রবিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধু, ইন্দিরা ও রাজীব হত্যা একসূত্রে গাঁথা

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

বঙ্গবন্ধু, ইন্দিরা ও রাজীব হত্যা একসূত্রে গাঁথা

সারা দেশে যখন সন্ত্রাসবাদ, হানাহানি, খুন মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে, তখন আবার প্রমাণ হলো ভারতের গান্ধী পরিবার মানবতার দিকেই। মানবতাবাদের ওপরই এখনো ভরসা করে স্বয়ং সোনিয়া গান্ধী তাঁর স্বামী সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর ঘাতকদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। আজ থেকে ৩১ বছর আগে ২১ মে রাজীব গান্ধী যখন নির্বাচনী প্রচারে গিয়েছিলেন তখন ফুলের তোড়ায় গোপনে বোমা রাখা হয়েছিল। ছিল মানববোমাও। তখন গোটা বিশ্ব এ লজ্জাজনক ঘটনার নিন্দা জানিয়েছিল। তার আগে ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকেও আততায়ীরা গুলি করে হত্যা করেছিল। এ দুটি ঘটনা একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িয়ে আছে। পরিবারসহ বাংলাদেশের জন্মদাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডও বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।

ভারতের অপরাধ তথ্যে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা বিভিন্ন আলোচনায় বলেছেন, এ তিনটি হত্যাই একসূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী একটি পরাশক্তির পররাষ্ট্র সচিবের একটি উক্তি আজও আমাদের মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, বিশ্বে এই প্রথম আমাদের দেশের কূটনীতি দিল্লির এক মহিলার হাতে পরাজিত হয়েছে। আমরা এর প্রতিশোধ নেব। এ হত্যাগুলোর কি তার ওই উক্তির সঙ্গে কোনো যোগসূত্রে আছে? তা নিয়ে কূটনীতিকরা গবেষকা করছেন। তাদের মন্তব্য, এ হত্যাগুলোর সঙ্গে জড়িত আছে এমন সব দেশ যারা সেদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল।

সেই চিত্রটির কথা এখনো আমার চোখের সামনে ভাসছে। ২০ মে তিনি রাত ১২টার সময় পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে নির্বাচনী সভা করেন। আমি সেই সভার রিপোর্ট করতে গিয়েছিলাম। ভোর ৬টায় রাজীব গান্ধী তাঁর ব্যক্তিগত সচিব এবং বন্ধু মণিশঙ্কর আয়ারকে সঙ্গে নিয়ে কোচবিহার এয়ারস্ট্রিপে পৌঁছে যান। সেখান থেকে তাঁর আগরতলা হয়ে দক্ষিণ ভারতে তিরুঅনন্তপুরমে জনসভা করতে যাওয়ার কথা। কোচবিহার এয়ারস্ট্রিপে আমিই তাঁকে বলেছিলাম, মিস্টার গান্ধী, আপনি নির্বাচনী প্রচারে বেরিয়েছেন, আমাদের সঙ্গে কিন্তু কথা না বলে যাবেন না। আমাদের অনুরোধ শুনে রাজীব গান্ধী একটি বেঞ্চে বসে পড়লেন। নিরাপত্তা বাহিনীসহ সেখানে আমরা চার-পাঁচ জন ছিলাম। সেখানে আমরা চা-পান করি। আমাদের টাকা দিতে না দিয়ে রাজীব গান্ধী নিজেই চায়ের দাম মিটিয়েছিলেন। এরপর কথাবার্তা বলে তিনি হেলিকপ্টারে আগরতলার উদ্দেশে উড়ে যান। আমি আর টেলিগ্রাফের পথিক ছাড়া সেখানে আর কেউ ছিলেন না। ১০ মিনিটের মধ্যে কপ্টার আবার ফিরে এলো। আমরা তখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। রাজীব গান্ধী নেমে এসে আমাকে ঠাট্টার সুরে বললেন, তোমার জন্য আমার কর্মসূচি দেরি হয়ে গেল। কুয়াশার জন্য হেলিকপ্টারে উড়তে পারলাম না। এবার যতক্ষণ কুয়াশা না কাটে ততক্ষণ তোমরা এখানে থাকো। রাজীব গান্ধীর সঙ্গে সেদিন আমার অনেক কথা হয়েছিল নির্বাচন নিয়ে। দেশ ও বিদেশের নানা পরিস্থিতি নিয়ে। কোচবিহারে আগের দিন রাতে তাঁর জনসভার রিপোর্ট করে সোজা চলে গেলাম শিলিগুড়ি। সেখান থেকে বিমান ধরে কলকাতায় ফিরে এলাম। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে প্রথমে যে টেলিফোনটি পেলাম সেটি হলো বিবিসি বাংলা বিভাগের প্রধান সিরাজুর রহমানের। উনি আমাকে বললেন, এখনই জ্যোতি বাবুকে একটা ইন্টারভিউ করুন রাজীবকে নিয়ে। আমরা সেটা ৯টার বুলেটিনে ধরাব। খোঁজ নিয়ে জানলাম, জ্যোতি বাবু সেদিন তামিলনাড়ুর চেন্নাই শহরে নির্বাচনী প্রচারে গেছেন। তিনি তখন ‘হিন্দু’ কাগজের চেয়ারম্যান এন রামের বাড়িতে উঠেছিলেন। সেখানেই তাঁকে ধরলাম। তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘গত সপ্তাহে প্রেস ক্লাবে আপনি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, রাজীব এক জনসভায় আমাকে অবসর নিতে বলেছেন। আমি রেগে গিয়ে বলেছিলাম, আমি রাজীবকে পৃথিবী থেকে অবসর নিইয়ে দেব। আজ ও চলে গেল। রাজীব আমার ছেলের মতো ছিল। ওর জন্মের পর ফিরোজ আর ইন্দিরা আমাদের খাইয়েছিল। আমি রাজীবকে বলেছিলাম আমরা পঞ্চায়েতী রাজ চালু করতে চাই। ও আমাকে দিল্লিতে ডাকল। রাজীব তখন প্রধানমন্ত্রী। আমি বিনয় চৌধুরীকে নিয়ে গেলাম। বিনয় ওকে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বোঝাল। ও এরপর পঞ্চায়েতী রাজ ব্যবস্থা চালু করেছিল। এটা একটা বড় কাজ রাজীব করে গেছে। এ দেশে কম্পিউটার-ইন্টারনেট রাজীবই করেছে। আরও অনেক কাজ করেছে। কিন্তু আমি আজ আর কিছু বলতে চাই না। ও আমার বন্ধু ফিরোজ-ইন্দিরার ছেলে।’ এটাই ছিল সেদিনকার কংগ্রেস ও সিপিএমের মানবতাবোধ; যা সম্পূর্ণ হারিয়ে গেছে। এখন দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদি বলে থাকেন কংগ্রেসমুক্ত ভারত চাই। সেই সঙ্গে সুর মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও বলেন, কংগ্রেসমুক্ত ভারত চাই।

যারা চাইছেন তারা কি পারবেন? তাদের এখন একটি স্লোগান, আরএসএস-বিজেপি কংগ্রেসকে আর কখনো উঠে দাঁড়াতে দেবে না। যা-ই হোক, ১৯৯১ সালের মে মাসে তিরুঅনন্তপুরমে কী ঘটেছিল, তা সংক্ষেপে একবার দেখা যাক।

তামিলনাড়ুর শ্রীপেরুমবুদুরে নির্বাচনী জনসমাবেশের মধ্যে শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল রাজীব গান্ধীসহ ১৬ জনকে। ১৯৯১-এর ২১ মে এ মানববোমা বিস্ফোরণের নেপথ্যে ছিল শ্রীলঙ্কার বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিল জঙ্গি সংগঠন লিবারেশন টাইগার অব তামিল ইলম। মামলায় রাজীব গান্ধী হত্যার মূল চক্রী হিসেবে এনটিটিই-প্রধান ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের নাম থাকলেও তামিলনাড়ু-নিবাসী কিছু ভারতীয় ও শ্রীলঙ্কার নাগরিকের যোগসাজশে যে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে, তা তদন্তে উঠে আসে। রাজীবকে দেওয়ার জন্য বিস্ফোরকসমেত ফুলের তোড়া নিয়ে অপেক্ষা করছিল শ্রীলঙ্কার জাফনার কলেজছাত্রী। তিনমোজি রাজরত্নম ওরফে ধান্নু, ওরফে সায়ত্রী। প্রশিক্ষণের পর তাকে হত্যা অভিযানের জন্য ভারতে পাঠায় এলটিটিই। রাজীবের হাতে ফুলের তোড়া তুলে দেওয়া মাত্র ভয়ংকর বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে গোটা এলাকা। রাজীবের সঙ্গে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় ধান্নুও। পরে এ চক্রান্তের সহযোগী হিসেবে পুলিশ সাতজনকে গ্রেফতার করে। এদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচ্য হয়ে ওঠে ধান্নুকে আশ্রয় দেওয়া নলিনী মুরুগন ও তার স্বামী মুরুগন ওরফে শ্রীহরণ। বাকিদের ভূমিকা বিস্ফোরকভরা ফুলের তোড়াটি তৈরিতে নানাভাবে সাহায্য করা। আদালত ১৯৯১-এ রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ডের সাত আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। উচ্চ আদালতেও যা বহাল থাকে। রাষ্ট্রপতি প্রাণভিক্ষার আর্জি খারিজ করে দেওয়ার পর ২০১১ সালে মন্তিন, মুরুগন ও পেরারিভালানের ফাঁসি কার্যকর করার প্রক্রিয়াও শুরু করে দেওয়া হয়েছিল। তার ঠিক ৪৮ ঘণ্টা আগে ফাঁসি কার্যকরে স্থগিতাদেশ দেন মাদ্রাজ হাই কোর্ট। এরপর ২০১৪ সালে সব আসামির সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে যায় আদালতে। এর আগে ২০০০ সালে সোনিয়া গান্ধী বলেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী হওয়ায় তাঁর স্বামীর হত্যাকারী হিসেবে নলিনীকে ক্ষমা করেছেন তিনি। নলিনীর শিশু মাতৃহারা হোক, তা তিনি চান না। নলিনীও তার অপরাধের জন্য ক্ষমা চান সোনিয়ার কাছে। সোনিয়ার হস্তক্ষেপে নলিনীর সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়। ২০০৮ সালে প্রিয়াঙ্কা ভেলোর সংশোধনাগারে গিয়ে নলিনীর সঙ্গে কথা বলে আসেন। এরপর রাজীব হত্যার বাকি আসামিদেরও সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করে দেওয়া হয়।

২০১৪ থেকেই নলিনীদের মুক্ত করতে তৎপরতা শুরু করেন তামিলনাড়ুর তখনকার মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা। প্রচার করা হতে থাকে আসামিদের কেউই রাজীব হত্যার পরিকল্পনার কথা জানতেন না। তাদের ব্যবহার করেছে এলটিটিই। এদিকে কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র অভিষেক মনু সিংভি এক বিবৃতিতে বলেছেন, রাজীব ঘাতকদের মুক্তির বিষয়ে সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে একমত নন দলের নেতৃত্ব। কংগ্রেস মনে করে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ঘাতকদের মুক্তি পাওয়া অনুচিত। সিংভি বলেন, সোনিয়া গান্ধীর ব্যক্তিগত মত থাকার অধিকার আছে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও দল এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে ভিন্নমত। কংগ্রেস এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের কথা বিবেচনা করছে।

এখনো মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে বিশ্বের তাবৎ নেতা সন্ত্রাসবাদী নির্মূল করার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে নানা কর্মসূচি নেন। ভারতের শাসকগোষ্ঠী এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজ নেতৃত্ব এ ব্যাপারে যত না উদ্বিগ্ন তার চেয়ে তারা বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন কংগ্রেসমুক্ত ভারত করার জন্য। মানবতা, অহিংস- এগুলোই ছিল স্বাধীন ভারতের অগ্রাধিকার। এখন হিংসা আর ক্ষমতার লোভ চারদিকে চেপে বসেছে। এর থেকে মুক্তির উপায় কী? তা নিয়ে নানা আলোচনা চললেও সন্ত্রাসবাদ থামার কোনো লক্ষণই নেই। রাজীব বা ইন্দিরা গান্ধী আর ফিরে আসবেন না। রাজীবপুত্র রাহুল, কন্যা প্রিয়াঙ্কা এবং স্ত্রী সোনিয়া গান্ধীর নিরাপত্তার বদলে হেনস্তায় মেতে উঠেছে শাসক দল। সন্ত্রাসবাদীরা যতটা ভারতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তেমনই তারা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচেও ঘুরে বেড়াচ্ছে। সূত্র বলছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স আগেই ঘোষণা করেছেন। উপমহাদেশে শান্তি ফিরবে কীভাবে-সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর