সোমবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

গণতন্ত্রের সেবক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী

প্রফেসর মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান

গণতন্ত্রের সেবক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী

উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু দিবস আজ। এ মহান নেতা তাঁর নিঃস্বার্থ ও বলিষ্ঠ কর্মপ্রচেষ্টার দ্বারা ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তিনি ১৮৯২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুরে জন্মলাভ করেন।  দেশে উচ্চশিক্ষা শেষে তিনি ইংল্যান্ডে গিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট ক্যাথারিন কলেজ থেকে অনার্সসহ বিএসসি ও বিসিএল ডিগ্রি লাভ করেন এবং এরপর লন্ডনের গ্রেইজ ইন থেকে ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল সম্পন্ন করেন। ১৯২০ সালে স্বদেশে ফিরে সক্রিয় রাজনীতিতে অবতীর্ণ হন।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিখ্যাত সুহরাওয়ার্দী তরিকার পীর বংশের সন্তান। তাঁর পিতা স্যার জাহিদ সোহরাওয়ার্দী ও মাতা খুজিস্তা আখতার বানু-উভয়েরই পূর্বসূরিরা সাধক, দার্শনিক, আধ্যাত্মিক নেতা ও ধর্মপ্রচারক হিসেবে ইতিহাসে বিখ্যাত।

বিদেশে অবস্থানকালেই শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে এবং শোষণহীন সমাজ গঠন করে নির্যাতিত মানুষের মুখে হাসি ফোটানো ও তাদের সুখী সমৃদ্ধ জীবন পরিচালনায় সহায়তা করাই ছিল তাঁর রাজনীতির মূল লক্ষ্য। ১৭৫৭-এর পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়, ১৮৫৭-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপর্যয়ের ফলে এবং যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে এ দেশের মুসলমানরা যখন চরম দুর্দশাগ্রস্ত ও বিভ্রান্ত ঠিক সেই মুহূর্তে এ উপমহাদেশের রাজনীতিতে নির্যাতিত মানুষের মুক্তিদাতার ভূমিকায় তিনি আবির্ভূত হন এবং জীবনের শেষ পর্যন্ত দেশের মানুষকে দিকনির্দেশনা দিয়ে যান। সোহরাওয়ার্দীর সমগ্র জীবন ছিল জনগণের সঙ্গে একত্রে গ্রথিত। রুপোর চামচ মুখে দিয়ে জন্মালেও সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার সঙ্গে নিজের জীবনকে তিনি নিঃশেষে জড়িয়ে রেখেছিলেন। জনসাধারণের আশা-আকাক্সক্ষাকে রূপায়িত করার জন্য, তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি আজীবন তাঁর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর রাজনীতির মূল দর্শন ছিল সর্বস্তরের মানুষের সেবা করা। সব সময় নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষের জন্য তাঁর কণ্ঠ ছিল সোচ্চার। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের হাতে তাঁকে প্রচুর লাঞ্ছনা ও বিড়ম্বনা সহ্য করতে হয়েছে। প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের ফলে তাঁর জীবনে অনেক বিপর্যয় এসেছে এবং তিনি তা হাসিমুখে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন। রাজনীতি ও দেশসেবার ইতিহাসে এ দৃষ্টান্ত বিরল। তিনি অবহেলিত, উপেক্ষিত সাধারণ মানুষের সান্নিধ্যই পছন্দ করতেন বেশি এবং সে জন্যই দেখা যায় যে তিনি শ্রমিক মহলে ও কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে অসহায়-নিঃস্ব মানুষের মাঝে সুখ-দুঃখের আলোচনায় রত থাকতেন।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাধারণ মানুষের সমর্থন নিয়েই রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তিনি ১৯২১ সালে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে তাঁর সেদিনের জয়যাত্রা জীবনের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তিনি এতই জনপ্রিয় ছিলেন যে, জীবনে কোনো নির্বাচনে তাঁকে পরাজয়ের গ্লানি বহন করতে হয়নি। ১৯২১ সালের বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদে তিনি সরকারবিরোধী ভূমিকা পালন করেছেন। তখন থেকেই তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সান্নিধ্য লাভ করেন এবং দেশবন্ধু তাঁর প্রতিভা ও গুণে মুগ্ধ হন। তাঁরা উভয়েই হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের জন্য বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্যোগী হন। তাঁদের প্রচেষ্টায় ১৯২৩ সালে বেঙ্গল প্যাক্ট স্বাক্ষরিত ও বাস্তবায়িত হয়। বাংলার মুসলিম নেতা হিসেবে সোহরাওয়ার্দী এ সময় থেকেই পরিচিত হন।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের কোয়ালিশন স্বরাজ দলের উপনেতা ও ১৯২৪ সালে কলকাতা করপোরেশনের ডেপুটি মেয়রের পদ গ্রহণ করেন। তিনিই পোর্ট শ্রমিকদের সংগঠিত করে অবিভক্ত বাংলায় সর্বপ্রথম শ্রমিক আন্দোলন সূচনা করেন। ১৯৩৫ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য বেঙ্গল মুসলিম ইউনাইটেড পার্টি গঠন করেন এবং পরবর্তীতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর অনুরোধে মুসলিম লীগে যোগদান করে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সেক্রেটারি পদ গ্রহণ করেন। ১৯৩৭ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভার শ্রম ও বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪৩ সালে খাজা নাজিমুদ্দিনের মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভায় খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তৎকালীন খাদ্য সমস্যার মোকাবিলা করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি আবার বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইন সভায় নির্বাচিত হন ও বিজয়ী মুসলিম লীগ দলের নেতা হিসেবে অবিভক্ত বাংলার সর্বশেষ মন্ত্রিসভার প্রধানমন্ত্রী হন। স্বাধীন অবিভক্ত বাংলার প্রবক্তা শরৎচন্দ্র বোস, কে শংকর রায়, আবুল হাসিম, রঞ্জন বকসি, এফ কিউ চৌধুরী প্রমুখ ব্যক্তির সঙ্গে বাংলা বিভক্তি বিরোধিতার প্রশ্নে একমত পোষণ করেন। ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার পক্ষ থেকে সে সময় সোহরাওয়ার্দী নব প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে দেশের সাধারণ নির্বাচন পরিচালনা করেন এবং বিপুল ভোটে জয়ী হন। ১৯৫৫ সালে তিনি তদানীন্তন পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী হন। ১৯৫৫-৫৬ সালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।

১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর দূরদেশ লেবাননের রাজধানী বৈরুতের এক হোটেলে নিঃসঙ্গ অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি বৈরুতের হোটেলে নিঃসঙ্গ অবস্থায় তার জীবনের অন্তিমকালে আক্ষেপ করে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে লিখেছিলেন- “...কারো কাজে যখন আসব না, আর কেবল নিজের জন্য যদি বাঁচতে হয়, সে বাঁচার স্বার্থকতা কি?”

বর্তমানের এ অশান্ত সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো গণতন্ত্রপ্রেমী, জনদরদি, ত্যাগী রাজনীতিবিদ ও দক্ষ রাষ্ট্রনায়কের বিশেষ প্রয়োজন ছিল।  গণতন্ত্রের চর্চায় এবং দেশ গঠনে আমরা যেন এ মহান নেতার জীবনাদর্শ অনুসরণ করতে পারি এ প্রত্যাশাই করি।

লেখক : সাবেক ট্রেজারার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক অধ্যক্ষ শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ খুলনা।

e-mail : [email protected]

সর্বশেষ খবর