত তরুণ অফিসারদের উদ্দেশে দেওয়া আবেগঘন বক্তৃতায় তাঁরা তিনজনই সেদিন হিমালয়ের পাদদেশের আকাশ-বাতাস ভারী করে তোলেন। সুশৃঙ্খল ও আকর্ষণীয় শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজ শেষ হওয়ার পর সবাইকে সনদ এবং অন্যান্য পুরস্কার বিতরণ করা হয়। এরপর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে একজন কর্মকর্তা একে একে নতুন অফিসারদের মধ্য থেকে কে কোথায় যোগ দেবেন, তা জানিয়ে দেন। এ সময় প্যারেডের সামনের সারির সবচেয়ে ডানে দাঁড়িয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল। তাঁর পোস্টিং হয়েছিল বাংলাদেশ ফোর্সেস সদর দফতরে মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল ওসমানীর নিরাপত্তা রক্ষা এবং বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পালনের জন্য। নিরপেক্ষ মূল্যায়নে ৬১ জনের মধ্যে শেখ কামালের অবস্থান ছিল সপ্তম। এরপর সৃষ্টি হয় এক আবেগঘন পরিবেশ। ভারতীয় প্রশিক্ষকরা একে একে জড়িয়ে ধরেন তাঁদেরই হাতে গড়া পুত্রতুল্য সদ্য কমিশনপ্রাপ্ত এই অফিসারদের। কারণ তাঁরা জানতেন এই যুবকদের এখান থেকেই সরাসরি রণাঙ্গনে যোগ দিতে হবে এবং তাঁদের অনেককেই হয়তো স্বাধীনতা তথা দেশের জন্য জীবন দিতে হতে পারে। ৬১টি তাজা প্রাণও জানতেন একসঙ্গে প্রশিক্ষণ নিলেও তাঁদের হয়তো আর কোনো দিনই একসঙ্গে হওয়া হবে না। দেশের প্রয়োজনে তাঁদের অনেককেই হয়তো জীবন দিতে হবে। এ বাস্তবতা মেনেই তাঁরা একসময় একে একে হিমালয়ের পাদদেশ তথা স্মৃতিময় মূর্তি ক্যাম্প ছেড়ে নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগদানের উদ্দেশ্যে রওনা করেন।

এ কথা সত্য যে, প্রশিক্ষণ দক্ষতা জোগায়-সাহস এবং দেশপ্রেম। প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সে অল্প সময়ের প্রশিক্ষণ নিলেও তাঁদের সাহস ও নিষ্ঠা ছিল অনুকরণীয়। ৬১ জন অফিসারই যুদ্ধে সাহস ও নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁদের দক্ষতা প্রয়োগ করেছিলেন, শত্রুর চোখে চোখ রেখে কথা বলেছিলেন, শত্রুর গুলির জবাব দিয়েছিলেন গুলি করে। এ কোর্সের ২/লে. আশফাকুস সামাদ, বীরউত্তম, ২/লে. খন্দকার আজিজুল ইসলাম, বীরবিক্রম এবং ২/লে. কামরুল হাসান সেলিম বীরবিক্রম দেশের জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছেন। আরও ১৭ জন অন্যান্য বীরত্বসূচক উপাধি লাভ করেন। আগামী প্রজন্ম ৯ অক্টোবরকে নতুন করে জানুক, এটাই প্রত্যাশা।

(তথ্যসূত্র : ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে সেক্টর ৮, মেজর জেনারেল খোন্দকার মো. নুরুন্নবী (অব.); অ্যাডহক মিলিটারি একাডেমি অ্যাট মূর্তি, ইন্ডিয়া-হাউ ইট ওয়াজ অর্গানাইজড - ব্রিগেডিয়ার আর পি সিং, পি ভি এস এম; এবং ওয়ার কোর্স ক্যাডেটস অ্যাট মূর্তি - লে. কর্নেল দেবব্রত স্থানাপাতী, দি ফার্স্ট সিক্সটি ওয়ান অ্যান্ড মূর্তি ডেইজ - মেজর (অব.) মুহাম্মদ আবুল হোসাইন, পিএইচডি, পিএসসি)

            লেখক : গবেষক, কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর