শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

আমার বন্ধু আনোয়ার উল আলম শহীদ

সরোয়ার হোসেন মোল্লা

আমার বন্ধু আনোয়ার উল আলম শহীদ

বন্ধুবর, বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার উল আলম শহীদ সম্পর্কে কিছু স্মৃতিচারণা করা আমার পক্ষে  যেমন কঠিন  তেমন বেদনাদায়ক। কঠিন এ কারণে যে, কোথা থেকে শুরু করব আর কোথায় শেষ করব সে সম্পর্কে দিশা পাওয়াই ভার। আর বেদনাদায়ক এ কারণে যে, আমি কোনো দিন ভাবিনি বন্ধু শহীদ সম্পর্কে আমাকে স্মৃতিচারণা করতে হবে। শহীদ প্রায়ই বলতেন- সরোয়ার, আমাদের সম্পর্কে যতগুলো সরকারি নির্দেশ জারি হয়েছে সবই প্রায় একসঙ্গে এবং একই দিনে। আমরা হয়তো মারাও যাব একই দিনে। অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! মাথায় টিউমারজনিত জটিলতা এবং করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর আমাদের সবাইকে ছেড়ে শহীদ চলে গেলেন অনন্তযাত্রায়। যেখানে আমাদের সবাইকে যেতে হবে। তবু মনে হয় শহীদ হয়তো সময়ের আগেই চলে গেলেন।

আনোয়ার উল আলম শহীদের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় বঙ্গবন্ধুর সচিব রফিকউল্লাহ চৌধুরীর অফিসে। সময়টা ছিল ১৯৭২ সালের জানুয়ারির শেষ দিক। সঠিক তারিখটা আমার মনে নেই। প্রারম্ভিক আলাপে বুঝতে পারলাম আমাদের দুজনের ওই অফিসে উপস্থিত হওয়ার কারণটা অভিন্ন। শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান এবং তোফায়েল ভাই আগেই কিছুটা আভাস দিয়েছিলেন। আমাদের মতামতের বিষয়ে কিছুটা সন্দেহ থাকায় তাঁরা বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু বিস্তারিত বুঝিয়ে বলবেন। এরপর বঙ্গবন্ধুর কক্ষে প্রবেশের পর জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি আধাসামরিক বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যার প্রধান হবেন ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান। দুজন ডেপুটি প্রধান নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই চার নেতার ওপর। তাঁরা আমাদের দুজনের নাম সুপারিশ করেছেন। এভাবেই আমরা সরকারি চাকরিতে অর্থাৎ জাতীয় রক্ষীবাহিনীতে উপপরিচালক পদে যোগদান করি।

চাকরি জীবনে বহু বিচিত্র ঘটনার কথা মনে পড়ে। প্রায় ৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ঢাকার পিলখানায়। তাদের খাওয়া-পরার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ইপিআরের পুরনো রেশন কন্ট্রাক্টরকে অনুরোধ করে এ মর্মে রাজি করানো হয়- জিও বা গভর্নমেন্ট অর্ডার জারি হলে তার সব বকেয়া পাওনা দিয়ে দেওয়া হবে। ম্যাজিস্ট্রেট নিজাম উদ্দিন ট্রেজারি থেকে প্রতি দিন ক্যাশ টাকা উঠিয়ে ছেলেদের পকেট খরচের ব্যবস্থা করতেন। ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান সরকারি অফিসের কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন। একদিন আমাদের দুজনকে ডেকে জানালেন, বহু চেষ্টা-তদবিরের পরও অর্থ মন্ত্রণালয় জিও ইস্যু করছে না। আমরা কতদিন এতগুলো ছেলেকে এভাবে রাখতে পারব? তোমরা দুজন যাও অর্থ সচিবের অফিসে এবং এ সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা কর। আমরা দুজন অর্থ সচিবের কক্ষে প্রবেশ করে জিও ইস্যু না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে সচিব মহোদয় গতানুগতিক আমলার মতো বললেন, যথাসময়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া হবে। বন্ধুবর শহীদ তাকে প্রাঞ্জল বাংলায় বললেন, আমরা ৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে খাওয়াতে পারছি না। আর আপনি যথাসময়ে ব্যবস্থা নেবেন বলে আমাদের সঙ্গে তামাশা করছেন? আপনি এ মুহূর্তে ফাইল সই করবেন, নয়তো We will Throw you out of that windows. অর্থ সচিব আর কথা না বলে ফাইলে সাতটি আপত্তি দিয়ে সই করেন। আমি আর শহীদ ফাইলটি নিয়ে সোজা অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের অফিসে যাই এবং তাঁকে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে বলি। তিনি তৎক্ষণাৎ সচিবকে ডেকে ওইদিনই জিও ইস্যু করার নির্দেশ প্রদান করেন। তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর জিওর কপি নিয়ে আমরা অফিসে ফিরে আসি।

শহীদের মানবিক মূল্যবোধের অনেক দৃষ্টান্ত দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। এ মুহূর্তে যে ঘটনাটি আমার মনে পড়ছে তা হলো, সিরাজ শিকদার চট্টগ্রামে পুলিশের হাতে বন্দি হওয়ার পর তাকে ঢাকায় রক্ষীবাহিনী অফিসার্স মেসে আনা হয়। আমরা দুজন এর প্রবল আপত্তি করি। আমাদের বক্তব্য তাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তিনি পুলিশের হেফাজতে থাকবেন নয়তো তাকে সেন্ট্রাল জেলে রাখা হবে। পুলিশের বক্তব্য ছিল নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের মেসে আনা হয়েছে। যা হোক, আমরা যখন তাকে দেখতে গেলাম সে এক অদ্ভুত অবস্থা। তাকে হাত-পা-চোখ বেঁধে মেঝেতে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। শহীদ প্রবলভাবে আপত্তি করে বললেন, এটা শুধু অমানবিক নয়, চরম কাপুরুষতা। তার ভাষায়, এত সুরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেও সে যদি পালিয়ে যেতে পারে- Then he daserved. পরে হাত-পা খুলে তাকে চেয়ারে বসিয়ে চা-বিস্কুট খেতে দেওয়া হয়েছিল।

অন্য একটি ঘটনা। আমরা ভারতে ছয় মাসের একটি কোর্স করছিলাম। আমাদের ট্রেনিং স্কুলের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার টি এস ওবেরয়, তিনি একসময় আগ্রার প্যারা ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন। একদিন জানালেন আমরা যদি প্যারা জাম্প করতে চাই তিনি সে ব্যবস্থা করতে পারবেন। শহীদ খুব উৎসাহিত হয়ে আমাকে বললেন, চল দোস্ত, আমরা প্যারা জাম্প করি। একটি উইং পাব যা সবসময় ইউনিফরমের সঙ্গে পরতে পারব। আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, এজন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হবে এবং জীবনের অনেক ঝুঁকিও আছে। যদি কোনো কারণে প্যারাসুট না খোলে তবে তো ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে। সে তো নাছোড়বান্দা! তার পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত রাজি হলাম এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলো। এর মধ্যে একদিন আমাদের Comandant জানালেন এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন লাগবে কারণ যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তার দায়দায়িত্ব কে নেবে? যার ফলে শেষ পর্যন্ত আর প্যারা জাম্প দেওয়া হয়নি।

১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক ঘটনার পর রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের যে যে র‌্যাংক ছিল ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ করা হয়। রক্ষীবাহিনীর উপপরিচালকের পদটি লে. কর্নেলের পদমর্যাদার হওয়ায় আমাদের দুজনকে সেনাবাহিনীতে ওই পদ দিয়েই আত্তীকরণ করা হয়। আমাদের প্রচণ্ড আপত্তি সত্ত্বেও পরিচালক ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের অনুরোধে আমরা শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য হই। সেনাবাহিনীতে চাকরিকালীন আমরা দুজনই উপলব্ধি করি, সেনাবাহিনীর চাকরি আমাদের জন্য সুখবর বয়ে আনবে না। তাই সেনাপ্রধানের সঙ্গে দেখা করে আমরা দুজন তাঁকে জানাই আমাদের দুজনকে অবসরে প্রেরণের ব্যবস্থা করা হোক, নয়তো কোনো বেসামরিক বিভাগে আমাদের ডেপুটেশন অথবা স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হোক। ফলে ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে আমাদের চাকরি ডেপুটেশনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় এবং ১৯৯০ সালে ফুল কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে স্থায়ীভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আত্তীকরণ করা হয়।

শহীদের বন্ধুত্বের পরম পরাকাষ্ঠা আমি দেখেছি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনার পর। সেনাপ্রধান, বিমানবাহিনী প্রধান ও নৌবাহিনী প্রধান রেডিওতে মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার পর রক্ষীবাহিনীর প্রধানকে আনুগত্য প্রকাশের জন্য ডাকা হয়। রক্ষীবাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান তখন দেশের বাইরে থাকায় লে. কর্নেল আবুল হাসান খান তখন রক্ষীবাহিনীর অস্থায়ী প্রধান হিসেবে আনুগত্য প্রকাশ করেন। কিন্তু মোশতাক সরকারকে বোঝানো হয় আবুল হাসান খানের আনুগত্য রক্ষীবাহিনীর ছেলেরা মেনে নেবে না। তাই উপপরিচালক অপারেশন সরোয়ার হোসেন মোল্লাকেও আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে। আমরা যতই বলার চেষ্টা করলাম সব বাহিনীপ্রধানের মতো আমাদের বাহিনীপ্রধানও আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তাতে কাজ হলো না। আমাকে রেডিও বাংলাদেশে যেতে হলো। শহীদ বললেন আমিও যাব এবং দুজনে একসঙ্গেই ভাষণ দেব। আমি বললাম একজন দিলেই তো হয়, দুজনের দরকার কী? শহীদের উত্তর ছিল, ইতিহাসের কাছে তুমি একা কেন দায়ী হবে? ব্যর্থতা আমাদের সবার। তাই পরিণতি যা-ই হোক, দুজনে একসঙ্গেই ঘোষণা দেব। বন্ধুত্বের এ বিরল দৃষ্টান্ত ভোলার নয়।

অন্য একটি ঘটনা। ১৯৭৪ সালে যখন দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা শহীদের ছোট বোনের স্বামী কবি রফিক আজাদের বিখ্যাত কবিতা ‘ভাত দে হারামজাদা’ পোস্টার আকারে ঢাকা শহরের বিভিন্ন দেয়ালে লাগানো হয়। এ কারণে Special Branch-এর পুলিশ হন্যে হয়ে তাকে খুঁজছিল। কবিতার শেষের লাইনটি ‘ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাব’। এ কারণেই সরকার বেশি খেপে গিয়েছিল। সবকিছু শুনে আমি বললাম, ‘দোস্ত, বিষয়টি বেশ কঠিন মনে হচ্ছে। শহীদ জানাল, কবিতাটি রফিক আজাদ পাকিস্তান আমলে লিখেছিলেন এবং কোনো একটি মাসিক পত্রিকায় ছাপাও হয়। তখন আমি বললাম, চল বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব মনোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করি এবং তাঁর উপদেশ অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে। মনোয়ার ভাইয়ের অফিসে গিয়ে তাঁকে সবকিছু খুলে বললাম। তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমাদের দেখা করার ব্যবস্থা করে দিলেন। আমাদের বক্তব্য শুনে বঙ্গবন্ধু স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি ই এ চৌধুরীকে  টেলিফোনে প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করায় বিষয়টির সমাধান হয়।

আমাদের মাঝে এরকম অজস্র স্মৃতি রয়েছে যার বর্ণনা অল্প পরিসরে দেওয়া সম্ভব নয়। কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করলাম মাত্র। বন্ধুবর বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার উল আলম শহীদ সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করতে সতিই আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কোনো দিন ভাবিনি এমন বেদনাদায়ক পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। কবির ভাষায়, ‘স্মৃতিভারে আমি পড়ে আছি, ভারমুক্ত সে এখানে নাই’। আরেক ইংরেজ কবি বলেছিলেন, Dying is nothing but living without friends. ‘মৃত্যু মানে বন্ধুহীন জীবন’।

প্রিয় শহীদের আত্মা তাই পৃথিবীর ভারমুক্ত হয়ে অমরত্ব লাভ করুক, অনন্ত মহিমায় চিরভাস্বর হয়ে থাকুক- পরম করুণাময়ের কাছে এই প্রার্থনা করি। পরিশেষে যাদের অকৃত্রিম চেষ্টায় প্রিয় বন্ধু আনোয়ার উল শহীদের জীবন কাহিনির ওপর রচিত বইটি প্রকাশ পেতে যাচ্ছে, তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ দিচ্ছি।

লেখক : সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত

সর্বশেষ খবর