বুধবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

‘পরমবীর চক্র’ খেতাবপ্রাপ্ত একজন আলবার্ট এক্কার কথা

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি

‘পরমবীর চক্র’ খেতাবপ্রাপ্ত একজন আলবার্ট এক্কার কথা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনেক বিবরণ ও গৌরবময় অধ্যায় নানাজনের কলমে বিভিন্ন আঙ্গিকে পৃথিবীর ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে। বিশেষত বাংলাদেশ ও ভারতের ইতিহাসের একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে এই মহান মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এবং ভারতের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সেনাদের একে অন্যের সহযোগিতায় জীবন বাজি রাখা লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়েছিল। এ গৌরবময় এবং প্রাপ্য বিজয়ের নেপথ্যে অবদান রেখেছেন উভয় দেশের ক্ষণজন্মা কিছু বীর সন্তান। তাঁদের অনেকেই নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও দেশ, নিজ বাহিনী এবং সহযোদ্ধাদের বৃহত্তর স্বার্থে এগিয়ে গেছেন এবং একপর্যায়ে মৃত্যুকে হাসিমুখে আলিঙ্গন করে এক একজন সংশপ্তকে পরিণত হয়েছেন। এমনই এক সংশপ্তক ৩ ডিসেম্বর দিনটিকে স্মরণীয় করে রেখেছেন ত্যাগের বিরল উদাহরণ সৃষ্টি করে। ভারতের সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব ‘পরমবীর চক্র’ বা পিভিসি পাওয়া ল্যান্স নায়েক আলবার্ট এক্কা (২৭ ডিসেম্বর, ১৯৪২-৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১) ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত সৈনিক ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিসংগ্রামের সময় বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার গঙ্গাসাগরে সংঘটিত এক ভয়াবহ যুদ্ধে তিনি নিজ সেনাদলের তথা দেশের স্বার্থে আত্মাহুতি দেন। পরবর্তীতে তিনি মরণোত্তর পরমবীর চক্রে ভূষিত হন, যা শত্রুর মোকাবিলায় বীরত্বের জন্য ভারতের সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব।

আলবার্ট এক্কা ভারতের ঝাড়খন্ডের জারি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কথিত আছে, ছোট নাগপুরের রাঁচি জেলার (বর্তমানে ঝাড়খন্ডের গুমলা জেলা) আদিবাসী গ্রাম জারিতে ঐতিহ্যবাহী গান, নাচ এবং ভোজ অনুষ্ঠান চলাকালে এক্কার জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম জুলিয়াস এক্কা এবং মায়ের নাম মরিয়ম এক্কা। এ পরিবার একটি আদিবাসী উপজাতির অন্তর্গত ছিল। শিকার করা এ আদিবাসীদের মধ্যে একটি সাধারণ বিষয় ছিল এবং এক্কা শৈশব থেকেই শিকারের প্রতি বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। জঙ্গলে শিকারের অভিজ্ঞতার কারণে এক্কা প্রকৃতির সঙ্গে মিশে সবার দৃষ্টি এড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার কৌশল রপ্ত করেন, যা পরবর্তী জীবনে তাঁকে দক্ষ যোদ্ধা হতে, বিশেষত অগোচরে শত্রুর কাছে যেতে ও শত্রুকে চমকে দিয়ে লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করতে সাহায্য করে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রতি এক্কার আগ্রহ বাড়তে থাকে। হকি খেলায়ও তিনি অসাধারণ পারদর্শী ছিলেন। একটি জেলা হকি টুর্নামেন্টের সময় সপ্তম বিহার রেজিমেন্টের সুবেদার মেজর ভগীরথ সোরেন প্রথমবারের মতো আলবার্ট এক্কাকে দেখেন এবং তাঁকে তাঁর ব্যাটালিয়নে নাম লেখান। আলবার্ট এক্কা এর ফলে ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৬২ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিহার রেজিমেন্টে নথিভুক্ত হন। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে ‘১৪ গার্ডস’ নামের একটি নতুন ব্যাটালিয়ন প্রতিষ্ঠার পরিপ্রেক্ষিতে এক্কাকে সেই ব্যাটালিয়নে বদলি করা হয়। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চাকরিকালে তিনি কাউন্টার ইনসারজেন্সি অপারেশন, জঙ্গি, সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতাবাদ বিরোধী অভিযানে সক্রিয় অংশ নেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির সময় এক্কা ল্যান্স নায়েক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়েই এক্কার ব্যাটালিয়ন ‘১৪ গার্ডস’ যুদ্ধের পরিকল্পনামতো ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাগত সিংয়ের অধীন ‘৪ কোরে’ সংযুক্ত হয়। এ বাহিনী ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় সীমান্তের খুব কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিল। ভারতের অন্যান্য সীমান্ত অঞ্চলের তুলনায় এ ত্রিপুরা অঞ্চল থেকে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) রাজধানী ঢাকার দূরত্ব ছিল সবচেয়ে কম। সুতরাং আগরতলায় ভারতীয় সেনা ও মুক্তিবাহিনীর সমাবেশ এবং যুদ্ধ তৎপরতার ওপর কড়া গোয়েন্দা নজরদারি ছিল পাকিস্তানিদের। আর যুদ্ধবহর বিশেষত ভারী যুদ্ধযান নিয়ে মিত্রবাহিনীর সীমান্ত অতিক্রমের সম্ভাব্য সব রাস্তা বা পয়েন্টকে কেন্দ্র করে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ঘাঁটি বা ডিফেন্স গড়ে তুলেছিল পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ-দেশি দোসররা। অন্যদিকে ভারতীয় বাহিনীর উদ্বেগ ছিল যুদ্ধের এ পূর্বাঞ্চল বা ইস্টার্ন ফ্রন্ট নিয়ে। কারণ কোনোভাবে সর্বাত্মক যুদ্ধের ছত্রচ্ছায়ায় পাকিস্তানিরা যদি সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলা ঢুকে যেতে পারত তবে সেভেন সিস্টার্স খ্যাত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আসাম, অরুণাচল, মেঘালয়, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম ও ত্রিপুরা এবং সিকিম রাজ্যসংলগ্ন অঞ্চলটিকে নিজ আয়ত্তে আনা ও সার্বিক বিষয়ে মিত্রবাহিনীর ওপর অন্যান্য শর্তারোপ সহজ হতো।

ত্রিপুরা সীমান্ত বরাবর পাকিস্তানিদের অন্যতম প্রতিরক্ষা ঘাঁটি বা ডিফেন্স পজিশন ছিল বাংলাদেশ অংশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া রেলস্টেশন থেকে ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত গঙ্গাসাগর নামক স্থানে। এ গঙ্গাসাগরেও একটি রেলস্টেশন ছিল। এ রেলস্টেশন ও রেললাইনটি ঢাকা-চট্টগ্রাম যোগাযোগের জন্য অপরিহার্য ছিল। রেলস্টেশন কমপ্লেক্স, গোয়াল গাঙ্গাইল ও মোগরা নামের দুটি গ্রাম, লীলাহাট বাজার এবং তিন রাস্তার মাথা নিয়ে বেশ সময় নিয়েই শক্ত প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে ছিল পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকার ও আলবদর নামক তাদের দেশি দোসররা। তবে মূল সেনারা ছিল পাকিস্তানের ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স (এফ এফ) এবং ১২ আজাদ কাশ্মীর ব্যাটালিয়নের ব্যাটালিয়ন সদর দফতর থেকে। এর মধ্যে ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের তিনটি কোম্পানি (প্রতি কোম্পানির জনবল প্রায় ২০০), ১২ আজাদ কাশ্মীর রাইফেলের একটি কোম্পানি এবং রাজাকারদের একটি কোম্পানি দ্বারা গঙ্গাসাগরের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা হয়। রেললাইন, গ্রাম এবং রেলস্টেশনের পেছনের গঙ্গাসাগর নামক বিশাল দিঘির পাড় চারদিকের ফসলের জমি থেকে উঁচু ছিল। এ উঁচু স্থানগুলোতেই বাংকার খুঁড়ে অবস্থান নেয় তারা। আবার নিজেদের নিরাপত্তায় তাদের বাংকারের ওপরও ছিল শক্তিশালী আচ্ছাদন। আর বাংকারের সামনে বিছানো ছিল ট্যাংক ও মানুষবিধ্বংসী মাইন, তারকাঁটাসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা। এ ছাড়া ফসলি জমির একটা বড় অংশ কাদাপানিতে নিমজ্জিত থাকায় মাঠজুড়ে সেনাদের যুদ্ধের জন্য চলাচল বা ক্রস কান্ট্রি মবিলিটি কঠিন ছিল। সার্বিক বিচারে বলা যায়, নিজেকে নিরাপদ রেখে উত্তর-দক্ষিণ বিস্তৃত রেললাইন ও সীমান্তরেখার মধ্যবর্তী স্থানে তথা পূর্বদিক বা ভারত থেকে অগ্রসরমান যে-কোনো সেনাদল ঘায়েল করার এক মৃত্যু উপত্যকা বা কিলিং জোন তৈরি করেছিল পাকিস্তানিরা।

মিত্রবাহিনীর দ্রুততম সময়ে ঢাকা দখলের বৃহত্তর অভিযানের অংশ হিসেবে ‘অপারেশন নাট ক্র্যাক’-এর আওতায় ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেডকে গঙ্গাসাগর দখল করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেডের অধীন ১৪ গার্ডস ব্যাটালিয়ন তথা ল্যান্স নায়েক আলবার্ট এক্কার ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব পড়ে গঙ্গাসাগরে অবস্থিত একটি শক্ত ও সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ঘাঁটি দখল করার। আর ল্যান্স নায়েক এক্কা ছিলেন ১৪ গার্ডস ব্যাটালিয়নের সি (চার্লি) কোম্পানির লড়াকু সদস্য। এ গঙ্গাসাগর দখল করতে পারলেই ইস্টার্ন কমান্ডের ভারী যুদ্ধসরঞ্জাম ও বিশাল সেনাবহর স্থলপথে ঢাকা অভিযানের সহজ ও সীমান্ত থেকে অপেক্ষকৃত কম দূরত্বের অক্ষ বা সামরিক পথ উন্মুক্ত হবে বলে ধারণা করেছিলেন মিত্রবাহিনীর সেনারা। পাকিস্তানি বাহিনীও এমনটা জানত। তাই শেষ ব্যক্তির শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে গঙ্গাসাগর নিজেদের দখলে রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল পাকিস্তানি বাহিনী। ফলে গঙ্গাসাগরে রক্তগঙ্গা বয়ে যাওয়ার অঘোষিত পরিস্থিতি উপলব্ধি করছিল উভয় পক্ষ। তবু উভয় পক্ষ ছিল অনড়।

১ ডিসেম্বর রাতে ১৪ গার্ডসকে গঙ্গাসাগরে আক্রমণের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেডের অন্য ব্যাটালিয়ন ১৯ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে আন্তর্জাতিক সীমান্তের কাছে অবস্থিত কর্নেল বাজার দখলেরও দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১ ডিসেম্বর রাতেই ১৯ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ট্যাংকের সমর্থন নিয়ে কর্নেল বাজার দ্রুত দখল করে নেয়। এর ফলে উভয় ব্যাটালিয়নই গঙ্গাসাগরে নিয়োজিত পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে পৌঁছে যায়। মিত্রবাহিনীর দুটি পৃথক দল বিদ্যুৎ গতিতে গঙ্গাসাগরের দক্ষিণ ও পশ্চিমে রাস্তায় অবরোধ (রোড ব্লক) স্থাপন করে। এর ফলে পাকসেনারা দক্ষিণে আখাউড়ার বাকি সতীর্থ ও পশ্চিমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থিত পাকিস্তানি ১৪ পদাতিক ডিভিশন থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ২ ডিসেম্বর ১৪ গার্ডসের সেনারা দক্ষিণ বা আখাউড়ার দিক থেকে গঙ্গাসাগর আক্রমণ করার সব আয়োজন শেষ করে। কর্নেল বাজার দখল করা ভারতীয় ১৯ পাঞ্জাব রেজিমেন্টও বিজয়ের আনন্দ ও অহংকার নিয়ে ১৪ গার্ডসের সঙ্গে যোগ দেয়। ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এর সকালে ১৪ গার্ডের দুটি কোম্পানি গঙ্গাসাগর রেলস্টেশনে আক্রমণ শুরু করে। অন্য দুটি কোম্পানিও রেলস্টেশনসংলগ্ন অন্যান্য এলাকা দখলের উদ্দেশ্যে অভিযান পরিচালনা করে। গঙ্গাসাগর রেলস্টেশনে হামলাকারী দুটি কোম্পানির জন্য এ আক্রমণ কঠিন এবং বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। কারণ মাইনফিল্ড ও কাদামাটির জন্য তারা রেললাইনের ওপর দিয়ে এগোতে বাধ্য হয়। ফলে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা থেকে সহজেই তাদের শনাক্ত এবং গুলি করা হচ্ছিল। পাকিস্তানিরা ছিল কংক্রিটের বাংকারে সুরক্ষিত এবং সমস্ত শক্তি দিয়ে গঙ্গাসাগর রক্ষা করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পাকিস্তানিদের এ প্রতিরোধ নির্মূল করার জন্য যথাসম্ভব নিজেকে আড়াল করে বাংকারের কাছে যাওয়া এবং দ্রুত গ্রেনেড নিক্ষেপ ও আরও কাছে গিয়ে কার্যকরভাবে বেয়নেট চার্জ করে তাদের ঘায়েল করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই এগোতে থাকেন ১৪ গার্ডসের সাহসী সেনারা। একপর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে বাংকারে বাংকারে এবং দুই বাংকারের মাঝে হাতাহাতি ও বেয়নেট চার্জ শুরু হয়। এমনকি মিত্রবাহিনী যখন পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে ছিল, তখনো পাকিস্তানিদের মেশিনগানের প্রচন্ড গুলিবর্ষণের ফলে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছিলেন ভারতীয় ১৪ গার্ডসের সেনারা। মেশিনগানের অনবরত গুলি, ঘন ঘন মাইন বিস্ফোরণ এবং তারকাঁটায় আটকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ফলে মৃতের ও আহতের সংখ্যা দুটোই বাড়তে থাকে ভারতীয় শিবিরে। তথাপি গার্ডসম্যানরা নিজেদের আরও এগিয়ে নিয়ে যান এবং শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে হাতাহাতি যুদ্ধে একেকটি ফলাফল নির্ধারিত হতে থাকে। যুদ্ধের ঘনঘটার মধ্যে ল্যান্স নায়েক আলবার্ট এক্কা লক্ষ করেন, একটি পাকিস্তানি লাইট মেশিনগান আক্রমণকারী সেনাদের মারাত্মক ক্ষতি করছে। তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তিনি শত্রুর কাছে যান এবং বাংকারে গ্রেনেড চার্জ ও বাংকারের দুই শত্রুসেনাকে বেয়নেট চার্জ করে শেষ পর্যন্ত লাইট মেশিনটি স্তব্ধ করেন। এ আক্রমণে গুরুতর আহত হলেও তিনি তাঁর প্লাটুন নিয়ে রেললাইনের এক মাইল পশ্চিমে লড়াই চালিয়ে যান ও বাংকারের পর বাংকার শত্রুমুক্ত করেন। এ সময় উত্তর দিকে অবস্থিত একটি সুরক্ষিত দালানের দ্বিতীয় তলা থেকে পাকিস্তানিদের একটি মিডিয়াম মেশিনগান ফায়ারিং শুরু করে। এর ফলে মিত্রবাহিনীর হতাহতের বহু ঘটনা ঘটতে থাকে। এবারও দুঃসাহসী ল্যান্স নায়েক আলবার্ট এক্কা একটিবারের জন্যও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য চিন্তা না করে ও তাঁর গুরুতর আঘাতকে অবজ্ঞা করে ওই বিল্ডিং পর্যন্ত ক্রলিং করে এগিয়ে যান এবং বাংকারে একটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একজন শত্রুসেনাকে হত্যাসহ অন্যজনকে আহত করেন। এরপর মেশিনগান থেকে গুলি করতে থাকা দুই পাকিস্তানি সেনাকে এক্কা বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করেন। এর ফলে একই সঙ্গে থেমে যায় মেশিনগানের গুলি ও এক বীর ভারতীয় সেনা ল্যান্স করপোরাল আলবার্ট এক্কার হৃদয়ের স্পন্দন। ল্যান্স নায়েক আলবার্ট এক্কা ছাড়াও ১৪ গার্ডস রেজিমেন্ট এ যুদ্ধে তাঁর ১৩ জন বীর সদস্যকে হারিয়েছে। এর মধ্যে তিনজন জুনিয়র কমিশনড অফিসার এবং ১০ জন অন্যান্য পদের সেনা ছিলেন। এর বাইরে আহত হয়েছিলেন ৫৫ জন সেনা সদস্য। পক্ষান্তরে পাকিস্তানিদের ২৫ জন নিহত ও ছয়জন যুদ্ধবন্দি হয় এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ আটকের তথ্য পাওয়া যায়। হতাশ পাকিস্তানিরা তার পরও জঙ্গিবিমান, ট্যাংক ও পদাতিক বাহিনী দিয়ে পাল্টা আক্রমণ করার চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু সাফল্যের সঙ্গে তা প্রতিহত করে মিত্রবাহিনী। গঙ্গাসাগর দখলের পর ৭৩ ব্রিগেড উত্তরে ৩১১ ব্রিগেডের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং কসবাকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে কসবা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কটি অবরোধ করে। অন্যদিকে গঙ্গাসাগর পতনের পর শত্রু ও তাদের দোসররা এ এলাকা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়, যা পরবর্তীতে মিত্রবাহিনীর চূড়ান্ত বিজয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখে। পরে অ্যালবার্ট এক্কার মৃতদেহ আগরতলার কাছে দুলকি গ্রামে সমাহিত করা হয়।

সরকারি নথিতে লিপিবদ্ধ সামরিক বীরত্বগাথা  (সাইটেশন)

পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধক্ষেত্রের গঙ্গাসাগরে অবস্থিত শত্রুর ঘাঁটিতে আক্রমণের সময় গার্ডস ব্রিগেডের অধীনস্থ ব্যাটালিয়নের বাঁ সম্মুখ কোম্পানির একজন সদস্য ছিলেন ল্যান্স নায়েক আলবার্ট এক্কা। শত্রুর এ অবস্থানটি ছিল যথেষ্ট প্রশিক্ষিত সৈন্যবেষ্টিত এবং সুদৃঢ়। আক্রমণকারী সেনারা (মিত্রবাহিনী) প্রথমেই প্রচন্ড কামানের গোলা (শেল) ও ক্ষুদ্রাস্ত্রের অবিরাম গুলির সম্মুখীন হয়। কিন্তু এর মধ্যেই তারা নিজেদের লক্ষ্যের (টার্গেট) দিকে এগিয়ে যায়। এরপর শুরু হয় ভয়াবহ হাতাহাতি যুদ্ধ। ল্যান্স নায়েক আলবার্ট এক্কা লক্ষ করেন শত্রুর একটি লাইট মেশিনগান (এলএমজি) থেকে ছোড়া গুলিতে তাঁর কোম্পানির সৈন্যদের ব্যাপক ক্ষতি (পতন) হচ্ছে। নিজের নিরাপত্তা তুচ্ছ করে তিনি শত্রুর বাংকার আক্রমণ করেন এবং বাংকারে থাকা দুজন শত্রুকে একাই বেয়নেট চার্জ করে হত্যার মাধ্যমে মরণঘাতী এলএমজিটি স্তব্ধ করেন। এ আক্রমণের সময় তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। কিন্তু নিজের আহত শরীরকে উপেক্ষা করে তিনি সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সমানতালে লড়তে থাকেন এবং অসীম সাহসিকতার সঙ্গে একের পর এক বাংকারে ঢুকে শত্রুদের ঘায়েল করে প্রায় এক মাইল দূর অবধি বিস্তৃত শত্রুসেনাদের ধ্বংসের লক্ষ্যে এগোতে থাকেন। কিন্তু তাদের এ আগ্রাসি আক্রমণ থামিয়ে দেয় দক্ষিণ দিকের একটি দালানের দোতলা থেকে ছোড়া মিডিয়াম মেশিনগানের অবিরাম গুলি। এ দালানটি সামরিক বিচারে অত্যন্ত সুরক্ষিত ছিল। এমনি সময়ে আবারও এগিয়ে আসেন বীর সৈনিক ল্যান্স নায়েক আলবার্ট এক্কা। একটিবারের জন্যও নিজের নিরাপত্তার কথা না ভেবে এবং নিজের আহত শরীর ও শত্রুর দিক থেকে আসা অবিরাম গুলি অবজ্ঞা করে হামাগুড়ি (ক্রলিং) দিয়ে তিনি সুরক্ষিত দালানের কাছে অবস্থান নেন। এরপর দালানের ভিতর গ্রেনেড ছুড়ে মারেন। এর ফলে তৎক্ষণাৎ একজন শত্রু মারা যায় এবং অন্য একজন আহত হয়। তার পরও সেই মেশিনগানের গুলি অব্যাহত থাকে। অসীম সাহসিকতা ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিয়ে ল্যান্স নায়েক আলবার্ট এক্কা পাশের একটি দেয়াল টপকে সুরক্ষিত দালানে ঢুকে পড়েন এবং মেশিনগান দিয়ে গুলি করতে থাকা দুই শত্রুকে আক্রমণ করেন। এ সময় বীরত্বের সঙ্গে বেয়নেট চার্জ করে তিনি গুলি করতে থাকা সেই দুজন শত্রুকে ঘায়েল করেন এবং মেশিনগানের গুলি থামিয়ে দেন। এতে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি থেকে তাঁর কোম্পানির অন্য সহযোদ্ধারা রক্ষা পান এবং বিজয় নিশ্চিত হয়। কিন্তু এ আক্রমণের সময় তিনি মারাত্মকভাবে জখম আহত হন এবং বিজয় নিশ্চিত করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। সামগ্রিকভাবে এ যুদ্ধে ল্যান্স নায়েক আলবার্ট এক্কা দৃশ্যমান বীরত্ব ও সুদৃঢ় সংকল্প প্রদর্শন করেন এবং সেনাবাহিনীর সেরা ঐতিহ্যের স্বাক্ষর হিসেবে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেন।

গঙ্গাসাগর আক্রমণে অসামান্য অবদান, অনুকরণীয় সাহস ও দেশের জন্য জীবন উৎসর্গের স্বীকৃতিস্বরূপ ল্যান্স নায়েক আলবার্ট এক্কাকে ভারতের সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব ‘পরমবীর চক্র’ (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। এ ছাড়া এ যুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একজন বীর চক্র পদক, একজন সেনা পদক এবং একজন বিশেষ সেবা পদক লাভ করেন। ২০০০ সালে ভারতের ৫০তম প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে ভারত সরকার তাঁর স্মরণে একটি স্মারক ডাকটিকিট উন্মোচন করে। নিজ জন্মস্থান ঝাড়খন্ডে ফিরাইলাল স্টোরের সামনের প্রধান চত্বরটিকে আলবার্ট এক্কা চত্বর নামে নামকরণ করে সেখানে তাঁর ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। তাঁর নামে নিজ জেলা গুমলায় একটি ব্লক (উপজেলা) তৈরি করা হয়, যার নাম আলবার্ট এক্কা (জারি) ব্লক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় আগরতলাকে পাকিস্তানের হাত থেকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ত্রিপুরায় ‘আলবার্ট এক্কা পার্ক’ নামে একটি ইকো পার্ক নির্মিত হয়েছে।

লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর